অনেকদিন পর মানুষের কোলাহল শুনে জেগে ওঠেন নজরুল। দুটি তরুণ এক দোতরা বাদককে বোঝাচ্ছে যে, ইসলামে বাদ্যযন্ত্র হারাম।
কবি বিস্মিত হন। খোদা তার পয়গম্বর দাউদকে সংগীত সৃষ্টির অপার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই ছেলেগুলোর নিশ্চয়ই তা জানা নাই; দেড় ইটের টিকটকার মোল্লা সেজে সংগীতের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে।
টিকটকার মোল্লা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দোতরা বাদকের হাতে দিয়ে বলছে, আর দোতারা বাজাইয়া গুণাহের ভাগী হইয়েন না চাচা। দীনের পথে আসুন।
নজরুল টিকটকার মোল্লাটিকে আপাদমস্তক দেখেন। আধুনিক পোষাক পরেছে; শুধু গুম্ফহীন ফুরফুরে হোচি মিন দাড়িতে ইসলামের সিগনেচার রেখেছে।
টিকটকার মোল্লা চলে গেলে; নজরুল একটু চা চপ সিঙ্গাড়া খেতে টিএসসির দিকে ধাবমান হন। হঠাত হারেরেরেরে করে তেড়ে আসে একটি তরুণী; হাতে তার বাঁশ।
নজরুল জিজ্ঞেস করে, কী হে খুকী এটা কী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঁশবিদ্যালয় হয়ে গেলো!
মেয়েটি বিক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ঐ যে জুয়েল, তার কী সাহস জানেন। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে নিয়ে বাজে কথা বলছে; জুয়েলকে প্রতিরোধ করবো; কত বড় সাহস! আমাদের নয়নের মণিকে তুমি বলেছে! বেয়াদ্দব ব্যাটা জুয়েল; তাকে আর টিএচ্চিতে যেন না দেখি।
নজরুল বলেন, ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য দরকার। তোমরা বাঁশ হাতে ঘোরাঘুরি করলে; বই-খাতা-কলমের ধূলো পড়ে যাবে যে, মনে রেখো,
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মেয়েটি তেলেবেগুনে জ্বলে বলে, ঐ বুইড়া ব্যাডা তুইও কী ছাত্রদল করস!
নজরুলের মনে পড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর আগে এক মায়াবতী মেয়েকে ভালো লেগেছিলো তার। গণিতশাস্ত্রের মেধাবী ছাত্রী ছিলো সে। কি মধুর ছিলো তার কন্ঠ; কী যে হৃদি সরসিজ, প্রেম উদ্দাম ধন্যি সে মেয়ে।
নজরুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কান্দাকাটি ভবনে। এখানে কে ছাত্রদল কে ছাত্রলীগ; তার কেপি টেস্ট করা হয়। একটা বড় কক্ষে টেবিলের ওপর বসে কাঁঠালপাতা শুকছেন কজন সভ্য।
নজরুলের সামনে কাঁঠালপাতা ঝোলায় এক কালো মুষকো মতো লোক; চোখের নীচে ঘিনঘিনে কালি।
এক ব্রিগেডিয়ার টেবিলে কিল দিয়ে বলে, কী নাম হে ছাত্রদল! এতো বড় সাহস; অই তর নাম কী!
–কাজী নজরুল ইসলাম।
কী করস!
-কবি; আমি কবিতা লিখি। গীতিকবিতা লিখি। গল্পও লিখি।
–উঁহ কবি আইছে আমার। আগে ক পদ্মা সেতুতে তুই খুশি না অখুশি!
–পদ্মা সেতু কী, কোথায়!
–অই তুই পাকিস্তান থিকা আসছস নাকি; পদ্মা সেতুর নাম শোনস নাই।
টেবিলের চারপাশের সহমত সভ্যেরা পাকিস্তান পাকিস্তান রব তোলে। এক পোগোতিচিল দাদা ইউরেকা ইউরেকা বলে নেত্য করতে থাকে।
কালো মুষকো লোকটি আবার কাঁঠালপাতা দোলায় নজরুলের নাকের কাছে।
ব্রিগেডিয়ারের কানের কাছে একজন ফিসফিস করে কিছু বলে। ব্রিগেডিয়ার জিভ কেটে বলে, আগে কইবা না মিয়া।
পোগোতিচিলদা তখন নজরুলের কাছে হাত জোড় করে বলে, আমি আপনার লেখা শ্যামা সংগীতের ভক্ত।
কালো মুষকো লোকটা তবু ঠিক কনভিন্সড নয়, নজরুল হইছে তো কী হইছে! অই মিয়া পদ্মা সেতু নিয়া একটা কবিতা লিখে দিয়ে যান।
নজরুল বলেন, ভুলি কেমনে,
আজো যে মনে বেদনা সনে রহিলো আঁকা,
আজো সজনী দিন রজনী সেদিনও গুনি সবই যে ফাঁকা
আগে মন করলে চুরি মর্মে শেষে হানলে ছুরি
এতো শঠতা এতো যে ব্যাথা তবু যেন তা মধুতে মাখা।
ভুলি কেমনে।
নজরুল কান্দাকাটি ভবন থেকে বেরিয়ে এলে, এক লোক গাড়িতে তুলে নিয়ে বলে, চলুন এবার হাওয়া ভবনে চলুন।
সভাকক্ষে চেয়ার আলো করে বসে, লালু-ভুল-দুলু। আসুন আসুন বলে বুকে জড়িয়ে ধরে গরমের সময় চাদর পরা চশমা পরা এক লোক। সে কাঁচু মাচু করে বলে, আপনার ছাত্রদল কবিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
টিকটকার মোল্লা এসে নজরুলের হাত দুটি ধরে বলে, আপনার ইসলামী গানের বড় ভক্ত। আপনি আমাদের মুসলিম উম্মাহ’র গর্ব।
নজরুল ধমক দিয়ে বলেন, ধর্ম দিয়ে দেশটাকে ভাগ করে, মানুষ ভাগ করার পর এবার নজরুলকেও ভাগ করতে এসেছো নাকি! কেন, আমার শ্যামা সংগীত শোনোনি! কান্দাকাটি ভবনের এক সহমত পুরুতও দেখলাম, শুধু শ্যামা সংগীতের ভক্ত। তোমরা ধর্মের নৈতিকতা চর্চা করলে না হে; শুধু দেশ ভাগ, মানুষ ভাগ, কবি সাহিত্যিক ভাগ করলে ধর্ম দিয়ে।
টিকটকার মোল্লা কাঁচুমাচু করে বলে, ভাগ তো আছেই; এইদেশে যেভাবে রবীন্দ্র জন্মদিন পালন হয়, সেভাবে কী আপনার জন্মদিন পালন হয়!
–আমার জন্মদিন পালন নিয়ে তুমি এতো চিন্তিত কেন। আমি তো ঐ এলাকার পাশেই ঘুমাই; যেই রকম উগ্র পোগোতিচিল দেখি সেখানে; ওরা যার জন্মদিন পালন করবেন, তিনিই জনপ্রিয়তা হারাবেন। তোমরা ধর্মচিলেরা যেমন আমার জন্মদিন পালন করে আমার জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছো। আমি গুরুদেবকে নিয়ে চিন্তিত। তোমরা এদেশের ধর্মচিল আর পোগোতিচিলগুলো এতো উগ্র যে; তোমাদের জন্য টেন্ডারের চিৎকার, মাছের বাজারের চিৎকার মানানসই। সাহিত্য আলোচনা তোমাদের কম্ম নয়। আমায় তোমরা “মসজিদের পাশে ‘রেখে’ এসো ভাই, যেন রোজ হাসরে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।”