সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : রাজধানী ঢাকার পল্লবীর বাসিন্দা গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনি (৩৩) হত্যা মামলায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও একই সঙ্গে পুলিশের দুই সোর্সকে দেয়া হয়েছে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
বুধবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েস এ রায় ঘোষণা করেন। ২০১৩ সালে পাস হওয়া নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে দেশে এ প্রথম কোনো মামলার রায় হল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান, এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও এএসআই কামরুজ্জামান। আর ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত দুই সোর্স হলেন- সুমন ও রাসেল। রায় ঘোষণার সময় আসামি জাহিদুর রহমান, রাশেদুল ইসলাম ও সুমন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি দুই আসামি কামরুজ্জামান ও রাসেল পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রায়ে যাবজ্জীবনের পাশাপাশি ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যেকের এক লাখ টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই তিন আসামির প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়া হয়। রায়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে নিহতের পরিবারকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া দুই সোর্সকে কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৩ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, অবশেষে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মামলাটির নিষ্পত্তি হচ্ছে। পুলিশ হেফাজতে কাউকে নির্যাতন করলে আল্লাহ আর কয়েদি নিজে ছাড়া আর কেউ দেখতে পান না। কিন্তু এ মামলার আরেক ভিকটিম নিহত জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি সৌভাগ্যক্রম বা দুর্ভাগ্যক্রমে হোক তিনি সেটা দেখতে পেয়েছেন। আসামিরা একটা জঘন্য অবস্থার সৃষ্টি করেছিল।
এসআই জাহিদ ও অপর দুই এএসআই- রাশেদুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান মিন্টু সরাসরি নির্যাতনে অংশ নেন। ভিকটিম জনি পানি পান করতে চাইলেও তাকে তা দেয়া হয়নি। উল্টো জাহিদ তার মুখে থুতু মারেন। আসামিরা শুধু আইনের বরখেলাপই নন, মানবাধিকারও লঙ্ঘন করেছেন। হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের কোনো মামলায় দেশে এটাই প্রথম রায়। আর রায়ে তিন পুলিশ সদস্যকে সর্বোচ্চ শাস্তিই (এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) দেয়া হয়েছে।
এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহতের পরিবার। জানতে চাইলে মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি সাংবাতিকদের বলেন, অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত রায় পেয়েছি। আদালতসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আশা করছি উচ্চ আদালতেও যেন এ রায় বহাল থাকে। নিহতের মা খুরশিদা বেগমও রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, তিন পুলিশের আইন অনুসারে সর্বোচ্চ সাজাই হয়েছে। এ রায়ের মাধ্যমে একটা মেসেজ যাবে, অপরাধ করলে যেই হোক না কেন তাকে সাজা পেতে হবে।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, অসামঞ্জস্যপূর্ণ রায় হয়েছে। রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম বলেন, এ রায়ে আমরা অসন্তুষ্ট। আমরা আপিল করব। তবে আগে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়ে পরে আপিল করতে হবে।
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইরানি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. সাদেকের ছেলে মো. বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স সুমন মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এ সময় সেখানে থাকা ইশতিয়াক হোসেন জনি ও তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে সুমনের সঙ্গে দুই ভাইয়ের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে সুমনের ফোন পেয়ে পুলিশ এসে দুই ভাইকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে দুই ভাইকে নির্যাতন করা হয়।
এ সময় জনির অবস্থা খারাপ হলে তাকে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে জনির ভাই রকি পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় তৎকালীন পল্লবী থানার এসআই জাহিদুর রহমান, আবদুল বাতেন, রাশেদ, শোভন কুমার সাহা ও কনস্টেবল নজরুল, সোর্স সুমন ও রাসেলকে। আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন।
২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঢাকা মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত এবং পাঁচজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। তদন্তে এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামানকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল এসআই জাহিদসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। এই মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। ২৪ আগস্ট উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে একই আদালত ৯ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে।