ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানে আমি দু’বছর চাকরী করেছিলাম, নব্বই দশকের শেষের দিকে। তখন চাকরী করা এবং ছাড়ার একটা প্রবণতা ছিল আমার। গণস্বাস্থ্যের প্রেস ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান শফিক খান (জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঘনিষ্ট বন্ধু)-এর সাথে প্রথম পরিচয় ও কথা হওয়ার পরই তিনি জয়েন করতে বললেন।
আমি পরদিনই ঢাকা থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নবীনগর চলে গেলাম। স্মৃতিসৌধের পেছনে এক অজ গাঁয়ে বিদ্যুৎ-গ্যাসহীন কুঁড়েঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করলাম। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার আগেই কেরোসিন ষ্টোভ জ্বেলে রান্না করি, হারিকেনের আলোয় কিছু খেয়ে কিছু সকালের জন্য রেখে আটটা-নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি, আর রাতে সেই খাবারের লোভে দরজার ফাঁক গলিয়ে ঢুকে পড়া চিকা উঠে-উঠে তাড়াই! আবার পরদিন সকালে রাতের খাবার ফেলে দিয়ে না-খেয়েই অফিসে দৌড়াই।
.
২.
একজন ব্যক্তির সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কাজ করা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরী করা—এ দুয়ের অভিজ্ঞতা দুরকম হবে। কিন্তু এর মধ্যে কতখানি ফারাক হবে তা চাকরী না করলে পর্যন্ত বোঝা সম্ভব নয়। সে-কারণে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা পর্বে তাঁর সাথে যারা সাংগঠনিক কাজ করেছেন তারা তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক মেজাজ ততোটা বুঝতে পারবেন না। সৌভাগ্যবশত আমার তাঁর সাথে কম-বেশী দু’ধরণের কাজেরই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমার কাছে মনে হয়েছে সামাজিক বা রাজনৈতিক যেটাই হোক, সাংগঠনিক তৎপরতায় তিনি ছিলেন সুপারম্যান। পরিস্থিতি যতো জটিল আর ভয়াবহই হোক, তাৎক্ষণিকতার প্রয়োজনে মানুষের ভাবাভাবির বাইরে গিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মাষ্টার। সমাজ-রাষ্ট্র-সরকার এবং স্থান-কাল-পাত্র ও প্রয়োজন বুঝে এক এবং একটাই লক্ষ্য নির্ধারণ করে যেই মুহূর্তিক সাংগঠনিক তৎপরতার উদ্যোগ-আয়োজন তিনি গ্রহণ করেন তার সাথে চলার মতো মানুষ আমি দেখি না। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যক্তি, এবং এক ব্যক্তি।
আসলে সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য অতোখানি নয়, আরো একটু মাঝারো মানের মনীষা লাগে; আর একটু চারপাশ ও পরিস্থিতির সাথে মানানসই হওয়া লাগে। তাই ব্র্যাক-গ্রামীণ বা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো যারা, তারাই এদেশে শেষ পর্যন্ত সফল, কিংবা দুনিয়া জুড়েই। তাই তিনি এক ব্যর্থ মানুষ—মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের মতোই—যাঁর শূন্যতা পূরণ হবে না।
.
৩.
তাঁর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এক বাক্যে যদি বলতে হয়, বলতে হবে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সামন্তীয় মূল্যবোধ তাড়িত, এবং তিনি সেখানে একমাত্র সামন্ত প্রভু। পুরো প্রতিষ্ঠানের পরতে পরতে তাঁর একচ্ছত্র দাপট। তিনি বড়োভাই, কিন্তু শুধু বড়ো কাজটিই করেন না, দেখেন একেবারে চাকর-বাকর-মেথর পর্যন্ত কি করছে না-করছে সব। আর এসব তদারকির পর্যায়ে তাঁর বড়ো ধমকটা শুধু মেজোভাইকেই দেন না, দেন একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত—প্রয়োজনে শরীরসহ হাজির হয়ে, শারীরিকভাবেও।
ফলে মেজোভাই-সেজোভাই-ছোটভাইদের ধমকের কার্যকারীতা সেভাবে থাকে না, আর থাকে না বলেই তাদের ধমকের আওয়াজিক তীব্রতা বাড়াতে হয়, এলোমেলো ধমকের প্রবাহ ছোটাতে হয়। এমন অসুস্থ আবহাওয়ায় ব্যক্তিক পর্যায়ে সম্পর্কযুক্ত না হলে কোনো ব্যক্তিত্ববান মানুষ বেশীদিন কাজ করতে পারে না। ফলে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা আর আওয়াজে চারপাশ ভরে থাকে। আর প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস বা সেবা প্রাপ্তির ধরণধারণ বা মানটাও নানা সম্পর্কসূত্রের সাথে গ্রথিত হয়ে যায়।
.
৪.
তিনি গতকাল তাঁর যুদ্ধজীবন চিরদিনের মতো শেষ করেছেন। অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনা লেখা যায়। কিন্তু লিখে কি হবে? পাকিস্তানী হায়েনাদের সাথে যুদ্ধ জয়ের পরও সেই বাহাত্তর সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত তাঁকে দেশে-বিদেশে বহু কিছিমের হায়েনার সাথে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে, গোঁয়ারের মতো। নিঃশ্বাস তিনি ফেলতে পারেননি কখনো।
সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত হতে পারতো, যদি তাকে পরিচালিত হতে দেওয়া হতো, তবে তিনি শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে পারতেন সেটিই নয়, গোটা দুনিয়ার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই পাল্টে দেওয়ার মতো হিম্মত দেখাতে পারতেন।
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর! তাঁর আত্মার চির শান্তি কামনা।
.
[রচনাকাল: ১২ই এপ্রিল ২০২৩]
লেখক রাখাল রাহা: এডিটর ইন চীফ, সম্পাদনা