জাপানে আসার দুই বছর পার হচ্ছে। মনে হচ্ছে এইত সেদিন ফুকুওকা এয়ারপোর্টে নামলাম! সময় যে এত তাড়াতাড়ি যায় মাঝে মাঝে টের পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এই দুই বছরে আমার কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পরিবারের সবাইকে বাংলাদেশে রেখে আমাকে একাকী এক বিদেশ বিভূঁই বেছে নিতে হয়েছে। এখন নিজেকে প্রশ্ন করি এতকিছু কি শুধু আমি আমার একার জন্য করছি নাকি অনেকের জন্য করছি। অনেকে হয়ত ভাবে বিদেশের জীবন না জানি কত কিছু দিয়ে ভরে আছে। কিন্তু যে নিজে দিনগুলি পার করে সে বুঝে একাকী বিদেশের জীবন দূর থেকে যেমন মনে হয় তেমন নাও হতে পারে।
আমি কেন জাপানে আসলাম এসব নিয়েও কেউ কেউ কথা বলেছে। আমি কেন ইউরোপে মাস্টার্স করে জাপানে পিএইচডি করতে আসলাম এটাও তাদের ভাল লাগে নাই। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাব। প্রয়োজনে আমি আফ্রিকা যেতেও রাজী আছি। আমাদের বাঙ্গালীদের মাঝে একধরনের সুপ্রিমেসি আছে। কেউ যদি উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য অথবা অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করতে যায় তাহলে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় ভাবতে থাকে। সাথে সাথে আশেপাশে একটা ধারনা জন্মে যে ঐসব দেশগুলো কেবলমাত্র উন্নত গবেষণার সূতিকাগার। র্যাঙ্কিং দেখলেই এসব অহমিকা টিকেনা। এখন এশিয়ার অনেকেই উপরের দিকে ওঠে আসছে।
উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের পাশাপাশি যে বিষয়ে লেখাপড়া করা হবে আর যে ল্যাবে গবেষণা করা হবে সেদিকে খেয়াল দেয়া বেশি জরুরি। আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ৩০০ তম সেখানে পড়ার থেকে এশিয়ার যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ২৫ তম সেখানে পড়াই বেশি শ্রেয় হওয়া উচিত। কিন্তু আভিজাত্য আর চাকচিক্যে ভরা আমেরিকান ড্রিমের কাছে এশিয়ার স্বপ্ন পরাজিত হতে বাধ্য। কলোনিয়াল শাসন আমাদের মগজে গেথে দিয়েছে যে, ইংরেজি জানলেই স্মার্ট হওয়া যায়, অন্যদের কাছ থেকে আলাদা কদর পাওয়া যায়। জাপান, চীন অথবা দক্ষিণ কোরিয়া দেশসমূহে আসলে এসব ধারনা আরোপিত মনে হয়। ইংরেজি যতটুকু জানা দরকার ততটুকু দিয়েই কাজ চালানো যায়। আর যারা উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংরেজি নিয়ে গবেষনা করে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু এই তথাকথিত ইংরেজি সুপ্রিমেসি এসকল এশিয়ান দেশগুলোতে নাই।
জাপানে আসার পর মনে হয়েছে আমার এখানে আসা অবশ্যই দরকার ছিল। নাহলে এমন একটা ইউনিক সমাজব্যবস্থা, কালচার আর পরিবেশ না দেখার জন্য আফসোস থেকে যেত। এখানে আসার পর গত দুইবছরে রাস্থাঘাটে, শপিং মলে কোথাও একটা ময়লা পড়ে থাকতে দেখি নাই। এমনকি কান্ট্রি সাইডে গেলেও একই চিত্র চোখে পড়ে। আমি দুই বছর ইউরোপে ছিলাম। কিন্তু জাপানের মত এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হয় নাই। যদিও আমি এখনো আমেরিকা যাই নাই কিন্তু লোকমুখে যা শুনেছি তা কক্ষনো জাপানের সমতুল্য হতে পারবে না।
জাপানে এসে শিখেছি যে কেউ যদি কাজে পারফেকশনিষ্ট হতে চায় তাহলে তাকে সেই কাজ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর করে যেতে হবে। শর্টকাট বা এক, দুই দিনে কেউ এক্সপার্ট হতে পারেনা। কেউ যদি লেগে থাকে তবেই বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়। এজন্যই জাপানিজরা নিজের বিষয়ে এক্সপার্ট হয়ে যায়। আমদের মত জগাখিচুড়ী (একই সাথে নাচ, গান, কবিতা, খেলাধুলা, পড়াশোনা করলে সববিষয়ের এক্সপার্ট হওয়া অসম্ভব) হয়না।
সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমার মনে দাগ কেটেছে সেটি হচ্ছে একসাথে দলবেঁধে কাজ করা। ফলে কাজটি সহজ হয়ে যায়। সাথে সাথে একজন অন্যজন থেকে শিখতে পারে। যেমন ল্যাব ক্লিনিং করা। বছরান্তে একবার আবার বছরে কেউ কেউ একের অধিকবার ল্যাব পরিষ্কার করে। এছাড়া সাপ্তাহিক ক্লিনিং আছে। এসব কাজ কেউ এসে করে দেয়না। শিক্ষার্থীরা কাজ ভাগ করে নেয়। দলবেঁধে সবাই তাদের নিজ নিজ কাজ শেষ করে। ফলে কারো কাছে ক্লিনিং ব্যাপারটা একঘেয়েমি মনে হয়না।
জাপানে এসে আমার মনে হয়েছে মোবাইল ফোনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আসলে কথা বলার দরকার নাই। অথচ আমরা বছরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোনে কথা বলে সময় নষ্ট করি। আমি গত দুই বছরে জাপানে মোবাইল ফোনে সম্ভবত এক ঘণ্টার বেশি কথা বলি নাই। সত্যি বলতে দরকার হয় নাই। প্রয়োজনীয় অনেক কিছু মেসেজ দিয়ে বা ইমেইল করে জানানো সম্ভব। এজন্য মোবাইল ফোনে কল দেওয়ার দরকার পড়েনা। এখানে পাবলিক পরিবহনে মোবাইল ফোনে জরুরি দরকার ছাড়া কেউ কথা বলেনা। সাবওয়েতে কাউকে একে অপরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনি নাই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এরা বেশিরভাগ কাজে-কর্মে একইরকম ট্রেন্ড ফলো করে। যেমন ইদানীং নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে মাস্ক পড়ে থাকতে বলা হয়েছে। আমি দেখেছি ৯৯.৯৯% জাপানিজ এই নির্দেশনা ফলো করছে। সারাদেশ পরিষ্কার থাকার পেছনে এই ট্রেন্ড কাজ করে। এরা ছোটবেলায় শেখে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা যাবেনা। ময়লা ফেলার সময় নির্দিষ্ট পলিথিন ব্যাগে ফেলতে হবে। সারাদেশেই একইভাবে সবাই সেটাই ফলো করে।
এজন্য আমি মনে করি জাপানে এসে অনেক কিছু শিখছি হয়ত আরো শিখব! অন্যদেশে থাকলে অন্যকিছু শিখতে পারতাম। কিন্তু জাপানিজদের অনন্য দিকগুলো নিজের চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা এতটা সহজ হতনা। তাই যারা নিজেকে সেরা বলে তারা আসলে সেরা নয়। সেরাদের মধ্যেও যে সেরা দেশ আছে সেখানে না গেলে দূর থেকে বোঝা মুশকিল বটে!
– মো: রশিদুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পিএইচডি গবেষক, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান