তথ্য প্রকাশে প্রায়ই অপারগতা প্রকাশ করেন সরকারি কর্মকর্তারা। এর কারণ হিসেবে কখনো রাজনৈতিক ‘চাপের’ কথা বলা হয়; কখনো বাধা হয়ে আসে সমালোচনাকে ভয় পাওয়ার বিষয়টি। এর পাশাপাশি আছে গোপনীয়তার সংস্কৃতিও। অন্যদিকে তথ্য কমিশনও অকার্যকর হয়ে আছে। এসব বিষয় নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘তথ্য অধিকার আইন: পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে উপস্থাপন করা মূল প্রবন্ধে এবং আলোচকদের বক্তব্যে তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো উঠে আসে। ‘আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবসে’ গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এই সেমিনারের আয়োজন করে তথ্য অধিকার ফোরাম।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব (সংযুক্ত) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, ‘আমরা যারা সরকারি চাকরিতে আছি, অনেক সময় সমালোচনাকে ভয় পাই। মনে করি, সবকিছুই ভালোভাবে করছি। অথচ আমাদেরও দুর্বলতা থাকতে পারে, ভুল থাকতে পারে, এটা আমরা অনেক সময় জানি না; কিংবা জানলেও বুঝি না। আলোচনার মাধ্যমে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারি, তখন হতাশার পাশাপাশি আশাবাদও তৈরি হয়।’
সমালোচনাকে ভয় না পেয়ে গ্রহণ করতে হবে উল্লেখ করে মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, ভুল হলে তা সংশোধনের সক্ষমতা থাকতে হবে। জনগণের তথ্য প্রাপ্তি সহজ করতে সরকারি-বেসরকারি সব ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করার দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের উপপরিচালক রুহী নাজ। এই প্রবন্ধে তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ, গোপনীয়তার সংস্কৃতি, সচেতনতার অভাব (বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়), দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও আমলাতান্ত্রিক বিলম্বসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা দরকার বলে সেমিনারে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক দল যদি স্বচ্ছ না হয়, রাজনৈতিক দল যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা দুরাশায় পরিণত হবে।
বিগত নির্বাচন কমিশন পাতানো ছিল—এমন মন্তব্য করে সুজন সম্পাদক বলেন, ওই কমিশনে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের নাম কে প্রস্তাব করেছিল, সে বিষয়টি জানতে তিনি তথ্য কমিশনে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে কোনো তথ্য পাননি। তবে এ বিষয়ে এখনো আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সুনির্দিষ্ট দাবি সত্ত্বেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সরকার তথ্য কমিশন গঠন করেনি।
তথ্য অধিকার আইনের দুর্বলতা আছে উল্লেখ করে সেমিনারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘আইনটি আমাদের নিজেদেরই করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেটি হয়েছে, সেটি কিন্তু শতভাগ আমাদের নয়।’
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. দাউদ মিয়া বলেন, তথ্য অধিকার আইনের দুর্বলতা একদম যে নেই, তা নয়। তবে প্রয়োগের জায়গাটা মারাত্মকভাবে দুর্বল।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন তথ্য অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক শাহীন আনাম। তথ্য অধিকার আইন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে সামান্য অর্জন গত ১৬ বছরে হয়েছে, সেটি এখন বিপন্ন। তথ্য কমিশন দীর্ঘ দেড় বছর ধরে কার্যত অকার্যকর। মনে হয় সরকারের কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত ছিল, তার একটি তথ্য কমিশন অন্যটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
এই সেমিনারে সম্মানীয় অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ইউনেসকোর অফিস প্রধান সুজান ভাইজ। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-সহযোগীরা সব সময় কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত, তবে লড়াই মূলত নাগরিকদের।
সেমিনারের সঞ্চালক ছিলেন এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন ও আইসোশ্যালের চেয়ারপারসন অনন্য রায়হান। – ডেস্ক রিপোর্ট