শ্বাসকষ্ট, যাকে ছোটলোকি ভাষায় হাঁপানি বলে,সেটা নিয়েই জীবন। জেনেটিক সূত্রে পাওয়া।তাই প্রমোশনের পর পোস্টিং যেন হাঁটার দূরত্বে বেশি না হয় সে জন্য নিকটতম বসের কাছে গিয়ে খুব নরম হয়ে নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরলাম।বস বললেন এমপি সাহেবকে দিয়ে লিখিয়ে আনেন,নইলে পারবো না। একটা পাঠক সংগঠন করি।খুব সামান্য লিখিও জাতীয় দৈনিকের সংগঠনের পাতায় কিংবা নারী পাতায় ।মফস্বলের মতো যায়গায় এতে করে ভালোই পরিচিতি আমার।সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই এক বড়ো ভাইয়ের মাধ্যমে এমপির সুপারিশ আনাই।এমপি তখন হাসাপাতালে ভর্তি। বন্ধুরা দেখতে যাবার সময় আমার আবেদন নিয়ে যান। আমিতো ভাবে গদগদ!কী হনুরে আমি! ওমা,সেই সুপারিশকে বাল বলে মূল্যায়ণ করলো না আমার বস ! অথচ তিনিই আনতে বললেন। প্রাইমারি স্কুলের পোস্টিং বদলির ঠিকাদারি তখন উপজেলা চেয়ারম্যানের মুঠোয়।এমপি কোন বাল ! এই ঠিকাদারির দালাল আমাদের আমলারা।আমাকে প্রায় পাঁচ কিলো হাঁটার রাস্তায় পোস্টিং দিলো। হাঁটুর নিচে প্রায় অর্ধেক দেবে যায় কাদায়।টেনে তোলার শক্তি পাইনা। নিয়তি মেনে নিই। কিন্তু কতোটাই বা মানা যায়!পৌরসভায় চাকুরী করেছি।উপবৃত্তি(প্রতি মাসে শর্ত সাপেক্ষে সরকারি বৃত্তি) ছিলোনা। ও মা যে পরিমাণ শিশু বিদ্যালয়ে কাগজে পত্রে আছে,বাস্তবে আছে তার এক তৃতীয়াংশ!
কারণ বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি। উপবৃত্তি বিলি হবে মর্মে সভাপতি কে ফোন করে জানাবার কথা আমারই। অথচ নজিবুল্লাহ মেম্বার উল্টো আমাকে ফোন করল। বলল ৪০ টাকা করে কেটে রাখবেন। বাকিটা দিয়ে দিবেন।কেন? আমি বলেছি এই জন্য । পরদিন যথাসময়ে উপবৃত্তি বিলি শুরু করলাম। দুই তিন জনের শেষ হতে না হতেই নজিবুল্লাহ মেম্বার গালি দিতে দিতে আসলো। তুই কি মঙ্গল গ্রহ থেকে আইছোস? সবাই টাকা কাটে, তুই কাটবি না! আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম অমনি সে বলে উঠলো, তোর যদি জানের মায়া থাকে, ইজ্জতের ভয় থাকে তাহলে এই এলাকায় পা দিবি না। আমি আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। তখন সে আমার গালের কাছে চড় আনলো, অমনি অভিভাবকগণ বলতে লাগলেন -কেন ম্যাডাম তো ঠিকই বলছেন, আমাদের টাকা কেটে রাখবে কেন! মেম্বার চলে গেল। যাবার সময় আমাকে গেটের তালা লাগিয়ে চলে গেল। আমি আমার বসকে ফোন করলাম এবং জানালাম ঘটনা গুলো। দুই তিন জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম। বস আমাকে বললেন, আপনি উপবৃত্তি প্রদান বন্ধ করে অফিসে চলে আসেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। আমি সবগুলো টাকা আমাদের সহকারীকে দিয়ে অফিসে চলে গেলাম। টাকাগুলো গুনে ও রাখিনি। টেনশন হচ্ছিল। যদিও পরদিন গিয়ে আমি আমার সমস্ত টাকাই বুঝে পেয়েছি। ওই সহকারী টাকাগুলো সরালে আমার কিছুই করার ছিল না। ভালো মানুষ দুনিয়াতে খুব কমই আছে। তবু আছে তো! যাই হোক আমি উপজেলা চেয়ারম্যানের রুমে গেলাম। ওখানে মেম্বার বসা। উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে হাত জোড় করে বললেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আর নজিব উল্যা মেম্বারকে বললেন, তুমি যা করেছো তোমাকে জেলে দেয়ার মতো কাজ করেছ। আমি ভাবলাম আহা কি মহানুভ উপজেলা চেয়ারম্যান! এরপর থেকে আমি ভয়ে ভয়ে স্কুলে যাই আমার পায়ে পায়ে ভয় ভর করে। উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে বলে, সে আমার দলের লোক। আমার জন্য ভোট আনে, আপনার অফিসার পারে না ওকে কমিটি থেকে বাদ দিতে! আবার আমার অফিসার বলে, আমি করি সরকারি চাকরি। উনারা দলীয় লোক। আমি করলে সমস্যা। উনি নিজে পারেনা উনার দলের লোককে বাদ দিতে! আমি বুঝি নাই এটা যে একটা খেলা। এটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে।
নজিব মেম্বার স্কুলে আসে না। এর মাধ্যমে ওর মাধ্যমে ধমকি ধামকি পাঠায়। আমিও ভয় পাই। সময়টা এমন ছিল তখন পরপর অনেকগুলি ঘটনা ঘটেছিল শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা নিয়ে। এমনকি শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল তখন। আমি বারবার অসুস্থ হয়ে যাই। আমাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। ডাক্তার ঘটনা শুনে আমার মেয়েকে বলেন, চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেন উনাকে। আমার মেয়ে বলে আমাদের বাবা নেই এবং এ কথা বলেই সে কান্না শুরু করে।
আর কোনো উপায় নেই।মেয়ের বিয়ের আংটিটা বিক্রি করে তবেই হাসপাতালের বিল শোধ করতে হবে।একই বিষয় নিয়ে এই তৃতীয় বার হাসপাতালে ভর্তি।আমার উর্ধতন বসকে বললাম,স্যার আমাকে নামিয়ে দিন,দরকার নাই আমার প্রমোশনের। স্যার,হাসেন আর বলেন,” এটা কী প্রাইমারি স্কুল পেয়েছেন যে,ডিমোশন দেয়া হবে!
আসলেই তো প্রাইমারি স্কুল। পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির চাকুরী করি তখন। সেটা থাকা অবস্থাতেই এখানের জয়েনিং লেটার পেলাম। লিখিত পরীক্ষার জন্য যখন ডাকলো তখন তখন আমি হাসপাতালে। মেয়ে হলো। সিজারিয়ান। সেই সাতাশি সাল।সিজার তখন অনেক বড়ো অপারেশন। জার্নি করা যাবে না,পুকুরে নেমে গোসল করা যাবে না আরও কতো কী! আমার বোনেরা আমাকে পুকুর থেকে পানি এনে গোসল করাতো। ঠিক এইরকম সময়ে প্রাইমারি স্কুলের এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেলাম এবং এখানেই যোগদান করলাম। যাইহোক এভাবে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন আমার অফিসার আমাকে ফোন করে বললেন, বিদ্যালয়ে যাবতীয় দায়িত্ব একজন সহকারীকে দিয়ে অফিসে চলে যেতে এবং এরপর প্রায় এক বছর আমি অফিসেই ছিলাম। টুকটাক কাজ করতাম।অল্প সময়ে অফিসে থাকতাম। সুবিধাই ছিল। কিন্তু এই সুবিধা আমার ভালো লাগছিল না। আমি তো শিশুদের মাঝেই অভ্যস্ত। অফিসের চাকরি আমার সইছিল না।
বছর খানিক এভাবেই গেল। হঠাৎ একদিন এক কলিগ ফোন করে জানাল একটা স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি।আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি জানি আমার চেষ্টায় আমার বদলি আমার পোস্টিং কোনটাই হবে না। তাই আবার সেই ভাইকে জানালাম। ভাইয়ের ফোনে কাজ হলো। আমাকে নতুন একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করা হলো। শিক্ষা অফিসে দুজন শিক্ষক কাজ করে দেখতাম। দু’জনের একজন এই স্কুলেরই শিক্ষক। নাম আক্কাস। আমাকে নিয়ে আমার নতুন স্কুলে গেলেন।এর আগে কোনোদিন আমি তাকে স্কুলে যেতে দেখি নি। স্কুলে এসে দেখলাম দীর্ঘসময় এখানে প্রধান শিক্ষক নেই। কমিটির দু’জন লোক দেখা করতে এল।একজন সভাপতি একজন সহ-সভাপতি। দু’জনকে আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল । কয়েকদিন যেতে না যেতেই মনে পড়ল এই দু’জন অফিসে গিয়ে বলেছিল আমাদের স্কুলে কোনো মহিলা প্রধান শিক্ষক দিবেন না। পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই।
তেলের কড়াই থেকে উনুনের আগুনে পড়লাম,বুঝতে বেশি সময় লাগলো না।
এখানকার সভাপতি বিডিআরের চাকুরি করতো। দুর্নীতির দায়ে তার সরকারি চাকুরি চলে গেছে। পদোন্নতি পেয়ে এখন সে এই বিদ্যালয়ের সভাপতি। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করে এসেছে।আওয়ামী সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ করে উপজেলা চেয়ারম্যানকে মুরগি আর নারী সাপ্লাই দেয়।এখন সভাপতি বটে ! আমার আগের স্কুলে প্রধান শিক্ষক যিনি ছিলেন তাঁকে শারিরীক ভাবে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে ছিলেন দীর্ঘদিন। সুস্থ হবার পর শিক্ষা অফিসার তাঁকে বলেছিলেন বিদ্যালয়ে জয়েন করতে। তিনি সেটা না করে অবসরপ্রাপ্ত হবার অনেক আগেই অবসরগ্রহণ করে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তার ওপর তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু। বিচার যে তিনি পাবেন না সেটা বোধহয় তিনি খুব ভাল করেই বুঝেছিলেন। এলাকাবাসী মাঝে মাঝে জানায় স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বেশিরভাগ সময় চুপ থাকলেও মাঝে মাঝে বলেই ফেলি, তো আপনারা তাঁর জন্য কি করেছেন? যে লোকটা স্যারের গায়ে হাত তুলেছে সে এখনো সভাপতি। স্যার যদি কোনো দোষ করে থাকেন এই লোক কেন স্যারের গায়ে হাত তুলবে? এখানে সহকর্মীরা কি করেছে? একজন তো আপাদমস্তক অফিসের কর্মচারী। শিক্ষক হয়েও তিনি স্কুলে ক্লাস না করে অফিসে কাজ করেন। তাঁর অফিসার বা কি করেছেন? এসব কথার কোনো জবাব আসে না।
স্কুলে দপ্তরি নিয়োগ হবে।তিন জনের কমিটি। আমি,এসএমসি সভাপতি, আর পাশ্ববর্তী একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।তিনজনের নিয়োগ কমিটি। চার জনের দরখাস্ত জমা পড়লো।শুনছি সভাপতি টাকা চাচ্ছে। আবেদনকারীকে সাবধান করলেও শুনে নি।দুইজনই নাকি টাকা দিয়েছে। একজন জন্ম তারিখ জাল করার অপরাধে বাদ হয়ে গেল। একজন এই স্কুলেরই ছাত্র ছিল একসময়, আমি এখানে আসার আগে। রমজান। রমজানের বাড়ি থেকে ওর ভাবী পরিচয়ে একজন ফোন করে জানতে চাইলো চাকরির জন্য টাকাপয়সা লাগবে কিনা।বললাম চাকরি হলে এমনিই হবে,আর না হলে টাকাপয়সা দিলেও হবে না।ইন্টারভিউর দিন এলো।যার কাছ থেকে সভাপতি টাকা খেয়েছে তাকে যেন নাম্বার বেশি দিই কমিটির বাকি দুইজন আমাকে একরকম ফোর্স করলো।আর আমি সেই জনকেই নাম্বার সবচেয়ে কম দিলাম। অবশ্য ওইটা গণ্ডমূর্খ। ইতোমধ্যে নিয়োগে দুর্নীতির খবর চলে গেল উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। তিনি দুজনকে ডাকলেন। প্রথমজন জন্ম তারিখ জালিয়াতির কারণে বাদ পড়েছিল। বাকি দুই জনের মধ্যে প্রথম হলো আমি যাকে নাম্বার বেশি দিয়েছি সেই। এরপরই শুরু হল তুলকালাম কান্ড। সভাপতির হুমকি ধামকিতে আমার ওখানে টিকে থাকাই মুশকিল।
দুই বার সভাপতিস্কুলে আগুন দিল। প্রথম আলো সহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকেও নিউজটা হল।শিক্ষার্থীর হাজিরা কমে গেল। খবর নিয়ে জানতে পারলাম সভাপতি শিশুদেরকে আসতে দেয় না এবং বলেছে যে, তোদের সবগুলিকে এক রুমে আটকে তোদের ম্যাডাম সহ সবাইকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারবো । প্রথম আলো সহ অন্যান্য আরো পত্রিকায় নিউজ হল। সব ঘটনাই আমি আমার অফিসে লিখিত জানাই।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তিনটি চিঠি পাঠালেন আমাকে মামলা করার জন্য। মামলা কিভাবে করতে হয় জানিনা।আক্কাস আমাকে নিয়ে গেল আমার পরিচিত উকিলের কাছেই।মামলা হলো। সাক্ষী রমজান এবং আক্কাস। নারী শিক্ষক কেউই সাক্ষী দিতে রাজি হলেন না। ব্যাপারটা এরকম- ভদ্রলোকেরা কখনো মামলায় জড়ায় না।কোর্ট কাছারিতে উঠে নস। আমার উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসে সকল শিক্ষকের কাছ থেকে লিখিত জবানবন্দী নিয়েছিলেন। সেই লেখাায় মধ্যে সব সত্য কথা ছিল। মামলা হলো। সাক্ষী রমজান এবং আক্কাস। মামলার সমস্ত খরচ আমাকেই দিতে হয়েছে । আক্কাস শেষের দিকে আসামী পক্ষের সঙ্গে চলাফেরা করতো আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। আমি কিছুই করতে পারিনি। এতদিনে আমি জানি আক্কাস স্কুলের শিক্ষক। তার স্কুলে থাকার কথা। অথচ সে থাকে অফিসে অফিসারদের বগলে। তার কিছুই হয় না। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলে আক্কাস চারবার আমার গায়ে হাত তোলে। আমার মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। এগুলি আমি অফিসারকে জানিয়েছিলাম। কিছুই হয়নি আক্কাসের। এ সময় আমার শিক্ষা অফিসার ছিলেন একজন মহিলা। আমার পক্ষে কথা বলায় উপজেলা চেয়ারম্যান তাকে প্রচুর গালমন্দ করেছেন এবং এখান থেকে বদলি করে দিয়েছেন।মামলা করার পর একপর্যায়ে আসামি পালিয়ে গেল এক পীরের মাজারে।আক্কাস সাক্ষী দিল পাশ কাটিয়ে।দপ্তরি এলাকায় থাকে,সেও জোরালো ভাবে কথা বললো না।একপর্যায়ে মামলা খারিজ হয়ে গেল সাক্ষীর অভাবে। ডিপার্টমেন্ট মামলার কোনো খরচ আমাকে দিলো না। আসামি বাড়ি ঘরে চলে এল।
এক সপ্তাহের মাথায় আবার সে একটা ঘটনা ঘটালো।
বেলা বারোটায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছুটি হয়। দুইটায় বিরতি । আমরা সবাই অফিস রুমে খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় সোনিয়ার মা এবং ভাই এসে যা বলল তা মোটামুটি এইরকম। সভাপতি তার পুরাতন ফেলে রাখা একটা ঘরে সোনিয়াকে চকলেট দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং তার প্যান্ট খুলে ধর্ষনের চেষ্টা করে। সোনিয়া প্রথম শ্রেণীতে পড়লেও ওকে অনেক কম বয়সী মনে হয়।
আমি উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ফোন করে জানালে উনি আমাকে অফিসে যেতে বললেন ওদের নিয়ে। ওরা স্যারের কাছেও একই কথা বলল। স্যার আমাকে বললেন ভিডিও করে রাখতে ওদের কথা। না রাখলে ওরাই নাকি আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে। আমি ভিডিও করে রাখলাম। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন পত্র দিলাম। তিনি আমাকে থানায় যেতে বললেন। থানায় গিয়ে দেখি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওখানে বসা। তিনি আমার উপরে একরকম খেপেই বললেন আমাকে না জানিয়ে আপনি দৌড়াদৌড়ি করছেন!থানায় কাগজ জমা দিয়ে আমি চলে এলাম।সভাপতি আবার পলাতক।এবারও সেই পীরের মাজার।
সোনিয়া এখন আর স্কুলে আসে না। ওর বাড়িতে ফোন করলে জানতে পারি ও ভয় পেয়েছে খুব। ওর বাবাকে ফোন করে খবর জানতে চাই। ওর বাবা স্কুলে আসবে বলে আমাকে জানালো অনেকবারই, আসলে এলো না। তদন্তকারী এসআই বদলি হয়ে অন্য জেলা চলে গেল। এরপর পরই শুরু হল করোনার তাণ্ডব। করোনার পর যখন স্কুল খুললো তখন দেখলাম আসামি বহাল তবিয়তে আছে। তবে তার হামবড়া ভাব আর নাই। চোরের মত মাথা নিচু করে চলে।অথচ তার তান্ডবে গ্রামবাসীর নাভিশ্বাস অবস্থা ছিল। গ্রামের অনেকেই আমাকে স্যালুট জানায়।পুরুষ যেটা পারেনি আপনি সেটা পেরেছেন।
বিদ্যালয়ে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে আস্তে আস্তে আসামী পক্ষের লোকদের সঙ্গে আমাকে দেখিয়ে-দেখিয়ে চলাফেরা করতে লাগলো আক্কাস।আক্কাস স্কুলে আসবে না। অফিসে কাজ করবে।হঠাৎ একদিন বিদ্যালয়ে এসে কয়েকদিনের স্বাক্ষর একদিনে করে ফেলবে।আমি বাধা দিয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার অপরাধ। আক্কাস অফিসে অফিসারদের সঙ্গে কাজ করে এজন্য তাকে আমার অন্য সহকর্মীরা সাপোর্ট করেছিল। আক্কাসের শরীরে অফিসারদের ফ্লেভার ছিল। সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করল।বিদ্যালয়ে আক্কাস আমার গায়ে হাত তুলেছিল। আমার মোবাইল নিয়ে গেল। সবকিছু আমি অফিসে জানিয়েছি, থানায় জিডি করেছি।কিন্তু কোনো বিচার করে নি। আমার অফিসের অফিসার। কারণ সে অফিসারদের বগলের নিচে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমিই এখানে টিকে গেলাম। আমার জানামতে একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা বিভাগীয় মামলার কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন। আমি আত্মহত্যা করিনি কিন্তু তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছি । আক্কাস বলেছিল আমার অধীনে চাকরি করবে না। সে অন্যত্র বদলী হয়ে চলে গেল স্বেচ্ছায়। এক সহকারি গোটা এক বছর নৈমিত্তিক ছুটি নেয় নি আমার কাছ থেকে ছুটি নেয়া লাগবে বলে।আমাকে এখানে চাকরি করতে দিবেনা বলেছিল আক্কাস। আমি এখনো আছি। আক্কাস নিজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখান থেকে চলে গেল।।অন্য সহকারী শিক্ষক য়ারা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করেছিল তারাও বহাল তবিয়তে এখানে আছে। ইচ্ছা করলে ওদেরকে অনেক হয়রানির মধ্যে রাখতে পারি। কিন্তু তাহলে ওদের সাথে আমার তফাৎ কি থাকবে! ওদের সাথে কাজ করি ঠিকই অতীতের কষ্টগুলোই আমার পিছু ছাড়ে না। খুব কষ্ট হয় ওদের সঙ্গে চলতে। কিন্তু কি করব চাকরি তো করতেই হবে!
– শামা আরজু , লেখক, বাংলাদেশ।