ক্লাস এইটের ইংরেজি বইয়ে একটা গল্প ছিল। সাবিনাকে কেউ একজন এসে বলল তার বান্ধবী তার সম্বন্ধে খারাপ কিছু বলেছে। একথা শুনে সে তার বান্ধবীর সাথে কিছু না বলেই তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অনেক পরে জানা গেল সাবিনার সম্বন্ধে আসলে তার বান্ধবী কিছুই বলেনি। মাঝখানে বড় একটা সময় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চলে গেল। শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে লেখা সে গল্পে সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল সাবিনার কি তার বান্ধবীর কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা না জেনে বিরূপ ব্যবহার করাটা উচিত হয়েছে? সে কি mentally developed?
ক্লাস এইটতো অনেক দূরের কথা আপনি জেনে অবাক হবেন এসময়ে শিক্ষিত লোকেরাও অন্যের কাছ থেকে কান কথা শুনে তাকে না জানিয়েই একটা বিরূপ ধারণা পোষণ করে চলে এমনকি সারাটা জীবন। শিক্ষা এক জিনিস মেন্টাল ডেভলপমেন্ট আরেক জিনিস যদিও।
গ্রামে বিয়ের আগে মেয়ের বাবা মায়েরা খুবই আতঙ্কে থাকে কে কোন দিকে পাত্রপক্ষকে কিছু বলে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়। এসব শুধু গ্রামে হয় বা ভিলেজ পলিটিক্সের অংশ তা নয়, শহুরে অনেক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখা যায় একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে কানকথা লাগিয়ে দেয়। কল্পনাও করতে পারবেন না আপনার পাশে বসা একই পাতে খাওয়া শুভাকাঙ্ক্ষী ভিতরে ভিতরে আপনার sabotage করে চলছে। এই জাতি যা শুনে তাই বিশ্বাস করে, কখোনই কিছু যাচাই করতে যায় না, সেটা তার ধাতে নাই। সেটাই অনেকের কপাল পোড়ায়। বিনা দোষেই কলঙ্কের ভাগ নিয়ে কাটিয়ে দেয় একটা জীবন।
আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। আমি যখন মেডিকেলে ভর্তি হই তখন আমার নিকটাত্মীয় হোস্টেলে যাওয়া আসা করতেন। তিনি গ্রামে এসে ছড়িয়ে দেন আমার বোনদের কাছে যে তোমার ভাই নোংরা পর্ন টাইপের চটি বই পড়ে। বোনেরা বড় ভাইকে লজ্জায় কিছু বলতে পারেনা আবার ভিতরে ভিতরে এটাও মানতে পারে না যে তার ভাই এমনটা করতে পারে। একদিন আমার ছোট বোন মনি কাঁপতে কাঁপতে কাদতে কাদতে বলে ফেলে ভাই তুমি নাকি মেডিকেলে যাবার পর এরকম আজেবাজে বই পড়ো। আমি আকাশ থেকে পড়ি। যদি পর্ন পড়ি সেটা আমার ব্যাপার কিন্তু আমি যেহেতু পড়ছি না সে অপবাদ কেন মেনে নিব। আমি বলি কে বলেছে। ছোট বোন নাম ও বলে দেয়। আমি সাথে সাথেই তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি খুব কৌশল করে কথা পাল্টিয়ে বলেন, মেডিকেলে পড়তে হলে তো সব ছবিই দেখতে হবে, ডাক্তার হতে হলে কি মেডিকেলের বই পড়তে হবে না? মেডিকেলের বইয়ে কি মানুষের নেংটা ছবি থাকবে না? বুদ্ধিমান লোকেরা এভাবে দ্রুত কথা ঘুরিয়ে ফেলতে পারে অথচ তার উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রচার করা যে আমি শহরে গিয়ে বাজে হয়ে গিয়েছি, বাজে বই পড়ছি। গ্রামে সবার কাছে আমাকে ছোট করে তার কি লাভ সে প্রশ্নের উত্তর আমি কোনদিন খুঁজে পাইনি। ছোট বোনের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা যে সে নামসহ আমাকে বলেছে যা না হলে সারা জীবনই তারা ভাইয়ের প্রতি একটা বিশেষ ধারণা পোষণ করে চলতো। আমি হয়তো কোনদিনই তাদের ভুল ভাঙ্গানোর সুযোগ পেতাম না। আমার মনে হয় সব ক্ষেত্রেই যে কোন অপবাদ বা বদনামকারীর নাম সহ বলে দেয়া উচিত। যার নামে কুৎসা করা হচ্ছে তার অধিকার আছে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বা যে কিছু ছড়াচ্ছে তাকে জিজ্ঞাসা করার- পরে যা সত্য সেটা প্রতিষ্ঠিত হবে।
দুদিন আগের ঘটনা। কথায় কথায় মেডিকেলের এক ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম বছর খানেক আগে থেকে সে জানে আমি নাকি ডিভোর্সড। আমার বউ আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। নিশ্চয়ই বউ কেন চলে গেল তার কার্যকারণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে সেখানে। সেটুকু আর সে বলে নাই। এবং এই একটা বছর সে ধারণা নিয়েই একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে গেছে। কোন দিন বলেনি তবে বিশ্বাস করেছে। ডিভোর্স কোন খারাপ জিনিস না। অসুখী বিয়ের চেয়েও ডিভোর্স মহত্ত্বর। কিন্তু যে ব্যাপারটা আমার জীবনে ঘটেনি সেটা কেন আমি হজম করব বা সেটার জন্য মানুষ কেন আমাকে অন্যরকম ভাবে বিবেচনা করবে তা মেনে নেওয়াও খুব সুখকর নয় অবশ্য। আমাকে সে জানায় সে যার কাছ থেকে শুনেছে সে একজন চিকিৎসক ছাত্র, NIDCH তথা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের, সে আবার শুনেছে আরেকজন ডাক্তারের কাছ থেকে একই হাসপাতালের। ইনিয়ে-বিনিয়ে যতোটুকু বলেছে কিছুটা চিনেছি কিছুটা চিনি নাই। ছোট বোন আপন বলে নাম বলে দিয়েছে, সে তো পর সুতরাং তার কাছে পুরো সাপোর্ট আশা করি না প্রচারকারীর উদ্দেশ্য উদঘাটনে।
আমার প্রশ্ন হলো শিক্ষিত মানুষগুলি এত আকাশ-পাতাল কিভাবে ছড়াতে পারে? আর অন্য শিক্ষিতরা কিভাবে varify না করে এরকমটা বিশ্বাস করে বিরূপ ভাবনা নিয়ে আশেপাশে চলতে পারে এবং অন্যদের সঙ্গে এনিয়ে কানাঘুষা করতে পারে? ভাবা যায় একটা বছর সে এটা মনে মনে ধরে আছে এ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করছে কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করেনি।
ক্লাস এইট এর বই এর অনুকরণে প্রশ্ন করা যায়, যারা নানা কথা রটিয়ে যাচ্ছে, যে একই প্রতিষ্ঠান এতদিন থেকেও মনে মনে বিশ্বাস করে গেছে তারা কি কেউ মেন্টালি ডেভলপড?
এ জাতির জেনেটিক্স এমন কেন? অন্য দেশে অন্য জাতিতেও কি এমনটা হয়? যারা এমন ধরণী দ্বিধা হও টাইপের কুৎসা ছড়ায় কেমন বাপ মায়ের ঘরে জন্ম এরা?
//ওগো কখনো না দেখা ভৌতিক মেয়ে,
ডিভোর্স দিয়ে চলে গিয়ে,
তুমি কোথায় আছো? কেমন?//
– ডা: আমিনুল ইসলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক