ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজন অধ্যাপককে চাকুরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ঐ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি যে মতপ্রকাশ করেছেন তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায়, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা”। মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোর্শেদ হাসান খানের রচনাটি একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। তাঁর এই রচনায় প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে ভিন্নমত থাকার অধিকার যে কোনও ব্যক্তি বা স্ংগঠনের আছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারে কিনা সেটি একটি বিবেচ্য বিষয়। ওই পত্রিকায় এই নিবন্ধের বিরুদ্ধে ভিন্নমত সম্বলিত রচনা প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা সেটা আমার জানা নেই।
পরিহাসের বিষয় যে বিশ্ববিদ্যালয় যে আইনের ধারায় তাঁকে চাকুরিচ্যুত করেছে সেটি তৈরি হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন নিশ্চিত করতে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে। ঐ আদেশের ৫৬ ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তার রাজনীতি করার তথা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ঐ আইনে একজন শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত করার বিধানও আছে, তাতে বলা হয়েছে একজন শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত করা যাবে যদি তিনি নৈতিক স্খলনের (মোরাল টার্পিচ্যুড) কিংবা দায়িত্ব পালনে অপরাগতার (ইনএফিসিয়েন্সি) অভিযোগে অভিযুক্ত হন (ধারা ৫৬, উপধারা ৩)। মো মোর্শেদ হাসান খান এই দুই অভিযোগের কোনটাতেই অভিযুক্ত হননি। ফলে এই চাকুরিচ্যুতি মতপ্রকাশের জন্যেই সেটা স্পষ্ট। এটি আইনের ‘লেটার’ এবং ‘স্পিরিট’ দুইয়ের বিপরীত।
একই সঙ্গে এটাও লক্ষ্যনীয় যে, এই চাকুরিচ্যুতির বিরুদ্ধে তাঁর যে সব সহকর্মী কথা বলছেন যে তারাও নিবন্ধে প্রকাশিত অধ্যাপক খানের বক্তব্যকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে বর্ণনা করছেন; বলছেন, ‘নিবন্ধটি প্রত্যাহার, দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও’ কেন তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কোনও মতের ‘কাঙ্খিত- অনাকাঙ্ক্ষিত’ পার্থক্য কিভাবে নির্নীত হয়, কারা ঠিক করেন? এই প্রশ্ন তোলা খুব জরুরি। শিক্ষকরা তা করছেন না সেটা উদ্বেগজনক এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে কম বলে মনে হয়না।
একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মতপ্রকাশের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় আইন একজন শিক্ষককে যতটুকু অধিকার দিয়েছে তা কেড়ে নিতে উদ্যত, অন্যদিকে এমনকি তাঁর সহকর্মীরা প্রকারান্তরে বলছেন যে একটা সীমারেখা তাঁরা মানতে রাজি আছেন। এই দুইয়ের কোনোটাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক ভিত্তির এবং ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিচিতি থাকার কথা তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
জনগণের অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এই আচরণ একদিকে দেশে মতপ্রকাশের অবস্থা কি সেটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অন্যদিকে নাগরিকের করনীয় কি সেটাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
– ড. আলী রীয়াজ, ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি যুক্তরাষ্ট্র।