শ্রীলংকায় দুর্নীতিবাজ রাজাপাকশে পরিবারতন্ত্রের পতন দেখে, গোটা বিশ্বের নাগরিক সমাজ জনমানুষের আন্দোলনের শক্তি উদযাপন করছে। শক্তিশালী নাগরিক সমাজ ছাড়া কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি কোনকালে।
যে কোন দেশের নাগরিক সমাজ সারাদেশের মানুষের যে কোন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। কলম্বোর নাগরিক সমাজ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষকে বাঁচিয়েছে পরিবারতন্ত্রের রাহুগ্রাস থেকে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নেটিজেন সমাজ শ্রীলংকার সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সাফল্য উদযাপন করছেন। কিন্তু সহমত ভাইয়ের শহর ঢাকার কিছু ফুরিয়ে যাওয়া নাগরিক সমাজ নেতা; যারা জনগণের সেজে সরকার তোষণের কাজ করে শঠতার জীবনবৃত্তি বেছে নিয়েছে; তারা বাংলাদেশের মানুষের কোন কিছুতে নিজে থেকে খুশী হওয়া সহ্য করতে পারেন না। ভাবখানা এমন যে সরকারী সার্কুলার দিয়ে যখন জিডিপি গ্রোথা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বা হেনতেন বিজয় উদযাপন করতে বলবে, কেবল তখনই মানুষকে খুশী প্রকাশ করতে হবে।
সব ফ্রিডমের বারোটা বাজিয়ে এখন ফ্রিডম অফ হ্যাপিনেসে হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করছে কতিপয় সহমত ভাই।
সহমত ভাইয়েরা এইভাবে আসলে সরকারকে তেলাঞ্জলি দেয়। ফেসবুক বিবৃতি দিয়ে সরকারের চোখে পড়তে চায়; লক্ষ্য রঙ্গভবনের পিঠাপুলির আসরে দাওয়াত।
তেলাঞ্জলির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় উহার নাম দিলাম তৈলবান। আমরা জানি ফ্রিডম সূচকে তালিবান শাসিত আফঘানিস্তানের নীচে অবস্থান করছে তৈলবান শাসিত বাংলাদেশের। জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের ভাষায় বলি, জিভ কাটো লজ্জায়।
ক্যাসিনো লীগের সম্রাট তার বিরুদ্ধে করা সব কয়টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। এখন তার মুক্তিতে বাধা নেই। তৈলবান যুদ্ধবাজ নেতাদের প্রয়োজন হয় রাজপথের অসন্তোষ দমনে। তাই যারা ছাত্রলীগের ও যুবলীগের ফুটসোলজার থেকে তৈলবান বদিদেবতার মতো মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠেন; তারা নানা অপরাধে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। তখন ফেসবুকের সহমত ভাইয়েরা জনগণকে উদ্দীপ্ত করে হ্যাশট্যাগ ধন্যবাদ পিএম-এর তেলাঞ্জলিতে ভাসতে।
কিন্তু যখন দলীয় মাস্তান আদালতের নাচঘরে বেলিডান্স করে বেরিয়ে আসে বাহুবলী হয়ে; তখন আবার এই গণদেবতার ভালো দিকগুলোর গল্প নিয়ে এগিয়ে আসে খুচরো তেলের কারবারিরা।
ইউনিভার্সিটিতে বামদলের ভ্যানগার্ড বিক্রি করা দিদি ফেসবুকে সরকার সমর্থনের পোল ডান্স করে। বামদলের বাটার বন কলা খেয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া লোকটিও ফেসবুকে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হতে চায়।
ফেসবুকে শ্রীলংকার লংকাকাণ্ড দেখিয়া পবিত্র পদচারণার মাটির ডালা বুকে লইয়া ঘুমাইয়া থাকা সহমত ভাই অকস্মাত জাগিয়া কহিলেন, তোমরা রাশিয়ায় বৃষ্টি হইলে আগে ছাতা ধরিতে এইখানে; এখন শ্রীলংকার গাছে কাঁঠাল দেখিয়া গোঁফে ও হাতে তেল মাখাইতেছো! পণ্ড-প্রত্যাশা এইসব। যাও বরং খুঁজিয়া বাহির করো পবিত্র পদচারণার মাটি। ঐ মাটি-পূজা ছাড়া দ্রুত ধনী হইতে পারিবে না; এমন গরীব হইতে গরীবতর হইবে দিবাস্বপ্ন দেখিয়া। ওরে ক্রীতদাসের এমন হাসি মানায়না রে!
আর আছে শিবিরের ছেলেদের মতো আইডেন্টিক্যাল চেহারা মুখাবয়ব অভিব্যক্তির সরকার সমর্থক। পরিবারে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ কিংবা ত্যাগের কোন ইতিহাস নেই; এমন পরিবারের ছেলেটি হঠাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নক্সী পাঞ্জাবি পরে বাংলাদেশের প্রায় একশো বছর ধরে মানুষের মুক্তির যুদ্ধে সক্রিয় পরিবারের লোকেদের, সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়ে, চেতনার সাচ্চা তৈলবান হয়ে ওঠে।
চেতনা তৈলবান, ফেসবুকে শ্রীলংকার জনবিজয়ে উচ্ছ্বাস দেখে তার থরকম্প হয়। ভীতি সরাতে সে নিজের পুচ্ছে এড্রেনালিন ইনজেকশান দিতে ফেসবুকে ঘোষণা দেয়, শ্রীলংকার রাজাপাকশে সমর্থকদের বস্ত্রহরণ দেখে যারা আনন্দ প্রকাশ করছে; তারা দেশ বিরোধী।
মিথ্যা বাদী রাখালের এই যে ষড়যন্ত্র বাঘ আসার গল্প; সে গল্প আমরা প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শুনছি। বাংলাদেশের নাগরিককে যখন তখন দেশবিরোধীর তকমা দেয়া একটি অপরাধ। এই অপরাধের অবশ্যই শাস্তি হবে।
সহমত সাংবাদিক ভাই, রাজাপাকশের চার্লি সাংবাদিকের বস্ত্রহরণের ছবি দেখে আর্তনাদ করে, এটা ফেইক নিউজ; (পড়ুন, প্লিজ আমাকে ভয় দেখাবেন না)।
সরকারের বিএনপি বিষয়ক সহমত ভাইয়েরা আরেক কাঠি সরেস; তারা কান্দাকাটি ভবনে গিয়ে টুকিয়ে কটি ছবি জোগাড় করে ইউরেকা ইউরেকা বলতে বলতে ফেসবুকে আসে। টিএসসিতে জিয়ার অপমানের ছবি, সালাউদ্দিনের দৌড়ের ছবি, নিজদলের কর্মীদের হাতে রিজভীর ঘেরাও হবার ছবি দিয়ে; সহমত ভাইয়েরা চেষ্টা করে শ্রীলংকার জনবিজয়ের মিছিলে যোগদিয়ে। এসবই সহমত ভাইয়ের চিকন টেনশনের বহিঃপ্রকাশ।
আমি যদিও মনে করি, বাংলাদেশের পরিবারতন্ত্রের ভয় পাবার কোন কারণ নেই। ভারতের কলকাতা, দিল্লীর মানুষ পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে জনগণের দলকে ক্ষমতায় রেখেছে। পাকিস্তানের পেশাওয়ার, করাচী দ্বিদলীয় পরিবারতন্ত্রের বাইরে জনগণের একটি দল দাঁড় করিয়েছে। কারণ ঐসব শহরের শক্তিশালী নাগরিক সমাজ আছে। যারা ইউরোপের নাগরিক শক্তিকে অনুসরণ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
কিন্তু সহমতের শহর ঢাকায় দুটি পরিবার দুটি ধর্ম; এর উপাসনালয় আছে, মাজার আছে; সমর্থনের নামাজের নিয়ম আছে; দলীয় ক্ষমতামুখী জিহাদের নির্দেশনা আছে। এ সেই কথা সাহিত্যিক ওয়ালীউল্লাহ’র “লালসালু” গ্রাম যেখানে দুটি মুদাচ্ছির পীরের মাজার আছে। ব্যাপারী আছে অনেকগুলো। আর আছে মাজারের খাদেম। আছে পেশীবহুল চাঁদাপথের যুদ্ধের সৈনিক।
সুতরাং লালসালু গ্রামের আনন্দ আর ধরে না। এখানে সাফল্যের সূচক দলীয় দুর্নীতি বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগা। পীরের আশীর্বাদ পেলেই, নাগরিক সমাজ শিল্পের ঠেকা পায় বিমানবন্দরে; নানা রকম জয়ন্তী উদযাপনে; পদ-পদবী-পদক-প্লট বাগাতে রঙ্গভবনে গিয়ে সহমত নাগরিক সমাজ বলে, মা জননী আমার কান মলে দিন। আপনার কান মলে দেয়ার বুজরুকি শুনে এসেছি মা। দশবছর আগে যারা কুঁড়েঘরে থাকতো; আপনার কানমলা খেয়ে এখন তারা রাজপ্রাসাদে থাকে। আগে যারা পান্তা খেতো মরিচ ভেঙ্গে আর পেয়াজ চিবিয়ে; শুধু একটি অলৌকিক কানমলার গুনে; তারা এখন পাঁচ তারা হোটেলে পাস্তা খায়।
সুতরাং ভয় নেই হে পৃথিবী গ্রহের বাইরে সহমত ভাইয়ের শহরে অতি আত্মবিশ্বাসী মহল্লাবীক্ষা প্রাপ্ত তেলাঞ্জলির পন্ডিতেরা।
যে ডিএনএ বৃটিশকে তেলাঞ্জলি দিয়েছে; পাকিস্তানকে তেলাঞ্জলি দিয়েছে; বাংলাদেশ কালের হাওয়া উপনিবেশকে তেলাঞ্জলি দিয়েছে; তারা শতবর্ষ ধরে কান্দাকাটি উপনিবেশকেও তেলাঞ্জলি দিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারবে।
যে ডিএনএ জমিদারের বাড়ির সামনে জুতো খুলে খালি পায়ে হেঁটে গিয়েছে; সে ভক্তিতে নূয়ে পড়া ডিএনএ-র জেলিফিশ। সুতরাং মাত্র ১৭ জন তৈলবান নিয়ে ১৭০০ জনতাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবার এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি; সকল স্বৈরাচারের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
– মাসকাওয়াথ আহসান,সাংবাদিক ও সাংবদিকতার শিক্ষক
এডিটর ইন চীফ, ই সাউথ এশিয়া