মেয়েটা নোয়াখালী ছেড়েছে প্রায় দশ-এগারো বছর । এই শহরে অনেকেই আমার মেয়েটাকে আর মনে রাখেনি, কিন্তু স্যার রেখেছিলেন। আমার মেয়েটা স্যারের প্রিয় ছাত্রী ছিলো। আমাকে দেখলেই মেয়ের খোঁজখবর নিতেন। কোথায় কি অবস্থায় আছে, জানতে চাইতেন। এই নষ্ট সমাজে কে কার খবর রাখে ! সবাই কেবলই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত । মেয়েটার খোঁজ খবর নিতেন বলেই স্যারের প্রতি আমার অন্যরকম একটা কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করতো। তাঁর বাসায় যেতে বলতেন। বলতাম, মেয়ে আসুক মেয়েকে সঙ্গে করে যাবো। দশ – এগারো বছরে একটা বারও আমার মেয়েটাকে সঙ্গে করে স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। তবে শিল্পকলায় স্যারের সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। মেয়েটাও স্যারের খোঁজ খবর নিতো ফোনে। আমার কাছ থেকেও কখনো কখনো। যখন আমার মেয়ে গান গাইতে মঞ্চে উঠতো, আমি থাকতাম দর্শকের সারিতে। তখন অনেকেই বলাবলি করতো, মেয়েটা অনেক সুন্দর গান গায়, নিশ্চই রমা স্যারের কাছেই গান শিখে ! আমি মনে মনে হাসতাম। কখনও বলতাম না ও আমার মেয়ে, ও নিজেই গান করে। হ্যাঁ প্রাইভেট শিখে না, শুধুমাত্র শিল্পকলায় শিক্ষা। তবে এটা ঠিক একটা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ( প্রাইভেট কারও কাছে গান না শিখে ) এত ভালো গান করতে পেরেছে আমার মেয়ে সেখানে অবশ্যই রমা স্যারের অনেকখানি আন্তরিক অবদান ছিল। যেটা অনেকেরই থাকে না। ছিল না। সবাইতো আর একজন রমা নাথ স্যার হয়ে উঠতে পারে না।
আমি খুব নগণ্য একজন মানুষ। আমার প্রথম বইটা যখন বের হলো, আমি স্যারকে দিয়েছিলাম। সেটা পড়েছিলেন বুঝতে পেরেছিলাম পরে। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা উঠেছিল। এক পর্যায়ে স্যার বলেছিলেন, আপনি সাহস করে বলে ফেলেছেন। অনেকেই যেটা করে না। বিশেষ করে মেয়ে মানুষ তো অবশ্যই করে না! আপনি সেই সাহসটা দেখালেন। কারণটা কি আমি জানি না। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে তুমি করেও বলতেন। তবে আমি স্যার কে বলেছিলাম, স্যার আপনি আমাকে ‘তুমি’ করেই বলতে পারেন। এই শহরে খুব কম মানুষ আছে, যাদের আমি পা ছুঁয়ে সালাম করি। আমার বাবার পরিচিত মানুষ ছাড়া আমি এভাবে সালাম করি না। সেই মানুষদের মধ্যে হয়তো রমা স্যারই একজন যিনি আমার বাবার পরিচিত ছিলেন না অথচ তাঁকে আমি পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। তাঁর চেহারায় কোথায় কী একটা ছিলো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না।তবে বিষয়টা এমন যে স্যারের দিকে তাকালেই কোথায় যেন একটা প্রশান্তি কাজ করতো। শেক্সপিয়র বলেছিলেন, ‘মুখটা মনের আয়না’ হয়তো এই কথাটাই তাঁর মতো মানুষদের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য।
করোনা পজেটিভ ছিলাম বলে বের হতে পারিনি তখন। পথে চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর সাথে দেখা হয়ে যাবে না কিংবা শিল্পপ্রাঙ্গনে আর তাঁকে দেখবো না এটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
চাইলে জন্ম এড়িয়ে যাওয়া যায় কিন্তু মৃত্যু তো নয়।