সালেহা আপা চলে যাওয়াতে একটা বড় ধরণের ধাক্কা আমি খেলাম এটা ঠিক। কিন্তু আমার সমস্ত একাকীত্ব আর শুন্যতা ডিঙিয়ে,আমার সারা জীবনের যে অভ্যাস আমি সেই দিকেই ফিরে তাকালাম। আমি এবার তাকাতে চাইলাম নিজের অভ্যাসের দিকে,নিজের আনন্দের দিকে। আমি আনন্দের উৎস খুজে বের করতে কাছাকাছি গেলাম সাধারণ বন্দীদের। আমি এ কয়দিনে আসলে এভাবে ভাবিনি। আনন্দও কখনো কখনো খুঁজে নিতে হয়। প্রায় ২৮০ জন নারী বন্দী আছেন এখানে। আছে ওদের ছোট ছোট বাচ্চারাও। অবশ্য আমি সময়ও পাইনি ওদের কাছাকাছি যাওয়ার। আমরা ডেকে কথা বললে,ওদের কতো যে কথা-তা ভাবা যায় না। আমি ওখানকার বাচ্চা,বাচ্চাদের মা-তাদের সঙ্গে ভালোভাবেই ভাব জমিয়ে নিয়েছিলাম। আমার উপর নেমে আসা বিষাদের ছায়া কোথায় যে চলে গেলো। আমি জড়িয়ে পড়লাম ওদের সুখ দুঃখের সঙ্গে। ওদেরও আছে হাজারো সুখ দুঃখের কাহিনী। ওরা কেউ এসেছে সত্যিকারের অভিযুক্ত হয়ে। আবার অনেকে আছে যারা সত্যিকারের অভিযুক্ত না হয়েও দণ্ড খাটছে বছরের পর বছর। শেফালি ঘোষ নামে একজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিলো। ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলো মেয়েটা। অথচ সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার একেবারেই সম্পর্ক ছিলো না। মামা ভাগ্নের ব্যবসা ছিলো। একদিন মামা খুন হয়ে গেলো। সেই খুনের অপরাধে শেফালি ঘোষ গ্রেফতার,ফাঁসির দণ্ড। অতঃপর যাবজ্জীবন জেল। এভাবে আমি সুযোগ পেলেই এক একজন নারী বন্দীর দণ্ডের কারণ জানতে চাইতাম। এ রকম যাদের পেয়েছি,সে সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার এ বিশ্বাস জন্মেছিলো,সে সব কথা সবই সত্যি। কারন ওদের জীবনের যা হবার হয়ে গেছে। আজ তারা সব কিছু চাওয়া পাওয়ার উর্ধে। অনেকের বাড়ি তাদের ত্যাগ করেছে। এমন দুই একটা ঘটনা দেখেছি,সন্তান পর্যন্ত মাকে ঘৃনা করে। এবং আর কোনোদিন হয়তো সন্তানের সেই ভুল ভাঙবেনা। তবে কী পাওয়ার আশায় আজ তারা নিজেদের কর্ম লুকাবে! তাদের আজ আর কোনো মিথ্যা কথা বলবার দরকারই নেই। কারাগার বিশেষ ক’রে মহিলা কারাগার নিয়ে যদি কোনো তুলনা করি,তবে তা কিছুতেই স্বাধীন জীবনের সব থেকে নিকৃষ্ট জীবনের সঙ্গেও তুলনা করা যায় না। আমাদের মুক্ত জীবনেরও কতো সব নিকৃষ্ট কাণ্ডকারখানা আছে,আমরা তো তা জানি। কিন্তু তারপরেও জেলবন্দী মানুষের কোনো সামান্য দুঃখের সঙ্গেও তা মিলানো যাবে না। বন্দী নারীদের জীবন যে কতোটা ভয়াবহ তা একমাত্র প্রত্যক্ষ্যদর্শীর পক্ষেই বোঝা সম্ভব। বাইরে থেকে তা কল্পনা করবার সাধ্যই আমাদের নেই। কারাগারের নিকৃষ্ট জীবন এক দল মানুষকে সদা সন্ত্রস্ত ভিরু প্রাণীতে পরিণত করেছে।জেলবন্দী মানুষদের সকাল শুরু হয়,যেন একপাল হরিণকে বাঘে তাড়া করবার ভয় নিয়ে। ওরা মেট্রনের মন রক্ষা করে। জমাদ্দার্নীর মন রক্ষা করে। মেট পদধারি কয়েদীদের মনও ওদের রক্ষা করতে হয় ওদের। কারণে অকারণে সাধারণ বন্দীদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা কারাগারের মহিলা ওয়ার্ডে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। আমার সময় যশোর কারাগারে শেফালি পাণ্ডে নামে একজন মেট ছিলো। এই শেফালী পাণ্ডে সাধারণ বন্দীদের সামনে ছিলো সাক্ষাৎ জল্লাদ। শেফালী পাণ্ডের হাতে একটা মোটা বেত তুলে দিয়ে মেট্রন জমাদ্দার্নীরা কতো নিরীহ বন্দীদের পিঠ যে রক্তাক্ত করেছে,সে তালিকা দিলে তা আলাদা ক’রে লিখতে হবে। এবং সে নির্যাতন কেবল চোখে দেখেই বিশ্বাস করা সম্ভব। কনক নামে ২৪/২৫ বছরের একজন মেয়ে একদিন আমার কাছে এলো। আমি দেখলাম ওর চোখ ভরা জল। কিন্তু জোরেও সে কাঁদতে পারছে না। জিজ্ঞাসা করবার পর কনক জানালো আজ দুপুরের পর শেফালী পাণ্ডে ওকে সেই মোটা বেত দিয়ে মারবে। আমি বললাম তুমি এখন যাও,সময় আসুক। এই বলে দ্রুত কনককে বিদায় ক’রে দিলাম। আমার কাছে এসেছে জানতে পারলে আরও সমস্যায় কনক পড়বে বলে মনে হয়েছিলো আমার। আমরা রাজবন্দী হওয়ার কারনে আমাদের বাড়তি কিছু সুবিধা থাকে তা অনেক পাঠকই জানেন। আমি বা আমরা কখনো কখনো সেই সুবিধা কাজে লাগাতাম। কনককে শাস্তি দেওয়ার সময় যখন ঘনিয়ে এলো,ওকে ওয়ার্ডের খোলা জায়গায় একটা কুল গাছের সঙ্গে এমন ক’রে বাধা হোলো যেন পিঠে মারতে সুবিধা হয়। শেফালী পাণ্ডে বেত হাতে হাজির। কুলসুম জমাদ্দার্নীও উপস্থিত হোলো সেখানে। আমি সবই দেখছিলাম দূরে বসে। শেষে আমি নিজেও এক পা-দুই পা ক’রে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে আমার যাওয়া সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না। কারণ আমার বা আমাদের জন্য সব নিয়ম কানুনই আলাদা। কিন্তু আমি গেলে বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও ওদের নেই। আমি সেখানে গিয়ে ইচ্ছা ক’রেই শেফালী পাণ্ডের সঙ্গে এক কথায় দুই কথায় কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লাম। যদিও শেফালী হুকুমের দাস। আসল হুকুমদাতা মেট্রন এবং জমাদ্দার্নীরা। সেদিনের হুকুমদাতা ছিলো কুলসুম জমাদ্দার্নী। আমাকে দেখাশুনা করা মেয়েটা মাজেদার মাধ্যমে ইতিমধ্যে আরও কিছু জেনেছি। আমি সব জেনেই শেফালীর সঙ্গে কথায় জড়ালাম। কারন পুলিশের সঙ্গে ওখানে বচসায় জড়ালে ঝামেলা আছে। শেফালীকে অনেক কথাই বলা সম্ভব। যা জেল স্টাফদের বলা যাবে না। তাছাড়া তখন আমি একা। শেফালীকে সরাসরিই বললাম,কনকের শাস্তিটা সুবেদার সাহেবের সামনে হতে হবে। শেফালী সাফ জানিয়ে দিলো এসব শাস্তির ব্যাপারে হুজুরদের হুকুম আছে। আমিও সাফ জানিয়ে দিলাম,হুকুম থাকলেও আজ তিনি নিজে দেখুক। তা না হলে আমি এক্ষুনি অফিস কলের জন্য গেট জমাদ্দারকে বলবো। আমরা সমস্যায় পড়লে এ ধরনের আবেদন করতে পারতাম। আমি তারপর বললাম,শাস্তি আর কারণে অকারণে অত্যচার এক নয়। আজ সুবেদার সাহেবকে সেই অত্যাচার চোখে দেখে যেতে হবে। এইভাবে কথা কাটাকাটি একটু জটিলই হয়ে উঠলো। তখনও আমি জমাদ্দার্নীকে কিছু না বলে শেফালীর সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছি। কুলসুম জমাদ্দার্নী এতক্ষন পিছনে হাত দিয়ে দারোগার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। ভাবখানা যেন তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না। যেন তিনি আমার মতোই দেখতে এসেছেন ঘটনাটা। জমাদ্দার্নী যখন বুঝতে পারলো সুবেদার সাহেবকে জানানোর ব্যাপারে আমি অনড়,তখন সে নিজেই হস্তক্ষেপ ক’রে কনকের বাধা হাত খুলে দিতে বললো। তারপর কনকের দিকে তাকিয়ে বললো মেটদের অবাধ্য হয়েছিস আর যেন না শুনি। মেট্রন এতক্ষন ঘরে তার বসার জায়াগায় বসে ছিলো। ভাবখানা তিনিও কিছুই শোনেননি। আপাতত সমাধান হয়ে গেলো। কনকের উপর আর অত্যাচার হোলো না। যশোর কারাগারে তখন প্রতি বুধবার ডি আই জি সাহেব সহ জেলর সাহেব মহিলা ওয়ার্ডে আসতেন বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা জানতে। জেলর বা ডি আই জি পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব ছোটখাটো ঘটনা মনে হয় জানতেন না। বা খেয়াল করতেন না। সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে,আমি বা আমার মতো কোনো বিশেষ বন্দী থাকলে, কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে আলাদা ক’রে কথা বলে যেতেন। কথা না থাকলে অন্তত সুবিধা অসুবিধা জেনে যেতেন। এবার আমি ওইদিনের কনকের ঘটনাটা বলেছিলাম। তারা শুনে তখনই কোনো কথা বলেননি ঠিকই। কিন্তু এরপর মহিলা ওয়ার্ডে যেন শান্তির বাতাস বইতে লাগলো। সেই ঘটনার পর আমি দেখেছিলাম,১০/১২ জন ছাড়া বাকি প্রায় ২৫০ জন বন্দীর খুশি হওয়া চেহারা। কারণ এদের প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় এই মারপিটের শিকার হয়েছে। তবে পরিস্থিতি শান্ত হলেও এবার আমার জন্য তৈরি হোলো অন্য ধরণের শাস্তি। এখন আমার সঙ্গে অন্যান্য বন্দীরা কথা বলা বন্ধ ক’রে দিলো। বাচ্চারাও এখন আর আমার কাছে আসেনা। অন্যদের সাবধানে জিজ্ঞাসা ক’রে জানতে পারলাম,মেট্রন নিজে মৌখিকভাবে এই নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া আমাদের মতো বন্দীদের আর কিছু বলা বা করার ক্ষমতা মেট্রন জমাদ্দার্নীর ছিলো না। বড় জোর আর পারতো সেল বন্দী ক’রে রাখতে। তা করতে পারতো আবার বড় কর্মকর্তারা। সে ক্ষমতা এদের নেই। আমি যখন একেবারেই একা,তখন আমাকে দেখাশুনা করতো মাজেদা নামের যে মেয়েটস। সেই শুধু আমার কাছে আসতে পারতো। আমি ওর মাধ্যমে অনেকের খবর নিতাম। এদিকে আমার প্রথম পরিচিত বাপ্পিও একদিন কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে আর ফিরে এলোনা। সম্ভবত ও মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলো। এবার আমি একা পড়াশুনা ক’রে সময় কাটাতে লাগলাম। যারা যশোর কারাগার সম্পর্কে জানেন,তাদের জানার কথা যশোর কারাগারের লাইব্রেরীর বইয়ের সংগ্রহ বেশ ভালো। আমি অত পড়ুয়া নই। কিন্তু বিপদে পড়ে শেষ পর্যন্ত বইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো সৈয়দ মুজতবা আলীর বই পড়বার।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো তারপরেও মা এবং মেয়ের খবর এখনো আমি পাইনি। বাড়ি থেকে কেউ দেখা করতেও এলো না। এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে যখন মন খারাপ ক’রে দিন পার করছি। তখন একদিন এলো অফিস কল্। অফিসে গিয়ে দেখি আমার মা বসে আছেন আমার মেয়েকে নিয়ে। ডিভিশন প্রাপ্ত বন্দীদের বাইরের সঙ্গে দেখা করানোর একটা ভাল পরিবেশ রাখা হয়। তা অনেকেরই জানা। আমার জন্যও তা রাখা হয়েছিলো। অনেক ঝামেলা করেই মাকে আসতে হয়েছে। আমাদের দেখার অনুমতি দিতেন জেলা প্রসাশক সাহেব। এটা মায়ের জন্য একটা বিড়ম্বনা। উপায় ও নেই। আমাদের বসানো হয়েছে অফিস রুমেই একটু নিরিবিলি জায়গায়। এবং সেখানে একজন গোয়েন্দা পুলিশও আছেন। আমাদের জন্য এটাই নিয়ম। আমাদের কথা বলবার সময় গোয়েন্দার লোক থাকবে। আমি দেখলাম আমার মায়ের চেহারা রীতিমত বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমার মেয়ের শরীরের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। আমার জন্য ছিলো সে এক দুর্বিষহ দিন। আমার মনে হতে লাগলো আমার মা আর মেয়ে যেন উঠে এসেছে কোনো এক ধ্বংসস্তুপ থেকে। মাত্র এই কয়দিনে মানুষের এই চেহারা হতে পারে! আমি তখন কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার মায়ের সেই দুঃসহ দিনের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না আমি। মা শুধু বললেন তোমার মামা না জানালে আমি জানতে পারতাম না তুমি কোথায় আছো। কতো জায়গায় যে গিয়েছি তোমার জন্য! আমাকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছিলো। আমাকে জানানো হচ্ছিলো না,তোমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার মা যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলো ব’লে গেলেন। আজ আমি বলবো সত্যিই সেদিন পুলিশ প্রশাসন আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়িই করেছিলো। আমার দৃষ্টিতে তার কোনো দরকার ছিলো না। এমন হতে পারে পুলিশ প্রশাসন তখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো তথ্য না পেয়ে এত বাড়াবাড়ি করছিলো। তারা ভেবেছিলো হাতে যখন একবার পেয়ে গেছি,এবার পুরো ঝিনেদা হাতের মুঠোই। আমাকে নিয়ে তারা কোন্ পদ্ধতিতে এগোবে তাই হয়তো ঠিক করতে পারছিলো না। এর খেসারৎ দিতে হচ্ছিলো আমার মা আর আমার মেয়েকে। সঙ্গে আমাকে তো বটেই। আমার সশস্ত্র জীবন তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে মেনে নেওয়া মনে হয় কঠিন হচ্ছিলো। তাই বসে বসে আমাকে জব্দ করবার ফন্দিফিকির বের করছিলো তারা। আমি এসে বসেছিলাম আমার মায়ের পাশে। মায়ের দিকে তাকিয়ে সেদিন কী ভেবেছিলাম,আজ আর তা মনে নেই। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকিয়ে যে দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিলো তা আজও আমি ভুলিনি। এবং তা ভুলবার কথাও নয়। মেয়ের সেই অসুস্থ শরীর চোখে দেখা যায় না। আজ বলতে দ্বিধা নেই,সেদিন মা এবং মেয়েকে দেখে আমিও হয়ে উঠেছিলাম দিশাহারা। আমি তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না,এখন আমি কী করবো? কী করা উচিৎ আমার। আমার মাথায় সে সময় ছিলো সব এলোমেলো ভাবনা। আমার সেদিন মনে হয়েছিলো আমি চিৎকার ক’রে কাঁদি। কিন্তু না,সেই মুহূর্তে আমি কাঁদিনি। তখন প্রতি মুহূর্তে চাচ্ছিলাম মা আমার মেয়েকে নিয়ে আমার সামনে থেকে চলে যাক। আমি সেই ভয়ানক মুহূর্তটা সহ্য করতে পারছিলাম না। সেদিন কোনো রকমে মাকে বিদায় দিয়ে আমি ছুটতে ছুটতে মহিলা ওয়ার্ডে এসে হাজির হয়েছিলাম। আমার সহবন্দীরা আমাকে দেখে রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমার সঙ্গে অন্যদের কথা না বলার বিধিনিষেধ সিথিল হয়ে এসেছে। কারন মেট্রন নিজেই তখন আমার সঙ্গে গল্প করতে পছন্দ করতেন। আমরা এক সঙ্গে চা খেতাম। নইলে সারাদিন তো তার ঐ সাধারণ বন্দীদের অতিষ্ঠ ক’রে তোলা। এই বা আর কতো করা যায়! কিছুদিন পর মা বিশেষ অনুমতি নিয়ে আবার দেখা করতে এলেন। কারন তিনি আমার ভীষণ মন খারাপ দেখে গেছেন। বাবাকে আনতে চেয়েছিলেন,বাবা আসেননি। কারণ তিনি আমার জেল জীবন দেখে সহ্য করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। এর আগে আমি বাবার কথা বলিনি। বাবা থাকতেন ঝিনেদা থেকে বেশ দূরে। আমাকে গ্রেফতারের দিন বাবা বাড়িতে ছিলেন না। এবার পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে জানানো হোলো,আমরা কথা বলবার জন্য একঘণ্টা সময় পাবো। একজন গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের সামনে থাকবে। আগের দিনও গোয়েন্দা পুলিশ ছিলো আমি জানিয়েছি। আমাদের সমস্ত কথা গোয়েন্দা অফিসারের সামনেই বলতে হবে। আমরা সেদিন পারিবারিক কিছু কথা আস্তে বলবার চেষ্টা করছিলাম। আমাকে বার বার গোয়েন্দা পুলিশ সতর্ক করছিলো, আমি যেন আর একটু জোরে কথা বলি। এ রকম দুই তিনবার বলবার পর আমিই তাকে বললাম,আমাদের এমন কিছু কথা তো থাকতেই পারে যা অন্য কারোর সামনে বলা চলেনা। অনুগ্রহ ক’রে সে সুযোগ আমাকে একটু দেন। এইভাবে এক কথা দুই কথা হতে হতে একটু ঝামেলাই হয়ে গেলো। আমার মেয়ে এতক্ষন আমার কোলেই ছিল। কিন্তু সে আমার কোলে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলো না। খুবই ছোট সে। তার উপর শরীরটাও ভালো ছিলো না। মায়ের সঙ্গে আজ অনেক কথাই হোলো। তিনি বললেন আমাদের জন্য চিন্তা কোরো না। আমি বেঁচে থাকতে তোমার মেয়ের কোনো অসুবিধা হবে না। তুমি নিজে এখন ভালো থাকবার চেষ্টা করে। এরপর মা চলে গেলেন। দেখা করবার সময় পুলিশের সঙ্গে যে একটু ঝামেলা হয়ে গেলো,তার শাস্তি হিসেবে পরদিন আমাকে জানানো হোলো,আপাতত বাড়ি এবং বাইরের কারো সঙ্গে আমার দেখা বন্ধ। কবে আবার দেখা করতে দেওয়া হবে পরে তা জানানো হবে। আমার যতো কষ্টই হোক নিজে থেকে আমিও আর কাওকে বলিনি আমার বাড়ির মানুষেরা কেন আসে না। মেট্রন একদিন হাসতে হাসতে বললেন,ঝামেলা না ক’রে আপনি থাকতে পারেন না? এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে একপর্যায়ে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো হয়েছিলো। একবার আমি এক জমাদ্দার্নিকে দিয়ে বাইরে একটা দরকারী চিঠি পাঠানোর চেষ্টা করি এবং সে চিঠি এক মেট দেখে মেট্রনকেই বলে। কিন্তু মেট্রন আমার সে কথা অন্যদের না বলার জন্য সেই মেটকে বলে দেয়। বলে সে নিজে আমার সঙ্গে কথা বলবে। এটা যেন জেলরের কানে না যায়। আমার জন্য সেদিন অনেক বড় সহযোগিতা ছিলো এটা। দেখা বন্ধ, কিছু না বললেও তো আমার মন খারাপই থাকতো। তখন আবার সাধারণ বন্দীদের সঙ্গে আমার ভাব জমে উঠেছে। আমি আমি ওদের বাড়ি বা বাইরের সঙ্গে দেখা করবার বিষয়টা বুঝতে চাইতাম। নির্দিষ্ট দিনে একবারে ২৫/৩০ জন ক’রে দেখা করতে যেতো। কিন্তু আমি জানি ওদের জন্য আছে মাত্র দুটো জানালা। সেই দুটো জানালা দিয়ে এক সঙ্গে বড় জোর দশজন দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু এই ২৫/৩০ জন যখন এক সঙ্গে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তখন না যায় কথা বলা, না যায় কারোর মুখ দেখা। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। আমি যে মেয়েগুলোকে দেখতাম হাসতে হাসতে জেলগেটে যাচ্ছে, ওরা ফিরতো কান্নার মাতম তুলে। আমি তখন কী তাদের সঙ্গে কথা বলবো। সাধারণ বন্দীদের এই হচ্ছে বাড়ির সঙ্গে দেখা করা। আমার লেখার এই পর্যায়ে সাধারণ বন্দীদের উপর আরও অবিচারের কাহিনী এখানে বলবো। আমি জানিনা এখন আমাদের দেশের বন্দীদের সামান্য মানবিক পরিবেশ কারাগারের মধ্যে তৈরি হয়েছে কিনা। আমি বলছি আজ থেকে ৪৪ বছর আগের কথা।
# চলবে।
# আমার কিছু কথা এবং কিছু বানান এদিক সেদিক হয়ে যেতে পারে। আমি অবসর মতো নিশ্চয় সে ত্রুটি সংশোধন করে নেবো। পাঠক একটু কষ্ট করে তখনকার সময়টা শুধু একটু বুঝবার চেষ্টা করবেন।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী