আমার জেলজীবন শুরু হোলো।
আমাকে রাতে কারাগারে প্রবেশ করানোর সময়ই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো,পরদিন সকালেই গোয়েন্দা বিভাগের লোক আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবে। এবং সে জিজ্ঞাসাবাদ জেলগেটেই হবে। পুলিশ কতৃপক্ষ অফিসিয়ালি এই খবর রাতেই জেল কতৃপক্ষকে জানিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার তখন কিছু শুনবার মন এবং শরীর কোনোটাই ঠিক ছিলো না। তাই হয়তো খেয়াল করিনি। বা এমনও হতে পারে আমাকে আড়াল ক’রে পুলিশ কতৃপক্ষ এটা জানিয়ে গেছে। জেলে যখন আমি এবং সালেহা আপা মুখোমুখি বসেছি,তখনই জিজ্ঞাসাবাদের বিষয় উঠে এলো। বন্দীদের সঙ্গে রাতে একজন বা দরকার হলে একাধিক জমাদ্দার্নি ( মহিলা জেল পুলিশ) ডিউটিতে থাকেন। সেই জমাদ্দার্নী এসে জিজ্ঞাসাবাদের খবরটা আমাকে নিশ্চিত ক’রে গেলেন। তখন আমি আবার গত ৩০/৪০ ঘণ্টার দিকে ফিরে গেলাম। ডুবে গেলাম সকালের জিজ্ঞাসাবাদ এবং গত ৩০/৪০ ঘন্টার আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভিতরে। কাল সকাল থেকেই শুরু হবে আমার আনুষ্ঠানিক জেরাপর্ব। আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা,আমার জন্য এই জেরা কতোটা নির্মম হতে পারে। আজ সন্ধ্যার দিকে এস পি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের কিছু নমুনা আমি বুঝতে পেরেছি। কিছুক্ষণ আগের আন্তরিক মানুষটা হঠাৎ ক’রেই কীভাবে অচেনা হয়ে ওঠে, আমি তা কয়েক ঘন্টা আগেই দেখেছি। জিজ্ঞাসাবাদের খবরে স্বাভাবিক কারণেই মনটা তাই বিষিয়ে উঠলো। সালেহা আপার সঙ্গে অন্য কোনো কথা বলবার ইচ্ছাটা নষ্ট হয়ে গেলো। কিছু ব্যক্তিগত আনন্দ বেদনার কথা বলবার যে আগ্রহ নিয়ে আমরা দু’জন মুখোমুখি বসেছিলাম,এক নিমিষেই তা হারিয়ে গেলো। মায়ের কাছে রেখে আসা দুই মাস বয়সের সন্তানকে নিয়ে ভাববার সুযোগও এরা আমাকে দিলো না। আমি আমার মাকে জানাতে পারলাম না এখন আমি কোথায় আছি। আমার মা এখনও জানেন না,আমি এখন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। উল্লেখ করা প্রয়োজন জেল কতৃপক্ষ আমাদের দুজনকে ( আমি এবং সালেহা আপা ) একসঙ্গে থাকবার ব্যবস্থা করেছিলো। সালেহা আপা খানিকটা জোর ক’রে আমাকে স্বাভাবিক কথায় ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের প্রসঙ্গের বাইরে আমরা দু’জন আর বেরোতে পারিনি। বেশ কিছুদিন পর দু’জনের দেখা হোলো। সেই কারণেও জমে ছিলো আমাদের অনেক কথা। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো খুবই নির্মম। আমাদের সমস্ত আবেগ ছাপিয়ে সামনে চলে এলো এক মহা পরীক্ষা। আমাকে কী জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তা আমাদের দুজনেরই জানা ছিলো। গোয়েন্দা পুলিশ মূলত দুটো বিষয় জানতে চাইবে। অস্ত্রের সন্ধান তারা জানতে চাইবে। আর জানতে চাইবে তৎকালীন জাসদ নেতা এবং গণবাহিনীর জেলা প্রধান জনাব গোলাম মোস্তফার কথা। এটা ভেবে বের করতে আমাদের বেশি চিন্তা করতে হয়নি। আমার মুখ দিয়ে এ দুটো তথ্য বের করতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা যে করবে,এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের সংবাদে আমরা এতোটুকু আশ্বস্ত হতে পেরেছিলাম, অন্তত শারীরিকভাবে আমাকে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হবে না। কিন্তু তারপরেও আশংকা একটা থেকেই গেলো। গোয়েন্দা বিভাগ আমার জেলগেটের স্টেটমেন্টে সন্তষ্ট হতে না পারলে,বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা রাখে। এবং সে সিদ্ধান্ত তারা নিতেও পারে। তখন পরিস্থিতি হবে অনেক ভয়াবহ। এতো সব এলোমেলো ভাবনার ভিতরে আমরা দু’জন শুধু প্রকৃত ভাবতে পারলাম,একবার কোনো কথা সেখানে বলে তা ভুলে যাওয়া চলবে না। এই যে ভুলে যাওয়া চলবেনা,জিজ্ঞাসাবাদ মোকাবেলা করবার এ এক মোক্ষম অস্ত্র। কেন মোক্ষম অস্ত্র,আমি পরে তা বলবো। কিন্তু এই যে আগের বলা কথা ভুলে যাওয়া যাবেনা, এটা অত সহজ কাজ যে নয়,তা আমার পাঠককুল নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। মানসিক ঐ অবস্থার মধ্যে আগের কথা মনে রাখা ছিলো আমার জন্য রীতিমতো পুলসেরাত পার হওয়ার মতো। একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে,আরও কিছু টুকিটাকি কথাবার্তা সেরে,সালেহা আপার কোল ঘেষে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঐ রকম শান্তিময় একটা ঘুম আমার খুব দরকার ছিলো সে রাতে। আগের সারাদিন এবং মাঝরাত পর্যন্ত যে ধকল আমার উপর দিয়ে গেছে,তা ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে সালেহা আপার তত্ত্বাবধানে কিছু খেয়ে নিলাম। কিন্তু সালেহা আপার কালকের সেই উচ্ছল চেহারা আমি আজ আর দেখলাম না। আমার বুঝতে অসুবিধা হোলো না,তিনি আমাকে নিয়ে একটা আতংকের মধ্যে আছেন। সম্ভবত আমার বয়সটাও তাঁর চিন্তার কারণ ছিলো। তখন ১৮ বছরের মেয়ে আমি। তিনি হয়তো ভাবছিলেন বিপদ মোকাবেলা করবার বুদ্ধি এই অল্প বয়সে আমি আয়ত্ব করতে পেরেছি কিনা। আমি খেয়ে নেবার পর থেকেই আপা আমার হাতটা শক্ত ক’রে ধরে ছিলেন। আর আমি খাওয়ার পর থেকেই মনে মনে জিজ্ঞাসাবাদের মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। আপাও সেই তখন থেকেই যে আমার হাতটা ধরেছিলেন,সে হাত ছেড়েছিলেন,যখন আমি জেল গেটের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম তখন। সালেহা আপার এই যে হাত ধরে রাখা,তা দিয়ে আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম,আমি এক মহা বিপদে পা রাখতে চলেছি। আমাকে নিতে মহিলা জেল পুলিশ এবং জেল সুবেদার সাহেব এলেন। যেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিতে এসেছেন তারা। তাদের ভাব গম্ভীর চেহারা এরকম বার্তাই দিচ্ছিল আমাকে। আমার দীর্ঘ জেল জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি,কারা কতৃপক্ষ বন্দীদের বিপদ সাধারণত দেখতে চান না। বিশেষ ক’রে ফাঁসি বা আমার মতো পরিস্থিতির সামনে কাওকে পড়তে দেখলে তারা বেশ কষ্ট পায়। আমাকে নিতে আসা সুবেদার সাহেব এবং মহিলা জেল পুলিশ সম্ভবত আমাকে নিয়ে সে রকমেরই কষ্টে ছিলেন। অতঃপর আমি শান্ত মন নিয়ে তাদের সঙ্গে রওনা দিলাম এক দানবীয় শক্তির মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য। যাওয়ার সময় একবার আমি সালেহা আপার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। তখন সে চোখে আমি আর ভয় দেখিনি। আমার তখন মনে হোলো অনেক প্রত্যাসা নিয়ে তিনি আমাকে বিদায় দিলেন। হয়তো প্রত্যাসা এটাই,আমার হাতে কিছুতেই দল দলের নেতা কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সকাল ১০ টা বাজবার কিছু আগে আমাকে নিয়ে যাওয়া হোলো জেল গেটে। প্রথমে আমাকে বসানো হোলো জেলর সাহেবের রুমে। তিনি তখন রুমে ছিলেন না। অল্প কিছু পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হোলো জেল সুপারের রুমে। চারিদিকে ভারি পর্দা দিয়ে ঘেরা রুমটা-অন্য রুম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। সেখানে বসে একটু জোরে কথা বললে অন্যদের কানে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। দেখলাম সেখানে বসে আছেন কালকের সেই রাশভারী গোয়েন্দা অফিসার দেলোয়ার হোসেন। আমার সঙ্গে কৃত্তিম আন্তরিকতা বাড়াবার জন্য হয়তো তিনি তার নামের পরিচয় আমাকে দিয়েছিলেন আগের দিন। আগের রাতে,পুলিশ সুপারের রুমে একবার-তাঁর সঙ্গে আমি মুখোমুখি বসেছিলাম। তবে কাল তার সঙ্গে কথা এগোনোর মতো অবস্থা আমার ছিলো না। তারা অবশ্য কথা বলানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো বাড়াবাড়ি করেনি। সেখানে আমি তার একটা ভদ্রোচিত শান্ত চেহারা দেখেছিলাম,যার লেশমাত্র আজ দেখলাম না। আজ মনে হোলো তিনি দাপটের সঙ্গে পায়ের বুট ঠুকে কথা বলতে এসেছেন-তিনি আজ আমাকে ভয় দেখাতে চান। যশোর জেলগেটে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার জিজ্ঞাসাবাদের সেই ভয়াবহ সময়গুলো আমি আজও মনে রেখেছি। আমাকে আবারও বসতে হোলো গোয়েন্দা অফিসার দেলোয়ার হোসেনের মুখোমুখি। এবং তার এক ভিন্ন চেহারার সামনে। একটা টেবিলের একদিকে তিনি-উল্টো দিকে আমি। সম্ভবত আমরা দুজনই ছিলাম বদ্ধপরিকর,নিজের নিজের জায়গায় অনড় থাকবার জন্য। একজন জানতে চায় অনেক কিছু,আরেক জনের কিছুই বলবার উপায় নেই। কিছু না বলবার উপায়হীনতার প্রাচীর ডিঙ্গানোর কোনো ক্ষমতাই আমার ছিলো না। অতটুকু বয়সেই আমি বুঝেছিলাম,আমি তো মানুষ।১৯৭৪ সালে ৯ই মার্চ দুটো হত্যা মামলার বিচারের দাবিতে একটা মিছিলে অংশ নেওয়ার অপরাধে আমার মাথার উপর রাজ পরোয়ানা জারি করা হয়েছিলো। আমি সেই থেকে আছি মানুষের ভিড়ে,মানুষের আশ্রয় প্রশ্রয়ে। এই মানুষই আমাকে রক্ষা করেছে এতোদিন। আজ আমি গর্তে পড়েছি বলে,আমার সেই মানুষদের জন্য তো আর একটা গর্ত আমি খুঁড়তে পারিনে। তাই আমার কোনো উপায়ই ছিলো না গোয়েন্দা পুলিশের আব্দার পূরণ করবার। এবং ভয় পেলেও নয়। বলা যায় আমি ভয় পেয়েই বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বুঝেছিলাম, আমার ছোট্ট একটা বেসামাল শব্দেও এলোমেলো হয়ে যেতে পারে অনেক কিছু। বিপদের মুখে পড়তে পারে অনেকের জীবন। স্বাভাবিক ভাবেই তখন আমাকে নিতে হয়েছিলো যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি। তবে আমার জন্য তা ছিলো আত্মরক্ষার যুদ্ধ। দুপুরের খাবার খাওয়ার আগ পর্যন্ত চললো জেরা করবার নামে ভয়াবহ একটা মানসিক নির্যাতন। প্রধানত অস্ত্রকে কেন্দ্র করেই তার কথা বলার আগ্রহ বেশি ছিলো। ২য় জনাব গোলাম মোস্তফা। আমি কেন জানিনা বা কেন জানবো না,দেলোয়ার সাহেব এটা বুঝতে নারাজ। এই দুটো প্রশ্নের জবাব পেতে দুপুর পর্যন্ত চললো সাড়াশি আক্রমণ। দুপুরের খাবারের বিরতির পর আবার শুরু হোলো তা। দেলোয়ার সাহেব বললেন আজ পর্যন্ত তার সামনে কেউ মুখ খোলেনি এমন নজির নেই। তিনি যেন যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সত্যিই ভদ্রলোকের কথার সাঁড়াশী আক্রমন সামাল দিতে গেলে একটা বড় ধরণের প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপার থেকেই যায়। তার সামনে যেকোনো মুহূর্তে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারানোর আশংকা ছায়ার মতো আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি যেন কিছু ভেবে বলতে না পারি,তার জন্য কথার উপর কথা,দ্রুত এক কথা থেকে অন্য কথায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দেলোয়ার সাহেব। সঙ্গে কথার ঝাঁজ তো আছেই। হঠাৎ হঠাৎ আমি বিপদজনক ভাবে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। মনে হচ্ছিলো এক দৌড় দিয়ে আমি কোথাও চলে যাই। ছুটে কোথাও পালিয়ে যাই। তখন এই ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিলো-আমি মনে হয় হেরেই গেলাম। কঠিন এই পরিস্থিতি আর হয়তো সামাল দিতে পারলাম না। সশস্ত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকা অবস্থায়ই তো গ্রেফতার হয়েছি। সব জেনে শুনে ওরাই বা হাল ছাড়বে কেন। যার শরীরে এখনও বারুদের গন্ধ,যার চারপাশে এখনো অস্ত্রের ছায়া সেই আমি তাহেরা বেগম জলি রীতিমত ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি গোয়েন্দা পুলিশের জেরার মুখে। আমার জন্য ঐ মুহূর্তটা ছিলো খুবই কঠিন। তবে আমি কৌশল নিয়েছিলাম যত কম কথা বলা যায়,ততোই ভালো। এমনিতে আমি ভীষণ আড্ডাবাজ। গল্পে আনন্দে মেতে থাকা আমার স্বভাবজাত ব্যাপার। ভদ্রলোক যখন কথার বৃষ্টি ঝরাচ্ছিলেন,সেই আমি তখন একেবারেই মুখ বন্ধ রেখেছি। আমি তখন নতুন নতুন ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করছিলাম। আমিও মুখ বন্ধ রাখতে পারি! আমিও ভয় পেতে পারি! আমি দুই একবার ভদ্রলোকের মুখে মুখে তর্ক করবার সাহস দেখিয়েছিলাম। বলেছিলাম,আপনি একটা একটা ক’রে ধীরে ধীরে কথা না বললে,আমি কীভাবে জবাব দেবো? আমাকে তো কিছু বুঝতেই দিচ্ছেন না। এসব ক্ষেত্রে পালটা কিছু বলতে পারলে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিন্ত একটু থমকে যায়। আমি দেখলাম আমার তর্কে কিছুটা কাজ হোলো। মনে হোলো তিনি মুখের লাগাম কিছুটা টেনে ধরলেন। তিনি ভেবেছিলেন চার পাঁচটা প্রশ্ন এক সঙ্গে করলে আমি বেসামাল হয়ে একটা না একটা কথা তো বলবোই। কিন্তু তার কথা বলার এই পদ্ধতিই আমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছিলো। কারণ সেটাতে আমি তাকে অভিযুক্ত এবং পাল্টা বিব্রত করতে পারছিলাম। অত বিপদ এবং অত আক্রমণের মুখেও,আমার মনে আমার নেতা কর্মীদের মুখ ক্রমেই জীবন্ত হয়ে উঠছিলো। তখন এটুকু বুঝেছি,আমি তো আমার নিজের ভুলেই মরেছি। কিন্তু আমার দ্বারা আর কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারবে না। আমার কারণে আমার দলের নেতা কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে,এটা আমি মেনেই নিতে পারছিলাম না। আমার এতসব চিন্তা চলছে ঝানু গোয়েন্দা অফিসারের কথার বৃষ্টির মধ্যেই। আর শেষের দিকে আমি শুনছিলামও কম। কারণ দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি তখন আমার উপর চেপে বসেছিলো। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সেদিনের মতো আমার পক্ষেই গেলো। পরের দিন সকাল ১০ টার সময় আমাকে নিয়ে তিনি আবার বসবেন,এটা জানিয়ে সে দিনের মতো আমাকে রেহাই দিলেন জনাব দেলোয়ার হোসেন। ওদিকে একজন ডেপুটি জেলর আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এবং দেরি না ক’রে তিনি একজন মহিলা জেল পুলিশ দিয়ে আমাকে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন। আমি যেন হাওয়াই ভাসতে ভাসতে মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে ঢুকলাম। সেদিনের সে উচ্ছাসের কথা কোনোদিনই ভুলবার নয়। সালেহা আপাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,আমি পেরেছি আপা। আমাকে গোয়েন্দা ভদ্রলোক বাঁকাতে পারেনি। বললাম,হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিলো আমি মনে হয় হেরেই গেলাম। এই বুঝি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো অনেক কথা। কিন্তু না,যেন মরতে মরতে বেঁচে গেলাম আমি। সালেহা আপা কিছু না বলে আমাকে ধরে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলেন। তবে তাঁর মুখের ওপর একটা প্রশান্তির ছায়া তখন আমি দেখেছিলাম। আমি হঠাৎ উচ্ছাস দেখিয়ে আবার চুপ হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হোলো,কাল ১০টায় আবার শুরু হবে জেরার নামে অত্যাচার। হাতে সময় বেশি নেই। এখনই কালকের প্রস্তুতি নিতে হবে। অল্প কিছু খেয়ে আজকের জেরা পর্ব খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। যেন আমার পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। এদিকে ক্লান্তিও আমাকে অসাড় ক’রে দিচ্ছিলো। তখন বললাম আমি একটু বিশ্রাম নেবো। কাল ১০ টা থেকে তো আবার শুরু হবে জেরার অত্যাচার। এতক্ষনে সালেহা আপা কথা বললেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি আমার পরিচর্যা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বল্লেন,”কষ্ট হলেও এখন কোনো বিশ্রাম নয়। বরং চল্ এই অবসরে কিছু কাজের কথা সেরে নিই। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস।” আমি বাস্তবতা বুঝে মুখে কিছু না বলে,কিছুক্ষন দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে রাখলাম। এরপর শক্তি সঞ্চয় ক’রে উঠে দাঁড়ালাম। এবং সালেহা আপা আমার হাত ধরে ওয়ার্ডের রুমের বাইরে নিয়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে তিনি দাঁড়ালেন খোলা আকাশের নিচে। তখন আমার ভালোই লাগলো। উপরের দিকে মুখ তুলে দেখলাম খোলা আকাশ। ওয়ার্ডের মধ্যে খোলা জায়গায় তখন কয়েকজন বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছোটাছুটি করছিলো। ওদের দেখে কিছুক্ষনের জন্য মনে হয় আমি আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। এই সময় সালেহা আপা আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে বললেন চল্ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। আমি তখন আবার নিজেতে ফিরে এলাম। জেলখানার কিছু নিয়ম কানুন সম্পর্কে তিনি আমাকে ধারণা দিলেন। এ পর্যন্ত সে সব কথা শুনবার সময় আমার হয়নি। বেশ কয়েকজন সাধারণ বন্দীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিলো বাচ্চাগুলোর কাছে। আবারও দেখলাম ওরা দৌড় ঝাপ ক’রে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের এই বদ্ধ জায়গায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিলো। আমি বললাম,এতো ছোট বাচ্চারা এখানে কেন? আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না,ওরা কেন এই বন্দীশালায়। আপা বললেন,ওরা এসেছে ওদের মায়েদের সঙ্গে। ওদের মায়েরা যখন বন্দী হয়,তখন কেউ মায়ের পেটে ছিল। আবার কেউ ছিলো মায়ের কোলে। বাইরেও ঐ সব বাচ্চাদের দেখবার কেউ নেই। তাই ওরা মায়েদের সঙ্গেই বন্দী জীবন যাপন করছে। কিছুক্ষনের জন্য আমার সন্তানের মুখটা আমার সামনে ভেসে উঠলো। কিন্তু তা কিছুক্ষনের জন্যই। আমার এই ঘোর সংকট কালে আমার সন্তানের মুখটা সামান্য সময়ের জন্য ছায়া হয়ে দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেলো। আমার সন্তান যেন ঐ সংকটকালীন সময়ে আমাকে দয়া করলো। সে সময় সন্তানের পাশাপাশি আমার মায়ের কথাও মনে পড়লো। আমি যেন ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। তখন দেখলাম,আমার মায়ের বুকে পরম যত্নে ঘুমিয়ে আছে আমার মেয়েটা। এতো সব চিন্তা এবং কথার মধ্যে,আমরা আবার আমাদের কাজের কথায় ফিরে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি মনে করবার চেষ্টা করলাম,আজ কী কী বলেছি গোয়েন্দা পুলিশের সামনে। বা কোন্ পর্যন্ত বলেছি। এই মুহূর্তে আমাকে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া সালেহা আপার আসলে কিছু করবার ছিলো না। যা ভাববার বা করবার তা আমাকেই ভাবতে হবে এবং করতে হবে। সালেহা আপা আমার পাশে আছেন,তখন আমার জন্য এটাই একটা মানসিক শক্তি। ইতিমধ্যে আমি আমার করণীয় ভালোভাবে বুঝে ফেলেছি। বিষয় একটাই, যা বলবো তা ভুলে যাওয়া চলবে না। ওখানে গোয়েন্দা অফিসারের সামনে যা বলেছি তা মনে মনে আবার আওড়াতে হবে। পরীক্ষার প্রস্তুতির মতো তা মুখস্ত ক’রে ফেলতে হবে।
হঠাৎ দেখলাম,কারা কতৃপক্ষের কয়েকজন ধোপদুরস্ত অফিসার আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। যেহেতু সালেহা আপা আমার দশদিন আগে এখানে ঢুকেছেন,তাই সকলেই তাঁর পরিচিত। সালেহা আপাই তাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যে একজন জেলর সাহেব। যাকে রাতেই আমি দেখেছি। অন্যরা একজন জেল সুপারিন্টেনডেন্ট, একজন ডেপুটি জেলর এবং সঙ্গে একজন সুবেদার। জেলর সাহেব আমার পরিচিত হলেও অন্যরা তার মাধ্যমে আমার খোঁজখবর নিতে এসেছেন বলে জানালেন। পরে আমাকে দেখতে আসা ডেপুটি জেলরের মাধ্যমে জেনেছিলাম তারা আসলে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমাকে নিয়ে তখন কিছু বাড়তি রটনা হয়তো ছিলো। আমাকে তাদের দেখতে আসা তারই কারণ। অল্প বয়স,গায়ে অস্ত্রের বসন, আবার বাইরে মেয়ে রেখে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এত অল্প বয়সে এতো কিছু ঘটনার সাক্ষী যে মেয়ে,সে তো দর্শনীয় বটেই। তাছাড়া আমার জীবন পদ্ধতি অন্য আর দশজনের কাছে ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপার। আমার সঙ্গে ভালো মন্দ কিছু কথা জেলর সাহেবই বললেন। অন্যরা শ্রোতা। তিনি বললেন, সালেহা আপা আছেন, বুঝতে পারছি আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আজ কালই আপনারও ডিভিশন এসে যাবে। সালেহা আপা আগে থেকেই ডিভিশনে ছিলেন। সেটা ছিলো আমার জন্য বাড়তি সুবিধা। সুবিধা বলতে নিয়ম ক’রে চা খেতে পারা। আর রাতে একটু ভালোভাবে ঘুমানো। জেলর সাহেব বললেন আপনার ডিভিশনের জন্য মাহ্মুদুল হক ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখানে বলি, প্রয়াত জনাব মাহ্মুদুল হক আমার মামা। এবং তিনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক ছিলেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন কারাগারে রাজবন্দীদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন সে প্রবনতা আরও অনেক বেশি ছিলো। এই ভদ্রতা দেখানো কোনো নিয়ম নয়। তবে এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। জেলর সাহেব আরও বললেন,আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাল সকালে আবার গোয়েন্দা পুলিশের লোক আসবে। এই সকল টুকিটাকি কথা সেরে অন্যদের নিয়ে তিনি চলে গেলেন। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরা ওয়ার্ডের রুমে ঢুকে দরকারি কিছু কথায় মনোযোগ দিলাম। এর মধ্যে সুবেদার সাহেব এসে ওয়ার্ডে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেলেন। ওয়ার্ডের চাবি নিয়ে যাওয়াতে আমার মুড একেবারেই নষ্ট হয়ে গেলো। আমি ভাবতে পারতাম না,আমি যেখানে ঘুমাবো সেই ঘরের চাবি থাকবে অন্য কারো হাতে। কারাগারের এই নিয়মের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আমার অনেক দিন লেগে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়াতে আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছিলো না। বললাম চলেন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম কোথায় ঘুম! আমার মাথায় আবার ঘুরপাক খেতে লাগলো সকালে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ঝানু গোয়েন্দা দেলোয়ার হোসেন আমার সামনে বসে আছেন রাজদণ্ড হাতে নিয়ে।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী