বাউফলে সবার নজর অনিন্দিতা নামে এক তরুণীর দিকে। পার্টি অফিসের এক রসিক ভাঁড় তাদের বড় ভাইকে বলে, –হেইয়ে গান দেইখা আর কতো বড় ভাই।
–তুই চুপ থাক; এতো সোন্দর মেয়ে কই থেইকে পাইবে!
—আছে আছে; অত্র-অঞ্চলেই আছে।
–সেইডে কী ঠিক হবে।
নূরানী চেহারার এক সাইডকিক বলে, হেইডে ইসলাম সম্মতই হইবে। হিন্দু মাইয়া তো মুসলমানের গণিমতের মাল। সেইডে তো মসজিদের হুজুরও বইলে থাহেন।
—কিন্তু আমরা কী যুদ্দের ভিতরে আছি; যুদ্দ জয় ছাড়া গণিমত সামগ্রী লাভ হয় ক্যামতে!
–যুদ্দের মইদ্দে না থাকলে হানে “মক্কা শরীফ” পাহারা দেওনের কতা কী কেউ ভলতো!
–এক চান্সে দুই শিকার; একবার সাইজ কইরে ছাইড়ে দিলে; ঘরবাড়ি ছাইড়ে ইন্ডিয়া পালাইবেহানে।
–তো এরেঞ্জমেন্ট করো! কতায় না বড় হইয়ে কামে বড় হও।
অনিন্দিতা মা-বাবার আদরের মেয়ে। বাবা শখ করে নিজের হাতে মেয়ের জন্য নিত্য-নতুন পোশাক বানিয়ে দেন। মেয়েটি যখন পথ দিয়ে হাঁটে, মনে হয়, এক স্নিগ্ধ রাজকন্যা এসে পড়েছে জঙ্গলে। রাস্তার বুভুক্ষু লোকগুলোর চোখগুলো মাছির মতো গিয়ে বসে রাজকন্যার গায়ে। সে হাত দিয়ে মাছি তাড়ায়। এক মাছি চিতকার করে বলে, ও উস্তাদ দেইহে যান “আইটেম নাম্বার” বের হইয়েছে রাস্তায়। আরেক মাছি হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে চায়ের স্টলের চেয়ার থেকে পড়ে যায়। এক ভদ্রসদ্র লোক খবরের কাগজ পড়ার ছলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অনিন্দিতাকে। চায়ের স্টলের বালকটি গলা খাঁকারী দেয়, আপনেগো মাইয়ার বয়েসী মাইয়া দেইখে এতো চুলবুল করতেছেন চাচারা! কই যামু।
শরীরের মানবসম্পদ বলয় চুলকাতে চুলকাতে এক চাচা ধমক দেয়। –বেদ্দপ। তর চাকরী খাইয়ে দিমুহানে।
নামাজের পথযাত্রী এক মুসল্লী চেঁচিয়ে বলে, ঐ বেডি রোজা-রমজানের দিনে বাইরে কেন! মিয়ে মানুষ হলো গিয়ে তেঁতুলের মতোন। দেকলেই লালা আসে। দিলা তো বাউফলের রোজা পাতলা কইরে। চুল খোলা কেন! জাননা জ্বিনেরা চুলের মধ্যে ঢুইকে পড়ে। ঘোমটা দেও।
এক জরাজীর্ণ পার্টি অফিসের টুলে বসে রোজা লেগে কাহিল এক জ্বিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, – আহারি পার্টি পাওয়ারে থাহলে পরে এই হুরডারে নিয়া পূর্ণিমা-পূর্ণিমা খেলতি পারতাম।
তা তুমার ভগ্নিপতিরে কইয়ে দ্যাহো; সে তো পার্টি ইন ফাওয়ার।
-হেইয়ে কইছে জেলের বাইরে আছো; ঐডে নিয়ে থাহো! ফোর টুয়েন্টি কইরো না।
ভুতের মতো মুখ করে থাকে জরাজীর্ণ পার্টি অফিসের দুই জ্বিন। ওদিকে ঝলমলে এক পার্টি অফিসে বসে দেশপ্রেমকারীরা।
–উস্তাদ ঐ যে “আইটেম নাম্বার”
–তা মাথায় ঘুমটা ক্যানো। হেতি কী মুসলমান!
—খাঁটি হিন্দু। আপনি কইলেই একদিন “তনু-তনু” খেলা যায়।
–“ইয়াসমীন-ইয়াসমীন”; “কল্পনা-কল্পনা” খেলা যায়; কিন্তু আমগো তো “রাইফেল-রোটি-আওরাত” হাসিলের লাইসেন্স নাই।
—আমি ডাক্তাররে ম্যানেজ করবোহানে; সে কইয়ে দেবে মিউচুয়াল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স।
—তুমি দেহি খোউব ইংরাজী শেকছো!
—টিভিতে শোনলাম। শিইখে ফালাইছি।
—তাইলে এরেঞ্জমেন্ট করো।
অনিন্দিতা বাসায় ফিরে ফেসবুকে লগ ইন করে। দেখে একজন সেবায়েতের রক্তাক্ত ছবি। বাবা-মাকে ডেকে দেখায়। বাবার হৃদকম্পন বেড়ে যায়। অনিন্দিতার মা একগ্লাস জল এনে দেয়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সিঁথির সিঁদুরের দিকে একবার তাকায়।
–এদেশে কী থাকা যাবে গো অনিন্দিতার মা!
–নিজের দেশ ছাইড়ে কই যাবা!এ তোমার চৌদ্দ পুরুষের ভিটা; ঐ তেঁতুলিয়া নদীর জলে চৌদ্দ পুরুষের শরীর পোড়ানো ছাই; আমি এই মাতৃভূমি ছেইড়ে যাবো না কুথাও।
অনিন্দিতা ফেসবুকে দেখে, বুদ্ধিজীবীদের ঝগড়া চলছে হিন্দুরা সংখ্যালঘু কীনা তা নিয়ে। একদল বলছে ভারতের বিজেপি ষড়যন্ত্র করছে; আরেকদল বলছে ইজরায়েলের বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। একজন সেবায়েতের রক্তাক্ত মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবীদের তর্ক করতে হয়; এরা কী পাগল! অনিন্দিতা টিভি দেখে। বাবা ঐ ঝগড়া-শোগুলো খুব পছন্দ করে। কেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টানঐক্য পরিষদ নেতা ভারতের কাছে তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন; তা নিয়ে কেঁপে কেঁপে তর্ক করছে দুটি লোক। এইসব হত্যা-উচ্ছেদ এসব যেন কিছুই নয়; কাউকে অসহায়ত্বের কথা জানানোটাই বড় অপরাধ হয়ে গেলো। চ্যানেল চেঞ্জ করতেই দেখে এক ধামাচাপাজীবী বলছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে; দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকার মানুষের চেয়ে নিরাপদ। এই সরকারই পারে; এই সরকারই পারবে। সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দিন। এইসব সন্ত্রাস ঘটাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। অনিন্দিতা চ্যানেল বদলে দেয়, সে জানে এরপর লোকটা আর কী কী বলবে। এদের ধামাচাপার কৌশলগুলো একই।
অনিন্দিতার বাবা বলে, মানুষ নিয়ে এই অমানুষগুলি আর ভাবেনা। এগো খালি নিজের সম্পদবৃদ্ধির ফন্দি।
অনিন্দিতার মা বলে, তবু এই সরকার আছে জন্য আজো সম্ভ্রমের সঙ্গে বেঁইচে বর্তে আছি। আগের আমলে তো পূর্ণিমা রাত আইলেই ডর আইতে। যদি বিএনপি-জামাতের নেকড়েগুলি ক্ষ্যাপে; যদি শূয়োরের মত ঘ্যোত ঘ্যোত করতে হিন্দু পাড়ায় হানা দেয়।
বাউফলে এরপর এক ভয়ংকর পূর্ণিমা নামে। ঝলমলে পার্টি অফিসে বসে আইটেম নাম্বার দেখতে দেখতে কয়েকটা চেহারা নেকড়ের মতো হয়ে যায়; কতগুলো চেহারা শূয়োরের মত হতে থাকে। এক নেকড়ে বলে, তেঁতুলিয়া নদীতে একটা সোনার তরী ভাসান দেন উস্তাদ।
–আমি ফুন কইরে বইলে দেবানে। এরেঞ্জ হইয়ে যাবেনে।
অনিন্দিতা আর তার মাকে জোর করে সোনার তরীতে তোলে কতগুলো নেকড়ে। অনিন্দিতার মা আর্তনাদের স্বরে বলেন, বাবারা আমরা তো সব সময় তোমগের ভোট দেই। আমরা তো সবসুময় নৌকাতেই আছি; আবার জোর করে নৌকায় তোলো কেন!
এক মাঝবয়েসী যুব শূয়োর বলে, বৌদি ডরের কিছু নাই; আমরা জাস্ট একটু গল্প করবো। দেশের উন্নয়নের গল্প শোনবেন।
এক খ্যাংড়া নেকড়ে বলে, আমরা একুন সৌদি আরবের মতোন বড়লোক দ্যাশ হইতেয়াছি; আপনের ভারত ফেইল।
–আমার ভারত মানে! আমাগের চৌদ্দ পুরুষের দেশ বাংলাদেশ।
মাঝবয়েসী আরেক যুব শূয়োর বলে, মাইন্ড করেন ক্যানো বৌদি। রাগলি পরে আপনেরে অবশ্য হেমা মালিনীর মতো সোন্দর লাগে।
লাউডস্পীকারে শোলে ছবির গান “মেহবুবা ও মেহবুবা” রিমিক্স ভার্সান বাজতে থাকে। নেকড়ে ও শূয়োরেরা ফেনসিডিলের বোতল ভেঙ্গে সোনার তরীতে ছড়িয়ে দেয় ভাঙ্গা কাঁচগুলোকে। গব্বর সিং-এর মত শূয়োর চেহারার এক যুব নেতা অনিন্দিতাকে বলে, নাচো। অনিন্দিতা রাজী হয়না।
এক টিংটিঙ্গে নেকড়ে প্রস্তাব দেয়, –পহেলা বৈশাখের মুতোন তাহরুশ খেল্মু কইলাম।
আকাশ থেকে পূর্ণিমার অশ্রু ঝরতে থাকে। কয়েকটা নেকড়ে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিন্দিতার “তনু”র ওপর।
অনিন্দিতার মা বলেন, আমার মেয়ের বয়স কম। বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো। এবার আকাশ থেকে অঝোর ধারায় পূর্ণিমার কান্না ঝরতে থাকে;ডুকরে ওঠে তেঁতুলিয়া নদীর পানি।
একজন মাঝবয়েসী যুব শূয়োর; চোখের নীচে টেন্ডারের কালি; গতরে চর্বি জমেছে বেশ; চুলে কলপ করে জেল দেয়া, মাড়ির দাঁত বের করে ঘিন ঘিনে হাসি হেসে বলে,
–বৌদি আসেন এবার আমরা একটু ফূর্তিফার্তা করি।
হঠাত অমাবশ্যা নামে। এমনি এক অমাবশ্যায় অনিন্দিতার এক মাসীমাকে পাকিস্তানী সেনাশূয়োরদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এলাকার রাজাকার নেকড়েগুলো। এ কোন পূর্ণিমা; অমাবশ্যার চেয়ে অন্ধকার।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক ই-সাউথ এশিয়া