শ্রী নিমাই বাবু দোলা বৌ’ দি কে, যে ভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন, আমি হয়তো আমার লেখায় এক হাজার ভাগের এক ভাগও কোনো চরিত্র তুলে ধরতে পারবো না।বিখ্যাত উপন্যাস ” মেম সাহেব” এর নাম জানেন না,এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।
বলতে চাইছি, যৌবনের কথা, যৌনতার কথা। আমাদের সমাজে যৌনতাকে খুবই নেগেটিভ ভাবে দেখা হয়। ফলে শিশু কিশোরী নারী বেশিই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।শিশু থেকে কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতী বিধাতার নিয়মেই হয়ে আসছে।সেক্স পার্ট অব লাইফ। যৌনতা তো জীবনকে জড়িয়ে আছে, এটাকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ আছে কি? উন্নত দেশে যৌনতা সম্পর্কে স্কুল থেকেই ধারণা দেয়া হয়। আমাদের দেশে এমনটি এখনো হয়ে ওঠেনি। বিষয়টিকে আমরা ঢেকে রাখছি। তা-ই বলে উন্নত দেশে যে, যৌন নির্যাতন হয় না,আমি একথা বলছি না। তবে আমাদের মতো এতো নরপশু নেই। ওদের কাছে যৌনতা সাধারণ একটি বিষয়। আসলেই তো সাধারণ, আমরা এটাকে অসাধারণ জটিল করে তুলি।আমার লেখা এপর্যন্ত সর্বশেষ বইটির নাম, ” শরীর ছোঁয়া প্রেম” বইটি ছেপেছে, আকাশ প্রকাশী সংস্হা। বইটির মূল বিষয় টিনএজ সেক্স। করোনা কালীন সময়ের কারনে বাঁধাই সংক্রান্ত জটিলতায়, বইটি বাজারজাত হচ্ছে না। বাঁধাই হলে অনলাইনে পাওয়া যাবে।
আমার লেখা ম্যানিয়া একটি ডকুমেন্টারি উপন্যাস। এ বইয়ে হিউম্যান সাইকোলজির জটিল কিছু বিষয় সহজ ভাবে উপস্হাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।এ উপন্যাসে জীবন জটিলতার, শব্দ ছবির চিত্র আঁকা হয়েছে।বলা হয়েছে, স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার কারণে সৃষ্ট মানসিক রোগের কথা। কুমারিত্ব, সতীত্ব, নৈতিকতা দ্বৈত ধারণা নিয়ে বলা হয়েছে,অনেক কথা। সাইকো এনালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড ঘোষণা করেছিলেন, এই মহা বিশ্বের সকল মানুষই তাঁর রোগী। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি নিজেও মানসিক রোগে ভুগছিলেন। আমরা সবাই কোনো না কোনো ম্যানিয়ায় আক্রান্ত। কেউ ছুটছি টাকার পেছনে, কেউ ছুটছি নারীর পেছনে,আবার কেউ ছুটছি ক্ষমতার পেছনে। তবে ছুটছি সবাই কোনো কোনোর পেছনে।
আমার কিশোর বয়সে প্রায়ই তো বাড়ি থেকে পালাতাম। সিলেটেও আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরিবারে সদস্যদের কাছ থেকে আত্ম গোপনেই ছিলাম। সিলেটের পরিবার গুলো অন্য সব জেলার পরিবার গুলো থেকে কিছুটা আলাদা বলা যায়। বাইরের কোনো লোক যতোই পরিচিত হোক না কেনো হুট করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। প্রায় সব মহিলারাই পর্দাশীল। বাইরের মানুষের সামনে কিছুতেই আসবেন না।
আমি ভবঘুরে মানুষ, তথাপিও তিনটি পরিবারের সাথে ছিলো ঘনিষ্ঠতা। আম্বর খানার আঃ মজিদ সাহেবের পুত্র আফিক, বিশ্বনাথ থানার আলম নগরের ইব্রাহীম সাহেবের পুত্র মোর্শেদ আলম লালু। যিনি লাল মিয়া, লালু নামে পরিচিত। এবং তাজ মহরমপুর গ্রামের হাজী প্রতাব আলী। মোছাব্বীর আলীর বাবা। মোঃআব্বাস আলী, রহমত আলী ও সেতাব আলীর বাবা। ঐ বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি রুমে আমি থাকতাম। সেতাব আলী চাঁদের মতো ফর্সা একটি ছোট্ট ছেলে, ওকে আমি সেতু বলেই, ডাকতাম। সেতু’ র বয়স ওসময় চার/ পাঁচ বছর হবে। প্রতাব আলী সাহেবের বড় কণ্যা মায়া, পুত্র মোছাব্বির আলী, আব্বাস আলী সাহেবের পুত্র রহমত আলী ও সেতাব আলী সেতু’ কে আমি পড়াতাম।ওদের পরিবারের আমি একজন সদস্যই ছিলাম, ওদের বাবা মা আমাকে সন্তানের মতোই দেখতেন। খাবার সময় হলে, ওঁদের সাথেই বেশির ভাগ সময়ই রান্নাঘরেই খেতাম। রান্নাঘরে খাবারের জন্য ভালো পরিবেশ ছিলো। সিলেটি ভাষায় ও ঘরটিকে দেরি ঘর বলে।লালুদের বাড়িতে বর্ষাকালীন সময়ে, লিলু ভাই, তাজা কৈ শিং ও পাবদা মাছ নিয়ে এলে, খালাম্মা সাতকরা দিয়ে রান্না করে খাওয়াতেন। উহ্ সে কি মজা!
আফিকও ছিলো, অনেকটা আমার মতো।ওর মা ছিলেন না, বোন জয়গুন আপা গরুর মাংস সাতকরা দিয়ে রান্না করতেন। আফিকের মেঝ ভাই সিরাজ,এবং সেঝ ভাই রফিক ভাইকে আমি খুব ভয় পেতাম।যদিও কোনোদিন কোনো কটু কথা বলেননি।আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। বিশ্বনাথ কলেজের প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছিল, রাম সুন্দর অগ্রগামি উচ্চ বিদ্যালয়ে।পরবর্তীতে কলেজের নিজস্ব ভবনে ক্লাস শুরু করতাম।তৎকালীন সময়ের প্রভাষক, (কলেজ প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম একজন) পরবর্তী অধ্যক্ষ। জনাব, সিরাজুল হক স্যার রোদের মধ্যেও কলেজ ভবনের ছাঁদে ক্লাস নিতেন। একদিকে ছাঁদ ঢালাইয়ের কাজ চলতো, অন্যদিকে ভূগোল ক্লাস করাতেন।আমাদের বাংলা ক্লাস করাতেন, ম্যাডাম শ্রীমতি তাপসী চক্রবর্তী লিপি। তিনিই বর্তমানে বিশ্বনাথ কলেজের অধ্যক্ষ।আমি যতোটা জানি বিশ্বনাথে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রদ্ধেয় সিরাজুল হক স্যারের অপরিসীম শ্রম ও মেধা দিতে হয়েছিলো। স্যারের বদৌলতে আমি বিশ্বনাথ কলেজে অধ্যায়ন করতে পেরেছি। স্যারই আমাকে সেতুদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্হা করেছিলেন। আমার শ্রেনী সাথী ছিলেন, শেখ আজাদ।দেখতে সুদর্শন, হাসি ভরা মুখ। এখন আর সে হাসি আছে কি না, জানি না।মাঝে কেটেছে অনেকটা দিন। যুক্তরাজ্যে ছিলেন,দীর্ঘদিন। রাজনীতির সাথে জড়িত। রাজনৈতিক মানুষরা অনেক সময় বদলে যায়।পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁদের বদলাতে বাধ্য করে। আমার সহপাঠী হিসেবে শেখ আজাদ ছিলো, অন্যতম। তাঁর বড় ভাই শেখ মনির।বিশ্বনাথ সদরে তাঁর একটি বড় দোকান ছিলো। মনির ভাই আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। মাঝে মধ্যেই আজাদের সাথে মনির ভাইয়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি। আজাদের কেনা ব্রিস্টল সিগারেট ফুকতাম। বিকেলে রশীদ পুর মোড়ে আড্ডা দিতাম।চা, সিগারেট শেখ আজাদই বেশি খাওয়াতো।আমি পাতার বিড়ি টানটাম। পাতার বিড়িতে টানমেরে একগাল ধূয়া ছাড়তাম 😃 ওহ্ বিড়ির সেই সুখ টান আজো আমাকে আনন্দের সাগরে ভাসায়। তাজমহরম পুর গ্রামের চেয়ে সিলেট শহরেই বেশি থাকতাম, সারদিন আড্ডা দিয়ে ।আম্বরখানা আফিকের বাসায় রাত কাটাতাম।রমজান মাসে ইসতারে আখনি খেতাম।পোলার চাল আর ছোলার ডাল মিলিয়ে, বিরিয়ানির মতো আখনি রান্না করা হতো। সিলেটের মানুষ ইফতারকে ইসতার বলেন। স্হানীয় ভাষায় আখনি। ইফতার সামগ্রী। শীতের গভীর রাতে আফিকুর রহমান আফিকের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে, জনাব রাজন মিয়া সাহেবের বাড়ির ভেতর থেকে চুপে, চুপে, আফিকের ঘরে ঢুকতাম। আফিকের বোন জয়গুন আপা ঘুম থেকে জেগে, আমাদের খাবার গরম করে খেতে দিতেন। সে ঋণ কোনোদিন, শোধকরা যাবে না।শুক্রবার দিন হজরত শাহজালাল( রা) মাজার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তাম।
আম্বরখানা দরগাগেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ভোলানন্দ নাইট স্কুল প্রাঙ্গনে সাহিত্যের আড্ডা করতাম।আফিকের বাড়ির বড় রাস্তার বিপরীতে আব্বাস মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আড্ডা হতো। আফিক, মূলত সংগঠক। একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন করার জন্য আমাকে প্রস্তাব করলো। বললো, তুমি একটি সুন্দর নাম দাও।চিন্তা ভাবনা করেই বললাম, ” ওয়েভস” নাম পছন্দ হলো।আমাদের আড্ডা চলছে, ইত্যাদির আফজাল ভাই, ছড়াকার আলী মোস্তফা সরকার, আব্দুল আলিম জুয়েল, সাব্বির আহমদ পাপ্পু, আব্দুল মুমিন নাঈম, ফাহিম আহমেদ, ফুজায়েল আহমেদ জুয়েল,হাবিব আহমেদ মহসিন প্রমুখ আড্ডা দিতেন।
মৃধা সোলেমান, শফিকুল ইসলাম চৌধুরীর সাথেও সখ্যতা হ’য়ে গেলো।আশির দশকের মাঝামাঝি, ছড়াকার সুফিয়ান,আহমেদ চৌধুরী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ফাতেহ ওসমানী, সেলিম আউয়াল, শফিকুলইসলাম চৌধুরী, মৃধা সোলেমান আলোচিত লেখক ছিলেন। মৃধা সোলেমান জেল খানার পাশাপাশি, একটি বাড়িতে থাকতেন।ঘরভরা শুধু বই আর পত্রিকা। তাঁর ঘরেই সাহিত্যের আড্ডা হতো। এছাড়াও জিন্দাবাজার,মুসলিম সাহিত্য কেন্দ্র, জল্লার পাড় সহ সিলেট শহরের বিভিন্ন এলাকায় সাহিত্যের আড্ডা হতো। সুরমা নদীর ওপারে, দক্ষিন সুরমার ভার্তখোলা, কবি দিলওয়ার সাহেবের বাড়িতেও আড্ডা হতো।কবি কিশোয়ার ইবনে দিলওয়ার আমার বন্ধু ছিলেন। যদিও বয়সে তিনি আমার বড় ছিলেন। শুধু সিলেটেই নয় তাঁর সাথে আড্ডা হতো ঢাকার শাহবাগে,আজিজ মার্কেটে,পাবলিক লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুল তলায়।কবি বদরুল হায়দার ভাইর সাথে তাঁর খুববেশি ঘনিষ্ঠতা ছিলো।
লিখতে হ’লে, পড়তে হবে।পড়ার কোনোই বিকল্প নেই। বিভিন্ন জার্নাল,বই- পত্র কিনে পড়ার মতো সামর্থ আমার ও সময়ে ছিলো না,বললেই চলে।মাঝে মধ্য খাবার না খেয়েও বইপত্র কিনতাম।প্রায় দিনই কলেজ থেকে ফিরে, সিলেটের বন্দর বাজারে পত্রিকার স্টল গুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখাতাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম।কিছুদিনের মধ্যেই ইসমাইল ভাই আর হাফিজ উল্লাহ ভাইয়ের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওনারা দুই ভাই লেখক সাংবাদিকদের সন্মান করতেন। যেদিন আমার লেখা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো, সে দিন আমার আগে, ওনারাই পড়ে ফেলতেন। পাঠকের মুখেও আলোচনা হতো।ও দিনের পত্রিকার দাম রাখতেন না।আমাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়াতেন।বিনে পয়সায় বই ও নানা ধরনের জার্নাল দিতেন।পুরানো ম্যাগাজিন দিতেন।ইসমাইল, আর হাফিজ উল্লাহ ভাই প্রতিদিন রোদ, বৃষ্টির মধ্যেই পত্রিকা বিক্রি করতেন। ও সময়ে বন্দর বাজারে হাজার, হাজার টাকার পত্র পত্রিকা বিক্রি হতো।
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় থাকাকালীন সময়ে পেশাগত কাজে, বহুবার আমি সিলেটে গিয়েছি। জিন্দা বাজারের অসংখ্য বইয়ের দোকানে,আম্বর খানা ইত্যাদি এবং সুলভ বই ঘরের দোকানে আমার লেখা, প্রচুর বই বিক্রি হতো।সুলভ বইঘরে ঢাকার বাংলা বাজার থেকে মান্নান ভাই, বই নিয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বিক্রি করতেন।
ইসমাইল, হাফিজ, মন্নান এবং ইত্যাদির আফজাল ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই 💕
আবার আসি পেছনে, ৮৬/৮৭ সালে। আফিক আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করবো।নাম করণ করলাম “নব লগ্ন”। আমি ও সময় আম্বরখানার নজরুল ইসলাম ভাইয়ের মেয়ে লিজা’ কে পড়াতাম।মিসেস নজরুল আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। প্রাপ্তি টাকার চেয়েও বেশি দিতেন। আমরা কিছু টাকা যোগার করলাম। স্হানীয় পত্রিকায় লেখা আহবানের জন্য প্রেস রিলিজ দিলাম।অল্পদিনেই লেখা সংগ্রহ হলো। তবে কাগজ কেনা,ছাপা খরচ কোথায় পাবো! তৎকালীন সিলেটের এস পি ছিলেন, নজরুল ইসলাম সাহেব। আমি আর আফিক এস পি সাহেবের কাছে গেলাম।এস পি সাহেব জানতে চাইলেন, কি কারনে আসছি! আমি বললাম একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করবো,আমাদের কাছে টাকা নেই। তিনি হাসলেন। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,চলো! আমরা তাঁর পিছু হেটে তাঁর বাসায় পৌছলাম। ড্রইং রুমে আমাদের বসিয়ে, আবার তাঁর স্ত্রী কে নিয়ে, আমাদের পাশে এসে বসলেন। বললেন, বাহ্ ভেরিগুড তোমরা সাহিত্য চর্চা করো।তাঁর স্ত্রী, আমাদের অনেক আদর, যত্নকরে চা নাস্তা খাওয়িয়ে দুই হাজার টাকা ভরে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন।অধ্যাপক সিরাজুল হক স্যারকে বললে,স্যার আমাদের আলফাহ ব্রিকস এর একটি বিজ্ঞাপন সহ নগদ টাকা দিলেন। তখন মধুবন মার্কেটের নির্মাণ কাজ চলছিলো, রাগিব আলী সাহেব একটি জেট ডিটারজেন পাউডারের বিজ্ঞান দিলেন। আমরা জিন্দাবাজার প্রেসথেকে নব লগ্ন সাহিত্য পত্রিকা বের করলাম।
সিলেটে সবচেয়ে সোনালী দিন গুলো কেটেছে, লালু আর আফিকের সাথে। আমরা মাঝে মধ্যেই ঢাকায় আসতাম।আফিকের বড়ভাই প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী এম এ রউফ সাহেব,ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরির স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস করতেন। ভাতিজি রিমি,রুমা। রিমির বিয়ে হয়, সিলেটের খান্দানী পরিবারে। বর নজরুল ইসলাম বারেক। বৃটিশ কুটনৈতিক আনোয়ার চৌধুরী সাহেবের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। রিমি’ র বর বারেক আমাদের বন্ধু হয়ে যায়।আমাদের জীবনে নজরুল ইসলাম বারেকে’র অবদানও ভোলার মতো নয়।
একদিন আমি আর লালু গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। হকারদের ডাকাডাকি, ডিভি লটারি! কে যাবেন আমেরিকা! আমি হাটছি তো হাঁটছিই। লালু দাঁড়ালো। পেছন থেকে লালু বড় গলায় বললো।এ ই খারা! হালার, হালা! আমি থমকে দাঁড়াই, পেছনে ফিরে দেখি। দু’টো ডিভি লটারির ফরম কিনছে।আমি কোনোই মন্তব্য করিনি।আমি তখন ক্রেজি সাংবাদিক। মাথার মধ্যে নানা বিষয় ঘুরছে।
৮৮/৮৯ সালে হবে হয়তো, সালটা ঠিক মনে নেই। আমার সাংবাদিকতা শুরু র দিকের কথা। রাতে আমাদের তিলপাপাড়া বাসায় এলে, আমাকে ফরম পূরণ করতে বলে।আমি ফরমটি হাতে নিয়ে ফ্রিজের উপরে রেখে দেই।
অনেকটা দিন পর লালু জানালো,তাঁর আমেরিকার ভিসা হয়েগেছে। আমেরিকা যাবে, স্বপ্নে বিভোর।আমার কোনো স্বপ্ন নেই, ছিলো না, কোনো দিন। যাবার আগে ঢাকায় ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। লালু পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।ওর কাছে আবেগের কোনো মূল্য নেই। বাস্তবতা। জীবন গড়ার স্বপ্ন। তিনি লাল মিয়া লালু।আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলো। আমেরিকার লাল,নীল,সবুজ রঙে জীবন মিলে একাকার হলো। আমি এখনো সে পথেই পরে আছি। আমার জীবনও, ধন দৌলত হীন রঙিন।
প্রতি মানুষের জীবন জুড়ে যৌবন আসে।প্রথম ভালো বাসা,ভালোলাগা আমারও হয়েছিল এমনটি। রঙিন প্রজাপতির মতো।এ জন্যই লেখাটি শুরু ক’রে ছিলাম, টিন এজ সেক্স নিয়ে। যৌবনের জ্বালা আছে,ছিলো। অপরিণত বয়সেও এটাকে দমন করেছি,পরিপূর্ণ বয়সেও। এখানে সেখানে যৌবন জ্বালা মেটানোটা একটি মানসিক রোগ। ধর্মীয়, সামাজিক বিধিবিধান অনেকেই মেনে চলেন।বংশীয়, সন্মানিত ঘরের মানুষের মধ্যে বেশি-ই মেনে চলতে হয়।নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়। যারা অবৈধ পন্থায়, অন্যায় ভাবে যৌন কর্ম করে, তারা পশুর সমান।
সিলেটে থাকাকালীন সময়ে, যে সব পরিবারের সাথে আমার সখ্যতা ছিলো, তাঁরা সবাই অভিজাত পরিবারের সন্তান। যৌন সংক্রান্ত নোংরামী এঁদের কারো, মধ্যেই ছিলো না। সেহেতু এ বিষয়, আমাদের কারো মধ্যেই আলাপ আলোচনা হতো না।আমার ভালো লেগেছিলো একটি মেয়েকে। ওর নাম রোজি।রোজিও আমাকে পছন্দ করতো।আমাদের দেখা হতো, কথা হতো বিশ্বনাথে। তবে কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি।বিষয়টি লালু জানতো।একদিন লালুকে বললাম,চল রোজিদের বাড়িতে যাই।লালু বললো,যাবো।তবে আগে পাখি ধরবো।ওর মাথায় তখন পাখি শিকারের ধান্ধা।লালুদের উপ শহরে একটি বাড়ি ছিলো।ওর বড় ভাই খোরশেদ আলম সাহেব ব্যাংকার থাকাকালীন, সময়ে বাড়িটি বানিয়ে ছিলেন।পরবর্তীতে তিনি লন্ডনে চলে যান। সিলেট উপ শহরে তখন সর্বোচ্চ বিশ/ ত্রিশটি, বাড়ি ছিলো। আনা মিয়া নামের একজন লন্ডন প্রবাসীর সুন্দর একটা বাড়ি ছিলো। শুধু ধূ ধূ ফাকা মাঠ, চার দিকেই ফাঁকা, ফাঁকা। লালু জাল ও নানা ধরনের, ফাঁদ পেতে পাখি শিকারে নেমে গেলো।ওর সাথে আমি আর দুই ছোট্ট ভাতিজা সাদেক আর সাহেদ।রোদের মধ্যে আমরা লালুর পিছু দৌড়াচ্ছি আর লালু পাখি ধরছে।সাদেক, সাহেদ আর আমি যে,কি খুশি। এ দিকে ভাবী ডাকছেন,সাদেক সাহেদকে। ওঁদের নিয়ে ভাবী তাঁর বাবার বাড়ি যাবেন। কে শোনে, কার কথা।আমি সাদেক, সাহেদকে ভাবীর কাছে ধরে নিয়ে এলাম। ভাবী বাড়িতে তালা লাগিয়ে ওদের নিয়ে চলে গেলেন।যাবার সময়, বাড়ির তালার চাবি,লালুর হাতে দিয়ে গেলেন।লালু আর আমি অনেক গুলো পাখি একটি ঝুড়ির মধ্যে রাখলাম। সারাদিন মিরাবাজার,বন্দর বাজারে আড্ডা দিয়ে, বিকেলে এলাম রশীদ পুর। কিছুটা সময় রশীদ পুরে আড্ডা, পরে চলে এলাম নাজিরা বাজারে। নাজিরা বাজারের অদূরে রোজিদের বাড়ি।ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে, ওর ছোট ভাই জাকারিয়া বলে,ডাক দিতেই, রোজি বেরিয়ে এলো। একগাল হেঁসে আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে বসালো। রোজির ভাই বোন মা সবাই মিলে,গল্পকরে ফিরে এলাম উপশহরের বাড়িতে। গভীর রাত খাবো কি! ভাবী তো জানতেন, না। আমরা রাতে থাকবো! লালু বললো, চিন্তা করিস না! খাবার ব্যবস্হা করছি।লালু পাখি গুলো জবাই করলো। ভালোভাবে কেটেকুটে, ধূয়ে হলুদ,মরিচ, লবন মেখে তেলে ভেজে ফেললো। খেলাম খু উ ব মাজা করে। আহ্ কি মজা!
শেষ রাতের দিকে, আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।
– নাসিম আনোয়ার
লেখক, সাংবাদিক