জেলগেটে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব শেষ হোলো তিন দিন পর। এই তিন দিন প্রতিদিন প্রায় একই কথা। গোলাম মোস্তফা এবং অস্ত্রের সন্ধান দিতে হবে। জনাব গোলাম মোস্তফা সে সময়ে ছিলেন ঝিনেদা জেলা জাসদের সভাপতি এবং ঝিনেদা জেলা গণবাহিনী প্রধান। এবং প্রতিপক্ষের চোখে তিনি একজন দুর্ধর্ষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমরা ছিলাম তার রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র সহযোদ্ধা। তাহলে আমি কেন এই গোলাম মোস্তফার সন্ধান দিতে পারবো না বা অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারবো না,তা বুঝতে ভদ্রলোক অপারগ। তিনি বলতে থাকলেন,” আপনার চালাকির একটা সীমা থাকা উচিৎ। এই সমস্ত চালাকি আমি অনেক দেখেছি, এসব তৈরি করা কথা শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।” গোয়েন্দা অফিসার আমার জন্য প্রতিদিন তৈরি করছে ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। এখানে দুটো কথার মাধ্যমে সেই যন্ত্রনাদায়ক পরিস্থিতির বর্ননা করা সম্ভবই নয়। বা তা প্রকাশ করা বেশ কঠিন। যা ঘটেছে আমি এখানে তার সিকি ভাগও বলতে পারলাম না। জনাব দেলোয়ার হোসেন ক্রমেই হয়ে উঠছিলেন বেপরোয়া এবং অসহিষ্ণু। তিনি কখনো টেবিলে পেপার ওয়েট ঠুকছেন, কখনো উঠে পায়চারি করছেন,কখনো বা আমাকে ঘিরে টেবিলে দুই হাত রেখে আমার দিকে ঝুঁকে ধমকের সুরে বলছেন,সত্য কথা না বলে আপনি কোনো পার পাবেন না। ঐ সময় আমার মনে হয়েছিলো আমি যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। আমি যেন মানুষ না। ভদ্রলোক আমার শরীরের চামড়া তুলে লবন দিতে পারলেই মনে হয় খুশি হতেন বেশি। সে সময় প্রতি মুহূর্তে আমাকে একটা নির্মম চেহারার মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। এবং সেই চোখের দিকে তাকিয়েই আমাকে বলতে হয়েছে এমন সব কথা,তাতে প্রতিপক্ষের কোনো চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আমার তখন মনে হতে লাগলো ধীরে ধীরে দেলোয়ার সাহেব যেন তার হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আমার মনে হোলো তিনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন। তবে আমার অনুমান যে সঠিক নয় তা তিনি আমার দিকে একবার ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও আমি বুঝতে পারলাম,তিনি একটু শান্ত হয়ে এসেছেন। তখন তার সেই উদ্ধত দাম্ভিক আচরণে কিছুটা ভাটা পড়েছে মনে হোলো। হতে পারে তখন তিনি ভাবছিলেন নতুন কী উপায়ে আবার আমার দিকে তীর ছোড়া যায়। ভদ্রলোকের অনুমতি নিয়ে-পরিস্থিতি বুঝে আমি আমার আত্মগোপন থাকাকালীন সময়ের গল্প বলতে চাইলাম। এর আগে কথা শুনে,চুপ ক’রে থাকার চেষ্টা করেছি। সব সময় আমাকে এগোতে হচ্ছিলো কীভাবে সময় পার করা যায় এই চিন্তা ক’রে। আমার এবার মনে হলো তথ্যবিহীন কিছু সত্য গল্প বলি। তাতে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাতে পারে। এভাবে কিছুটা সময় পার করা যাবে। তাছাড়া এভাবে যদি তার কথা বলার মোড় ঘোরানো যায়। আমার চিন্তাটা একেবারে বিফলে যায়নি। আমি গল্প বলা শুরু করলাম। তবে তা বাড়ির গল্প নয়। আমার সশস্ত্র জীবনের সব গল্প। কেন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম,গ্রামের মানুষই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে দুই একজন মানুষের ব্যাপার নয়। অসংখ্য মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। সব গল্পই সত্যি,কিন্তু সে গল্প গোয়েন্দা অফিসারের চাহিদা পূরণ করবার মতো নয়। কারণ সে গল্পের মধ্যে কোনো থাকছিলো না। কিন্তু তিনি গল্প বলতে আমাকে কোনো বাধা দিচ্ছিলেন না। বরং তা শুনছিলেন মন দিয়ে। হয়তো এই ভেবে যে,গল্পের মধ্য থেকেও যদি কোনো তথ্য বেরিয়ে আসে,মন্দ কী। আমাকে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়েছে,গল্প যেন শুধু গল্পই হয়। তার মধ্যে যেন সামান্য তথ্যও না থাকে। যদিও গল্পের মাঝখানে আমাকে হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করা হচ্ছিলো। হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো আমাকে। কখনো ভদ্রলোক রেগে যাওয়ার ভান করেছেন। অথবা অধৈর্য হয়ে রেগে হয়তো যাচ্ছেনও। তিনি হুমকির মতো ক’রে বলছেন,এখন ঠিকঠাক মতো না বললে আপনি বড় ধরণের বিপদে পড়ে যাবেন। কয়েদখানায় আসবার পর আমি এই প্রথম হেসেছিলাম। হেসে বলেছিলাম, “আমি তো বড় বিপদেই আছি। আমি জানিনা আমার মেয়ে কেমন আছে। গ্রেফতার হয়েছি দুইদিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মা এখনো জানেনা আমি কোথায় আছি,কেমন আছি।”এর থেকে বড় বিপদ আর কী হতে পারে বলেন ? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন সে বিপদ হলে বুঝবেন তা কত বড় বিপদ। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে,আবার অনুমতি নিয়ে ঢুকে গেলাম সেই গল্পে। আমার জীবনের বিপদসংকুল পথ পাড়ি দেওয়ার সব রোমাঞ্চকর গল্প। রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার গল্প। রক্ষীবাহিনীর তাড়া খেয়ে কীভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রাম থেকে গ্রামে এবং পথে পথে সে গল্প। রক্ষীবাহিনী দ্বারা আমার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথাও উঠে এলো এই গল্পে। এই গল্পে জায়গা পেলো আমার ছোট্ট মেয়েটাও। আমি যেমন গল্প বলছিলাম,সেই সঙ্গে চেষ্টা করছিলাম, ভদ্রলোকের মনের উপর প্রভাব ফেলতে। যেন তিনি আমার প্রতি কিছুটা সদয় হন্। মাঝে মাঝে নিজের মনেই ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম,গোয়েন্দার রক্তচক্ষুর সামনে কোনো বেসামাল কথা বলে ফেললাম কিনা। পরের দিনও আমার সময় কাটলো গত দুইদিনের মতোই। কখনো শুনছি,কখনো ধমক খাচ্ছি,আবার কখনো নিজে ভয়ও পেয়ে যাচ্ছি। ভাবছি এইবার বুঝি আমার তরী ডুবল। এতো কিছুর মধ্যে বার বার মনে করবার চেষ্টা করলাম,আমি কোনো তথ্যমূলক কথা বলে ফেলেছি কিনা। তিনদিনের মাথায় জেরাপর্ব শেষ হওয়ার পর আমাকে জানানো হোলো-জিজ্ঞাসাবাদ আর করা হবেনা-আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের এখানেই সমাপ্তি টানা হচ্ছে। তখন এক ধরণের প্রশান্তির বাতাস যেন আমার উপর দিয়ে বয়ে গেলো। অদ্ভুত ভাবে কোনো ধরণের অস্থিরতাও আমি অনুভব করলাম না। তখন একটা কথাই মনে হয়েছে,আমি আমার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতে পেরেছি তো? ভেবে দেখলাম হ্যাঁ ঠিকঠাকই সব কিছু বলতে পেরেছি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তখন উঠে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তে আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার স্থান কাল। হঠাৎ নিজেকে খুব একা এবং নিঃসঙ্গ লাগছিলো। আমার মেয়ের কচি মুখটা তখন আমার সামনে যেন এমনিতেই ভেসে উঠেছিলো। এই তিনদিনে এমন পরিষ্কার ভাবে এই প্রথম ওর কথা আমার মনে হোল। এর আগেও মনে হয়েছে, কিন্তু আজ যেন ওকে আমি দেখতে পেলাম। তখন আমার মনে হয়েছিলো আমি হাটতে পারবো না। আমি আজও জানিনা যুদ্ধরত কোনো মায়ের তার আত্মজার জন্য কষ্ট পেতে হয় কিনা! কিন্তু আমি যে কষ্ট পেয়েছিলাম,তাও তো অস্বীকার করতে পারবো না। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখ দুটো সেদিন ঝাপসা হয়ে এসেছিলো। সেই ঝাপসা চোখের সামনে অস্পষ্ট হয়ে দূরে সরে গেলো আমার মেয়ের মুখটা। আজ অন্য একজন ডেপুটি জেলর আমাকে ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন একজন মহিলা জেল পুলিশ। আমার মধ্যে অন্যদিনের মতো দ্রুত যাওয়ার কোনো আগ্রহ না দেখে ডেপুটি জেলর সাহেব বললেন, আমরা তো আপনাকে ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার ভিতরে দেখি কোনো তাড়া নেই। ওয়ার্ডে যান,গিয়ে বিশ্রাম নেন্। আপনার জিজ্ঞাসাবাদ তো শেষ।
রাতে অনেকটা ভার এবং ভয় মুক্ত হয়ে সালেহা আপার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলাম। তখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছাও করছিলো না, ভাবতে পারছিলামও না। কিন্তু দেলোয়ার সাহেবের সেই হম্বিতম্বির কথা নিজেই বলছিলাম। আবার নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ছিলাম। এইভাবে গল্প হাসি আনন্দে সময় পার ক’রে খেয়েদেয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চিরকালই ঘুমাতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু সেই ঘুমাতেই আমি কোনোদিন পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে গত তিনদিনের ঝড়ের কথা ভাবছিলাম। মনে মনে এই ভেবে ভালো লাগছিলো,বেশ ভালো ভাবেই জিজ্ঞাসাবাদের পর্বটা অতিক্রম করতে পেরেছি। এবার ইচ্ছা করেই মা এবং মেয়ে কথা ভাবতে বসেছিলাম। মনে হোলো আমার মা,আমার মেয়েকে বুকে নিয়ে যন্ত্রনাদায়ক নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। কারণ আমার মা এখনো জানেন না আমি কোথায় আছি। আমার সঙ্গে বাইরে থেকে তখনো কারোর যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছিলো না। আমার মামা মাহ্মুদুল হক নিজের চেষ্টায় জেনেছিলেন আমার অবস্থান। একজন সাংবাদিক হিসেবে সেই দক্ষতা আমার মামার ছিল। এবং আমার মামার বাড়িও যশোরেই। জনাব মাহ্দুেরল হক যশোরেই অবস্থান করতেন। আমার গ্রেফতারের খবর,আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই গোলাম মোস্তফা যেভাবেই হোক আমার মামার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো প্রথম দিনই। আমার মামা যে আমার অবস্থান জানেন,তিনি আমার মাকে তা জানাননি। মামা আমার জন্য যখন যশোর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন,তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা নিষেধ ক’রে দেওয়া হয়েছিলো। আমার জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালিন সময়ে যেন আমার অবস্থান বাইরে কোথাও না জানানো হয়। নানা দিক বিবেচনা ক’রে আমার মামাও মাকে আমার অবস্থা জানাননি। কিন্তু তিনি নিজে আমার জন্য ছিলেন খুবই তৎপর। আমি এসব জেনেছি পরে কোনো একদিন। মা মেয়ে এবং বাইরের নানা কিছু নিয়ে যখন আমি ভাবছি,তখন একজন মেয়ে আমার সামনে এসে দুই হাত জোড় ক’রে প্রণাম ক’রে বললো আমি বাপ্পি। সালেহা আপা পাশে বসেই কিছু একটা পড়ছিলেন। তিনি মুখ তুলে বল্লেন,এ তিনদিন তোকে বিরক্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিলো। তাই ওকে দেখিস নি। ও বাপ্পি, অন্য একটা মামলায় এখানে বন্দী আছে। বাপ্পি ভালো গান গাইতে পারে। বাপ্পি ছিলো সুন্দরী এবং সুসাস্থের অধিকারী একটা মেয়ে। ওকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আমার মনে হোলো বাপ্পি মানুষটাও ভালো। বাপ্পি আমি সালেহা আপা সহ তখন গল্প করছি। আসে পাশেও কেউ কেউ এসেও দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময় যমদুতের মতো জেলগেট থেকে জমাদ্দার এসে হাজির আমার কাছে। গতকাল বিকালেই কেবল আমার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। সেই ধকল এখনো আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শরীর আর মন নিয়ে যেন ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আছি আমি। তারপরও আমাকে একটা দিনও সময় দেওয়া হোলো না। আর একটা দিনও আমি সময় পেলাম না। আবার এলো নতুন সমন,নতুন আতংক নিয়ে। জেলগেট থেকে খবর এসেছে গোয়েন্দা বিভাগের লোক আমার সঙ্গে আবার কথা বলতে চায়। এবং এখনি।
# চলবে
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী