সেনা সমর্থিত এক এগারো সরকারের লোকেদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রয়াত নেতা প্রণব মুখার্জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রণব তাঁর আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন।
প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনাকে তাঁর নির্বাসিত দিল্লী বাসে সহযোগিতা করেছেন। অন্যদিকে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী, বাংলাদেশের মেয়ে হওয়ায়; প্রণব বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসীর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বসবাসের বিষাদসিন্ধু সম্পর্কে অবহিত।
প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আরোহণে সহায়তা করার পরিবর্তে; বাংলাদেশে হিন্দুদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন; আর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন করা; এই দুটি দাবী রেখেছিলেন। প্রণব মুখার্জি ব্যক্তিগতভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে পাকিস্তানের পিপলস পার্টির সম্পর্ক পছন্দ করেননি। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুশাররফের সঙ্গে “কাশ্মীর”-কে স্বতন্ত্র স্বশাসিত ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে সাত দশকের সংকট সমাধানের পদক্ষেপ নিলে; প্রণব মুখার্জি তাতে বাধ সাধেন। প্রণব কংগ্রেসে তরুণ নেতৃত্ব বিকাশের পথে বাধা ছিলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে, ঢাকায় এসে প্রণব “চেয়ারে” বসে; আর সব বাংলাদেশি সিনিয়র নেতাদের যেভাবে দাঁড় করিয়ে রাখেন; সেই ছবিটিতে ভদ্রলোকের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের পরিচয় মেলে।
বিএনপি জামায়াত শাসনামালে জঙ্গীবাদ যেরকম বিস্তার লাভ করে; তাতে পুলিশ ও প্রশাসনের মুসলমান কর্মকর্তাদের মধ্যে কারা জামায়াতের প্রতি সমর্থন পোষণ করে; সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সন্দিহান ছিলো।
একারণেই আওয়ামী লীগ পুলিশ-প্রশাসনে হিন্দু অফিসারদের সামনে নিয়ে আসে। এটা দেখলে আপাত চোখে হিন্দু তোষণ মনে হবে। কিন্তু এটা ছিলো হিন্দুদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে; অপ্রিয় কাজগুলো করিয়ে নেয়া।
বৃটিশেরা একইভাবে হিন্দুদের দিয়ে অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিয়েছিলো ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে।
বাংলাদেশে হিন্দু কর্মকর্তাদের দিয়ে ইসলামপন্থী দমনের কাজ করালেও; সাধারণ হিন্দুদের জীবনে এর ফল হয়েছে উলটো। এখন যে কোন মুসলমান “ফইন্নির ঘরের ফইন্নি” যে কোন হিন্দুকে বলে দেয়, বাপের দেশ ভারতে চলে যা। যেন ঐ ফইন্নির নিজের বাপের দেশ এটা।
নাসির নগরে আওয়ামী লীগের কর্মীরা হিন্দুদের ওপর চড়াও হলে; সেখানকার পুলিশ সুপার নিজেও সংখ্যালঘু হয়েও তাদের রক্ষা করতে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশের যে কোন মানুষ যখন “প্রদীপে”-র ক্রসফায়ারের বিভীষিকা দেখে; হিন্দু বিদ্বেষী সেন্টিমেন্ট বাড়তে থাকে। ইসলমপন্থী নেতা-কর্মী গ্রেফতারের পর হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তাকে মিডিয়ায় স্টেটমেন্ট দিতে দেখে, হিন্দু বিদ্বেষ বাড়ে। ঠিক এই কাজটা করেছে বৃটিশেরা। তারা পূর্ববঙ্গে ও অন্যান্য মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ এলাকায় হিন্দু প্রশাসক-পুলিশ নিয়োগ করে; ডার্টি জব করিয়ে নিয়েছে। ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স গ্রন্থে, এই মেথডের উল্লেখ আছে। অন্যকে দিয়ে ডার্টি জব করিয়ে নিয়ে; নিজে রক্ষা কর্তা হিসেবে হ্যাশট্যাগ ধন্যবাদ বৃটিশ তেলাঞ্জলিতে ভাসতে থাকা।
পূর্ববঙ্গে যে প্রশাসকেরা মুসলিম নির্যাতন করলো; যে জমিদার জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম বানালো; তারা কিন্তু পরে ভারতে গিয়ে ভালোই ছিলো। কিন্তু সেই আক্রোশে পূর্ব পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে সাধারণ হিন্দুরা নির্যাতিত হতে থাকে।
কেউ একবারো মনে করলো না, হিন্দু শিক্ষকেরা বিদ্যায়তনে কী নিবিড় ভালোবাসায় সন্তানস্নেহে বড় করেছিলেন মুসলমানের ছেলে-মেয়েদের। হিন্দু নেতারা মুসলিম লীগকে ভোটে জিতিয়ে “পাকিস্তান গঠনের” ম্যান্ডেট দিয়েছিলো। অথচ পাকিস্তান তৈরির পর তাদের ভাগ্য জোটে বিট্রেয়াল।
আজো মুসলমান বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাপ্রধান হারুনের ডেসটিনি দুর্নীতি, মখা আলমগীরের ফার্মার্স ব্যাংক কেলেংকারি নিয়ে আলোচনার চেয়ে পিকে হালদার দুর্নীতি নিয়ে আলোচনাতে বেশি আগ্রহ সাধারণ মানুষের।
বাংলাদেশে ছাত্রলীগে হিন্দু ছেলেদের বড় পদ দেবার নামে; ছেলেগুলোকে
চাঁদাপথের যুদ্ধে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ভারতের বিজেপির প্রণোদনার বাংলাদেশের অনেক হিন্দু তরুণ হিন্দুত্ববাদে দীক্ষা নিয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের পরিবেশে এটা খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
দুদিন আগে লীগের এক কাউন্সিলরের স্ত্রী এক হিন্দু ধর্মী পরিবারকে “ভারতে” চলে যেতে বললো। তা নিয়ে ফেসবুকে আলোড়ন নেই। অথচ হিন্দু নাটক শিক্ষিকার টিপ নিয়ে কী বিশাল বিপ্লব করে পোগোতিচিলেরা। ওখানেও হিজাব নিয়ে গালাগাল করে; ফেসবুকাররা; হিন্দু বিদ্বেষের তাওয়া গরম করেছে।
ঢাকায় আমার হিন্দু বন্ধুদের বাসা ভাড়া পেতে অসুবিধা হয়; বাচ্চা প্লে গ্রাউন্ডে গেলে নতুন বড়লোক মুসলমান সাপের বাচ্চারা দুর্ব্যবহার করে।
আমার চেনা মেধাবী হিন্দুরা বাধ্য হয়ে পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছে। কারণ তারা শিক্ষিত মানুষ, সৎ মানুষ। তারা কোন রাজনৈতিক দলের রাজবদর হতে জন্মায়নি।
টিভি টকশোতে সহজ-সরল হিন্দু বন্ধুদের ক্রিটিক্যাল সব টপিকে সরকারকে ডিফেন্ড করতে পাঠায়; কিন্তু পার্টিতে তাদের কোন পোস্ট দেয়না। বড় জোর কারো স্ত্রীকে সংসদে সংরক্ষিত অলংকার বানায়।
ফেসবুকে দাড়ি-অলা বাপের ছেলে বোরখা পরা মায়ের ছেলে-মেয়ে পোগোতিচিল হয়ে ইসলাম ধর্মকে গালি দিয়ে সেকুলারিজম চর্চা করে। সেই খানে ইসলামপন্থীদের দ্বারা নির্যাতিত হিন্দু পোগোতিচিল একটু ইসলামের সমালোচনা করলে বিরাট অপরাধ হয়ে যায় যেন। ওদিকে হিন্দু ধর্ম নিয়ে মুখে যা আসে তাই বলে ইসলামপন্থীরা।
আমার পরিচিত এক হিন্দু ভদ্রলোক রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি আগে অত্যন্ত কার্টিয়াস ছিলেন। অথচ সেদিন দেখলাম রবীন্দ্র আলোচনায়; হুমায়ূন আহমেদকে গালাগাল করছেন। এর মানে আওয়ামী লীগের নিম্নমানের সংস্কৃতিমামাদের সঙ্গে থেকে থেকে অশালীন হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ওয়াহিদুল হকের কথা শুনতাম। সেছিলো অনুপম শিল্প আলোচনা। আর এই রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ যেন একজন শূদ্র প্রজার চোখে দেখছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের পুষ্পার্ঘ্য না হয়ে এ আলোচনা হয়ে দাঁড়ালো, প্রজার তেলাঞ্জলি জমিদারের প্রতি। হিন্দু ব্র্যান্ডিং-এ মিডিওকার হিন্দুকে বুদ্ধিজীবী বানিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লেভেলের উত্তরাধিকার হিসেবে অশিষ্ট ধরেন্দ্রনাথ দেখছি যেন আমরা।
অথচ এই বাংলাদেশের প্রত্যন্তে সনাতনধর্মীদের মনীষার খবর আমি জানি। সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলা-থিয়েটারের হীরকখণ্ড পড়ে আছে অনাদরে; শুধু হিন্দু বলে। আর শো বিজে মুসলমান বলে ফ্যাশান প্যারেড করছে হালিছালি।
পিকে গ্রেফতারের পর ফেসবুকে একটি পোস্টারে হিন্দুদের হত্যা-দুর্নীতির রাক্ষস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। অথচ যেসব মুসলমান রাক্ষস লাখো কোটি টাকা লুটপাট করেছে, হত্যা-ধর্ষণের রিরংসায় পাকিস্তানি মুসলমান খুনে সেনার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে; তাদের ব্যাপারে স্পিকটি নট। প্রতিবাদের আসরেও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধত্ব সভ্যতার বিপ্রতীপ ঘৃণার চর্চা। ঘৃণার কারখানা থেকে কোনদিনই কোন সভ্য জনপদ গড়ে ওঠেনি।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর ইন চীফ, ই সাউথ এশিয়া