আজ আমাদের দেশে কন্যা দিবস। সেই ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি কন্যারা বাবাপ্রিয় হয়। আমিও তাই ছিলাম। আমার প্রয়াত বাবার গায়ের গন্ধ আজও আমি টের পাই। আমার স্বাধীনচেতা আচরণ নিয়ে আমার বাবার কোনো ক্ষোভ ছিলো না। তাছাড়া ইতিহাসে নারীর ভুমিকা নিয়ে তিনি পড়াশুনা করতেন। তাই তিনি আমাকে নিয়ে কোনো ধরণের আত্মগ্লানিতে ভুগতেন না। কিন্তু তা এই পর্যন্তই। আমার বাবার মুখে আমি কোনোদিন শুনিনি সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার থাকা উচিত। বা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকাটাই উচিত। অথচ আমার বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মানুষ। এটাকেই মনে হয় বলে যুগের সীমা। শুধু ইংরেজি জানা উচ্চশিক্ষিত হলেই সবকিছুতে পার পাওয়া যায় না।
আমার বাবাকে টেনে নিয়ে আসলাম অন্য বাবাদের কাছে আজ কিছু নিবেদন করবো বলে। এই সেদিনও কন্যা সন্তান জন্মানো ছিলো দুর্ভাগ্যের প্রতিক। বা নারী সমাজ নিয়ে অশোভন উক্তির কোনো সীমা সেদিনও ছিলো না-আজও নেই। “ভাগ্যবানের মরে বৌ, অভাগার মরে গরু” এধরনের বচন খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। বীরত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে পরাজিত পক্ষকে ছুড়ে দেওয়া আক্রমন, “ঘরে গিয়ে হাতে হাতে চুড়ি পর্।” অথচ আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেই সাহসের জননী ‘জোয়ান অফ আর্ক’ সাহসের পরীক্ষায় শত নম্বর পেয়ে ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যাইহোক ফিরে আসি বর্তমানে। বর্তমানে আমাদের সমাজে দুটো বিষয় নিত্যদিনের বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রাজকন্যা বাক্য বিলাসে যেন আমরা ভেসে চলেছি। আজকাল কন্যা সন্তান মানেই রাজকন্য। বলে রাখা ভাল,এই বাক্যাপোহার আমাদের মেয়েদের জন্য প্রকৃত অভিশাপই। কারণ কোনো রাজা মানুষ এবং মনুষ্যত্বের জন্য পথে নেমে এসেছেন তার কোনো নজিরই নেই। উল্টো সমাজে নারীদের প্রতি সেইসব দুশ্চরিত্র রাজারা লাঞ্ছনার ষ্টীম রোলার চালাতো। বরং নিপীড়িত প্রজারাই যুগে যুগে অন্যায় প্রতিরোধ ক’রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন,নারীদের সামান্য যতোটুকু সম্মান তারাই দিয়েছে। তাই আজ যে কন্যাদের রাজকন্য অভিধায় ভুসিত করা হচ্ছে তা আমাদের জন্য একেবারেই সুখকর বিষয় নয়। তাছাড়া চরিত্রহীন অত্যাচারী রাজার কন্যা হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরবও নেই। যুদ্ধের ময়দানে একটা বাক্য আছে চালু আছে,বন্দুকের নলটা একটু ঘুরিয়ে ধরা। ঠিক সেরকমই এখনকার বাবারা যদি একটু কষ্ট ক’রে কন্যাদের দিকে স্নেহের ধারাটা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে বলতেন রাজ্যহীন রাজকন্যা নয়,আমার কন্যা হয়ে উঠুক একজন প্রকৃত মানুষ। যে মানুষ যেকোনো অপশক্তির চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে,’আমি একজন মানুষ’। আর রাজ্যহীন যতো বাবা-রাজকন্যা বুকে নিয়ে আহ্লাদের ঘোরে তৃপ্তির ঘুমে অচেতন প্রায়,তারা যদি ফাঁকা বুলিগুলো না আওড়ে রাজাগ্রাসন এবং তার ধর্ষক বাহিনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসতেন,সেটাই হোতো কন্যাদের প্রতি প্রকৃত দায়িত্ব পালন। এবং কন্যা সন্তানদের প্রতি নির্ভেজাল ভালবাসার প্রকাশ। রাজকন্যা বানিয়ে রাজপুত্রদের ধর্ষণের শিকারে পরিণত হতে আমরা চাইনা। আমাদের বাবারাও সেই পথে কেন হাঁটবেন। আমরা মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। আমাদের দেশের কন্যাদিবসে আজ সকল বাবাদের কাছে সবিনয় নিবেদন,হয় আমাদের কন্যাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করুন। না হয় কন্যা সন্তানদের পৃথিবীতে আনারই কোনো দরকার নেই।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী