চ্যানেল আই এ একটা টেলিফিল্ম দেখাচ্ছিলো দিন কয়েক আগে। নাম ‘স্বপ্নপূরণ’। মুভি দেখা, গান শোনা কোনোটার প্রতিই এখন আর কোনো আকর্ষণ কাজ করে না। এমনকি খবর দেখতেও ইচ্ছে করে না। তারপরও কখনও কখনও টিভিটা অন করি হয়তো অভ্যাসের কারনেই । খবর কানে আসে। সুসংবাদ যতটা তার চাইতে অনেক বেশি দুঃসংবাদ।
মুভি বা নাটক দেখব তার থেকে বরং ঘরের টুকটাক কাজ করাও অনেক ভালো। যদিও শরীরে কুলোয় না। একসময় লেখালিখি করতে ভালো লাগতো, এখন সেটাও আর ভালো লাগে না। লিখতে বসলে এলোমেলো হয়ে যায় সব। কোনটা ফেলে কোনটা লিখবো, তালগোল পাকিয়ে ফেলি। তবে টেলিফিল্ম এর বিষয়বস্তুটা দেখে হঠাৎ খেয়াল হলো একটু লিখি। এটাও কাজের ফাঁকেই করছিলাম।
লেখাকে পেশা হিসাবে নেবার মতো লেখক হওয়া হয়ে উঠেনি আমার যে,একবসায় লিখে শেষ করতে পারবো।তাছাড়া লেখাকে পেশা হিসাবে নেয়ার মতো সুযোগ হয়েও উঠেনি।কখনো যে একটুখানি লিখতে পারবো এমন ভাবনাও ছিলো না।কিন্তু এটাই সত্যি যে তিলতিল করে আমার ভেতর লেখার তাগিদটা গড়ে উঠেছিলো।প্রসঙ্গ পাল্টে যাবার আগেই ফিরে আসি মূল কথায়।
টেলিফিল্মের বিষয় বস্তুটা এমন, এক শিক্ষক অবসর গ্রহণের পর সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামের সকল শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনবেন। তাঁর সঙ্গী হলেন তার কন্যা সন্তানটি। বাপ মেয়েতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশু সংগ্রহ করছেন। যথারীতি স্কুলে আসার জন্য একদিন এক বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন তাঁরা। সেই কৃষককে অনুরোধ করলেন তাঁর চারটি সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর জন্য।মওকা মতো কৃষক…বেশ করে শিক্ষককে শুনিয়ে দিলেন! আরে, আমার চার ছেলে দিয়ে আমি চারটা কামলার কাজ করাই। ওরা স্কুলে পড়লে খাব কি? শিক্ষকের কন্যা তখন কৃষকের শিশুকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা জজ-ব্যারিস্টার হতে চাও না? চার জনই খুব করে সিনেমা স্টাইলে বলে দিলো, আমি ডাক্তার হব, আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, আমি জজ হব, আমি ব্যারিস্টার হব। আর অমনি রাজি হয়ে গেলেন কৃষক।
এখনো অধিকাংশ মানুষ মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর ভালো কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হলেও খারাপ কিছু দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত হয়। যাঁরা মিডিয়ায় কাজ করেন তাঁদের মনে ও মগজে পুঁজিবাদ এমনভাবে বাসা বেঁধেছে এর জঞ্জাল গুলি থেকে বের হতে পারছে না আর।এখানে মেয়েটি বলতে পারতো, আপনার ছেলেরা শিক্ষিত হলে আপনার এই এক টুকরা জমিতে কয়েক গুণ বেশি ফলন পাবেন। আপনার ছেলেরা কৃষিবিদ্যায় শিক্ষিত হবে। কৃষিবিদ্যায় শিক্ষিত হলে ওরা গ্রামে গ্রামে প্রত্যেক কৃষকদের শিক্ষা দিতে পারবে।
আপনাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের প্রয়োজনে ওরা নিজেদের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারবে। অথচ সেটা করা হলো না। এমনভাবে টেলিফিল্মটা তৈরি করা হল যেন কৃষক পেশাটা খুবই অসম্মানের। যেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার আর জজ- ব্যারিস্টার দেশকে একেবারে স্বর্গ বানিয়ে ছেড়েছেন । পেটের ক্ষুধা পৃথিবীর সবচাইতে বড় প্রয়োজন এখনো। আগে আমাদের মৌলিক চাহিদা পড়ানো হতো। আগে আমরা পড়তাম। এখন কাউকে পড়তে শুনি না এবং এটাও পড়াতেও শুনি না যে, মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখন আর এগুলো পড়তেও শুনি না পড়াতেও না। এমনকি কখনো কাউকে বলতেও শুনি না। যাই হোক একটু পরেই এসব কথা বললে আমার হয়তোবা মুশতাক কিংবা কাজলের কথা মনে পড়ে যাবে। যাদেরকে আমি ভুলে থাকতে চাই, যাদেরকে মনে করলে আমি তিলে তিলে অসুস্থ হয়ে যাই। প্রসঙ্গে আসি। কোরবানির আগে ডীপ ফ্রীজের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় প্রচুর এবং এতে করে এমন কথাই প্রচারিত হয় যেন কুরবানী দিয়ে মাংস গুলি বড় ডীপ ফ্রীজে রেখে দিতে হবে। যেন কুরবানী মানুষ দেয় ডীপে রেখে মাংস খাওয়ার জন্য। এগুলি দ্বারা মানুষকে আসলে কি শেখানো হয়! লোভ ছাড়া আর কিছু কি শেখানো হয় মানুষকে? কি নৈতিকতা শেখানো হয়? যে মানুষ লোভে পড়তে শিখেছে, লোভের কারণে অপরাধী হয়ে ওঠে তিলে তিলে তার জন্য কি ব্যক্তি একাই দায়ী?
সমাজবিজ্ঞানে পড়েছিলাম, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কয়েকটা কারণের মধ্যে একটা কারণ পণ্যের বিজ্ঞাপন। তাহলে এমন পণ্যের বিজ্ঞাপন কেন এখনো চালানো হয়? আমি তো মাত্র দুটি উদাহরণ দিয়ে কথা বললাম । ভুরি ভুরি উদাহরন আছে এই ক্ষেত্রে কথা বলার যেগুলি লিখে আমি এক জীবনে শেষ করতে পারবো না। কারণ আমি রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের মত মেধাবী লেখক নই। অথবা হুমায়ূন আহমেদের মতো পেশাজীবি লেখকও নই। আমি শখের লেখক অনেকটাই।
আমি তখনই লিখতে বসি যখন আমার মনে হয় একটু খানি লিখতে পারলে আমার হয়তো একটু হালকা লাগবে। আমার মাথার ভেতরের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। মাথার ভেতরের মেঘে মেঘে প্রায়ই একটা ঘর্ষণ টের পাই।সেখানেও বজ্রপাত হয়।আমিই কেবল সেটা শুনতে পাই। তখন মনে হয় এই বুঝি আমার স্ট্রোক হলো! ঘন কালো মেঘটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লে খুব যে আনন্দ কাজ করে তাও কিন্তু নয়। একটু হালকা হই কেবল। কারণ বৃষ্টিতে ভেজার শখও আমার কখনো ছিল না।
স্কুলজীবনে ভিজতাম সেটাও শখে নয়। একটা ছাতাও যে তখন ছিল না। ছাতার অভাবে ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরতাম। এখনো আমার বৃষ্টিতে ভেজার শখ কাজ করে না। আমার মনে হয় এগুলি বিলাসী মানুষদের শখ। আমি কখনো বিলাসী মানুষ হয়ে উঠতে শিখিনি। বাকি জীবন যেন আমি এ-ই রকম মানুষটি হয়েই কাটাতে পারি বরং সেই চেষ্টা করি না হয়ে!
– শামা আরজু, লেখক,বাংলাদেশ।