আমার আব্বা আমাকে বলতেন, সংকোচেরই বিহবলতা নিজেরে অপমান। আমার নানা বলতেন, পাছে লোকে কিছু বলেকে পাত্তা দেবে না। জীবন একটাই; এখানে তোমার ইচ্ছার ও কথা বলার স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আব্বা আমাকে বিতর্ক শিখিয়েছিলেন, সমাজে যুক্তির অভাব আর রাগের প্রাবল্য দেখে। আব্বা আমাকে বিশ্বের অভিধান পড়াতেন, তুলনামূলক ধর্ম-দর্শন পড়াতেন, প্লেটোর রিপাবলিক পড়াতেন সেই ছোট বেলা থেকে। উনি বলেছিলেন, এই সমাজের আবদ্ধ চিন্তা থেকে কিছু শিখবে না। যে বিশ্ববীক্ষা তৈরি হচ্ছে তোমার; এরসঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সমাজের দেখা পাবে তুমি।
ঈশ্বরদী-পাবনা-আড়ানী-রাজশাহী-ঢাকা মিলিয়ে আমার জীবনে আমি বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ পেয়েছি। ইচ্ছার স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা চর্চায় বাধা পাইনি। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ঈশ্বরদী কলেজ মাঠে ফুটবল খেলতে গেলে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে থেকে আসা এক শিবির নেতা প্রথম বারের মতো আমাকে চ্যালেঞ্জ করেন। উনি আমার বাড়ির দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, দ্যুতি-অরণীতে সোনার চামচ মুখে জন্মেছো তো; তাই বাঙালি মুসলমানদের দুঃখ বুঝবে না তুমি।
সেই প্রথম আমি শ্রেণী শব্দটির দেখা পাই। উনি দাবি করেন, উনার রাজনীতি হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম।
আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করতে থাকি; আমার দাদা ও তার বাবার ব্যবসা-জমিজমা-বিপুল অর্থের উতস কী! আম্মা উত্তর দেন, বহরমপুরের সাহেবনগরের এই সরকার পরিবার সৎ পরিবার হিসেবে পরিচিত। তোমার দাদা শুধু নিজের ছেলেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াননি; এলাকার মেধাবী অন্য ছেলেদেরও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন।
আম্মার স্টেটমেন্ট ডাবল চেক করতে আমি আব্বার জমিজমার কৃষিকাজের ব্যবস্থাপক আজিমুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, দাদা তাকে অনেক স্নেহ করতে। ৬৪-৬৫-র দাঙ্গাবস্থায়; একটু স্বাধীন জীবন পেতেই দাদা তাকে সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠান। আব্বা এসে কলেজের শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে আব্বা কখনো কথা বলেন না। বন্যা-খরা-ফসলহানি, এসবের কারণে উপার্জন কম হলে আব্বা ব্যাপারটা বোঝেন। আজিমুদ্দিন ভাই বললেন, সরকার একদমই তার বাবার মতো হয়েছেন। উনি আমার এই সততা তদন্তে হাসেন। আমি তুই ডাকটি অপছন্দ করি, আব্বা তাকে তুই বলেন কেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, খুব ছোট বেলা থেকে পরিচয়। বড়রা বয়েসে ছোটদের আদর করেই তুই বলে।
এখন আজিমুদ্দিন ভাই রাইস মিলের মালিক। শেষবার দেখা হলে তাঁর মিলে নিয়ে গিয়ে তার গদিতে বসান; তিনি অশ্রুসিক্ত ছিলেন। আমার ছেলেও বড়াল নদীর ধারে আব্বার স্বপ্নের কৃষক গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে ভালোবাসা আর মায়া দেখেছে; সে গল্প সে আমাকে বার বার বলেছে। আমরা ছোট বেলায় নানাবাড়ি আড়ানীতে গেলে আম্মা আমাদের বড়াল নদীর ওপারে আজিমুদ্দিন ভাইয়ের গ্রামে নিয়ে যেতেন। তবু আমি নিঃসন্দেহ হইনি। কলকাতার বন্ধুদের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ কী করে এতো সফল হলো যে, ইংরেজদের কুঠিবাড়ি কিনে ফেললো, বাসের ব্যবসা, কটনমিলের শেয়ার লাভ করলো; আর এতো জমাজমি কোত্থেকে এলো! সেখানে কী দুর্নীতি আছে! পূর্বপুরুষ, মুঘলের সহমত ভাই ছিলো কীনা!
বৃটিশদের রাজবদর ছিলো কীনা! এসব প্রশ্ন আব্বাকে করেছি; কলকাতার বন্ধুদের মাধ্যমে খবর নিয়েছি। একটা মানুষ মারা যাবার পর সবাই তাকে যদি ইতিবাচকভাবে স্মরণ করে; সেটাই জীবনের বড় সাফল্য; আর কিছু নয়। দেখলাম দাদা কংগ্রেস আর সিপিএম-কে অর্থ সাহায্য করতেন। যে সময়ে মুসলমানেরা মুসলিম লীগ করার কথা। দাদা পাকিস্তানে বিশ্বাস করেননি। উনি ভারতে আস্থা রেখেছেন; নিজের ছেলে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরার পরেও। শুধু প্রাণ বাঁচাতে ছেলের ভেলা ওপারে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
তাই বলে আব্বার মাঝে কোনদিন ভারত বিদ্বেষ পাইনি। শিক্ষা-সংস্কৃতির এই সেন্টার অফ এক্সেলেন্সকে আমৃত্যু শ্রদ্ধা করেছেন। বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। এজন্য তিনি প্রাণ দিয়ে ছাত্র পড়াতেন। উনি স্পেশালাইজেশানের মানুষ। উনি বিশ্বাস করতেন, দেশপ্রেম থাকে মানুষের নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করার মাঝে।
ঢাকায় পড়তে যাবার সময় আব্বা বলেছিলেন, প্রতিটি মানুষকে সম্মান দেবে। কাউকে এতো বিশাল কিছু আবার কাউকে এতো ক্ষুদ্র ভাবার কিছু নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মানে আমাদের দুর্বলতার কোন জায়গা নেই।
আম্মা খাঁটি বাংলাদেশের মেয়ে; তাই বলেছিলেন, তোমার আব্বার মতো সরলভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে আঘাত পেওনা।
আম্মার কথাটা মনে রেখেছি, ঢাকায় আমি খুব ফর্মাল থেকেছি; কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করিনি। এরমাঝে কলকাতা ঘুরতে গিয়ে আব্বার বর্ণনার কলকাতার কালচার হুবহু মিলে যাবার আনন্দ পেয়েছি।
ঢাকার মানুষ অত্যন্ত উদার দিলখোলা। কিন্তু রাজধানীর মানুষ বলে একটা অহংকার আছে। কলকাতার স্কটিশ চার্চে পড়া লাক্সমি, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র বলে সমাদর করেছে। কিন্তু ঢাকার বন্ধু খান হলিক্সসের ছাত্রী বলে একটু অহংকার তো দেখিয়েছেই।
কলকাতার ছেলে সঞ্জীব বর্মণ একজন ভেটেরান ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টার। আমি ঈশ্বরদী-রাজশাহীর ছেলে বলে কখনো ঢাকার বিতার্কিক বন্ধু ফাখরুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মফস্বলের ভূত বলার কথা কল্পনাও করেনি। ঢাকার মানুষের মুখের কথার ফিনেস কম। পট কইরা রাইগা একটা গালি দিয়ে দেয়াটাই ঢাকার সভ্যতাতে মালিন্য এনেছে।
ঢাকায় সিএসপি বা ইপিসিএস-এর মেয়ে নিজেকে যেরকম সবজান্তা ও স্মার্টনেসের ভার্নিয়ার ধ্রুবক হয়ে, সবাইকে ক্ষ্যাত বলে উপহাস করে; বৃটেনের সিভিল সার্ভেন্টের মেয়ে, ফ্রান্সের পলিটিক্যাল লিডারের মেয়ে, ভারতের বা পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের মেয়েদের মাঝে সেই প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস পাইনি।
তবু ঢাকাতেই অনেক বন্ধু আমার; তারা আবার এতো মায়াময়; যে দুই দশকের অদেখাও বন্ধুত্বের উষ্ণতায় চিড় ধরাতে পারেনি।
ঢাকার সেকুলার মুভমেন্টের সঙ্গেই বসবাস করতাম আমি। জাহানারা ইমামের “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী”-র নাগরিক আন্দোলনটাই ছিলো আমাদের বেড়ে ওঠার কালের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। আর ছিলো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর গণতন্ত্রের আকাংক্ষার শহর ঢাকা।
হঠাত ইন্টাননেটের আলোর ঝলকানিতে বেশি বয়েসে যৌবন জ্বালায় অস্থির হয়ে একটা নিও পোগোতিচিলের গাছ চোখে পড়লো ঢাকায়। যারা আমাদের বেড়ে ওঠার কালের আইকন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আইকন ভেঙ্গে ঐখানে খর্বাকৃতি দলীয় আইকন বসানোর চেষ্টায় মরিয়া। এরা ছোট বেলায় দেখা ঐ শিবির কর্মী বা ধর্মচিলের মতো; ব্লগে এলিটের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম করতে এসে; আওয়ামী লীগের তালগাছে চড়ে নিজেকে রুলিং এলিট ভাবতে শুরু করে।
ময়মন সিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারের দুর্বল ছাত্র তুলসি রায়; হঠাত কালচার শেখাতে শুরু করে; শুদ্র হিন্দুর কালচারকে সেকুলারিজম হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ময়মনসিং মেডিকেল কলেজের ড্রপ আউট; যাকে কোন দিন কিছু লিখতে দেখা যায়নি; সে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আমলে ইতিহাস রচয়িতা হয়ে পড়ে, যেমন ইচ্ছা লেখার দলীয় খাতায়, ব্লগে কয়েকদিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখে সিলেটের এক অপ্রমিত যুবক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয়ে; আমাকে ধমক দেয়, আমি যেন তাদের আইকন ভাঙ্গার শুদ্র উতসব বা কথিত শ্রেণী সংগ্রামে বাধা না দিই; অন্যথায় আমার বেডরুমের গল্প ফাঁস করে দেবে এমন ধমক দেয়।
বাংলাদেশের এই বিজন গ্রামের ছেলেরা; বাপ মন্দির-মসজিদে মাথা ঠুকে একাকার, মা বোরখায়-সিঁদুরে এখনো অষ্টাদশ শতকে; ছেলেরা এসেছে বাংলাদেশ সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতার চারুপাঠ দিতে। কেউ এসে পাকিস্তান প্রেমীর তকমা দেয়; কেউ বা কলকাতার দাদা বাবুদের স্তবক বলে গালাগালিভারস ট্রাভেলস করে যায়।
আমার চোখের সামনে বাংলাদেশ সংস্কৃতি, ভারত ও পাকিস্তান সংস্কৃতির চেয়ে অনগ্রসর হয়ে গেলো এইসব হীনমন্য লোকের অনলাইন নেতৃত্বে।
আর আমাদের কিছু জোলো আপা; সেই ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলার মতো বিশ্বাস করে বসলো; এইসব ভণ্ড দেশপ্রেমের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজারকে।
জার্মানিতে রেস্তোরায় ওসি-ডিসির দায়িত্ব শেষ করে ঘরে ফিরে, সেকুলার স্টেটাস দিয়ে বিমলার মনের রাজা হয়ে গেছে অনলাইনের উইলস্মিথেরা। জাস্ট প্রথম প্রজন্মে পশ্চিমে গিয়ে সাক্ষাত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হয়ে গেছে।
এ আর কিছু না; আওয়ামী লীগের রাস উতসবে ফেসবুকের চৌধুরী আপার পোস্টে উইলস্মিথ ইসলাম নিয়ে রঙ্গরস করে নিজেকে রেনেসাঁর নায়ক করে তুলেছে।
এই যে পচা শামুকগুলো তাতে পা কেটে আমাদের চোখের সামনে সংস্কৃতির নামে একটি কলতলা বিনির্মিত হয়েছে।
যেন কলিম শরাফি, সানজিদা খাতুন, আলমগীর কবির, তানভীর মোকাম্মেল, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিম আলদীন, এইসব আলোর মানুষের গড়া সোনালী ঢাকায় এখন অর্ধশিক্ষিত অপ্রমিত পোগোতিচিল আর ধর্মচিলফুল স্কাই এটা। পাকিস্তানের চেয়ে কট্টর মুসলমান আর ভারতের চেয়ে কট্টর হিন্দুর আঁশটে চিন্তার মাছ বাজারটাই আজকের ঢাকা।
আমরা এতো সহজে জায়গা ছাড়ার পাত্র নই। চাইলেই কতগুলো ভূঁইফোঁড় শ্রেণীসংগ্রাম আর সেকুলারিজমের নামে যা মুখে আসবে তাই বলবে; সমরুচির লোকেরা তাদের লাইক দেবে; কলতলার এই ট্যাগিং-সুইপারদের ঢাকার সাংস্কৃতিক মননের স্বঘোষিত ম্যানেজার হতে দেয়া হবে না। সব কিছু মনে রাখা হবে আর সময়মতো সব ফেরত দেয়া হবে। গোটা দুনিয়া ঘুরে এসে পচা শামুকে পা কাটার লোক আমরা নই। প্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমের “উদ্ধৃতির ঘরের উদ্ধৃতির ছেলেদের” দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতায় ঢাকার সংস্কৃতি বিনির্মিত হবে; এটা কখনোই ঘটবে না।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর ইন চীফ, ই সাউথ এশিয়া