– মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিপুল হওয়ায়; এখানে বিপুল সংখ্যক করোনা টেস্টিং কিট প্রয়োজন হচ্ছে। এ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিপুল সংখ্যক টেস্টিং কিট আমদানি করতে হবে। করোনাকালে মানুষ যখন বিপন্ন; তখনও এই টেস্টিং কিট ক্রয় ও আমদানির সঙ্গে জড়িতদের ‘আমদানি-উদ্দীপনার সীমা নেই। সরকারি চিকিৎসা সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে যে ভয়ংকর দুর্নীতি ঘটে; সে কথা নতুন করে কাউকে মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
এরকম সময়ে দেশের বিজ্ঞানী ডা. বিজন শীল ও তার গবেষক দলের গবেষণায় গণস্বাস্থ্য নামের বেসরকারি সংস্থা করোনা টেস্টিং কিট উদ্ভাবনের খবরটি ছিলো স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এই উদ্ভাবনের খবরটি স্বস্তিদায়ক ছিলোনা বিদেশ থেকে টেস্টিং কিট আমদানির সঙ্গে জড়িত লোকেদের জন্য। আশার কথা দেশে টেস্টিং কিট উদ্ভাবনে গণস্বাস্থ্যের এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সভ্য দেশ হলে দেশের যে কোন উদ্ভাবন হলে পরীক্ষাকারী সরকারি দপ্তর নিজেই উদ্যোগী হয়ে দ্রুততার সঙ্গে উদ্ভাবনটিকে পরীক্ষা করতে সক্রিয় থাকে। অসভ্য দেশে প্রধানমন্ত্রী একটি উদ্ভাবনকে স্বাগত জানানোর পরেও; পরীক্ষাকারী দপ্তর লাল ফিতার ঘুড়ি উড়িয়ে উদ্ভাবনের ঘুড়ির সুতো কেটে দিতে চেষ্টা করে। গণস্বাস্থ্যের এই টেস্টিং কিট পরীক্ষায় অসহযোগিতা, প্রতিবন্ধক-সৃষ্টি, সরকারি পরীক্ষার আমলাতান্ত্রিক ছয়টি সোপানের ছক্কা-পাঞ্জা নিয়ে হাজির হয়; টেস্টিং কিট আমদানির টাকা নয় ছয় করে ভাগ করে নেয়া লবিটি।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিরোধী দলের সমর্থক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই রাজনৈতিক ক্লিশেকে পাশ কাটিয়ে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটটি পরীক্ষা করে দ্রুত ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করেন।
দলীয় কীটেরা করোনা টেস্টিং কিটের রাজনৈতিক আত্মপরিচয় খুঁজতে থাকে। সরকারি দলের সহমত ভাইয়েরা করোনার সঙ্গে সহমরণে যেতে রাজি; কিন্তু ডা. জাফরউল্লাহ’র প্রতিষ্ঠানের টেস্টিং কিট ব্যবহার করবে না; এমন একটি ধনুকভাঙা পণ করে ফেলে। টেস্টিং কিট পরীক্ষার ধাপগুলো লিখে লিখে বলে, আগে এই ধাপগুলা ডিঙাইয়া নেন; তারপর দেখা যাবে কী হয়।
এই করে সময় ক্ষেপণ করা করা গেলে টেস্ট কিট আমদানির সরকারি নির্দেশগুলো জারি হয়ে যাবে। টেস্টিং কিট কেনার ক্ষেত্রে “রূপপুরের বালিশ কেনার বসন্ত” যখন হাজির; তখন দেশেই টেস্টিং কিট উদ্ভাবন করে ” ডা. জাফরুল্লাহ” সেই সত্যজিৎ রায়ের “গণশত্রু” ছবির ডাক্তারটির মতোই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের চক্ষুশূল হয়ে পড়লেন।
আগে আমাদের গ্রামগুলোতে মাতবর বাড়ির উঠোনে সালিশ বসিয়ে সেখানে অপছন্দের ব্যক্তিকে শতমুখে নানা জ্ঞান দেবার ছলে অপমান করা হতো। সেই গ্রাম্য-সালিশির আঙ্গিক নিয়ে একটি টিভি চ্যানেল নিয়মিত টকশো করে। এখানে অপছন্দের ব্যক্তিকে নিয়ে এসে কলতলার কাইজ্জা তৈরি করা হয়।
কলতলার কাইজ্জার একজন উপস্থাপিকার করোনার সময় খুব শখ হলো “একাডেমিক আলোচনা” করার। খুঁজে পেতে উদ্ভাবন পরীক্ষা দপ্তরের কেরানি, দলীয় ডাক্তার, দলীয় প্রবাসী বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি নিয়ে সালিশ কমিটি বানিয়ে সেইখানে হাজির করে বর্ষীয়ান ডা. জাফরউল্লাহকে।
এই টকশো-সালিশে ডা. জাফরউল্লাহ টেস্টিং কিট সরকারি পরীক্ষার সবগুলো ধাপ পূরণ করেননি; নিজের উদ্ভাবিত টেস্টিং কিটকে নিজেই ভালো বলতে পারেন না; টেস্টিং কিট গবেষণায় বিদেশি রক্তের স্যাম্পল ব্যবহার করে কী মারাত্মক বে-আইনি কাজ করেছেন; একজন স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানীর কী ভাষায় কথা বলতে হয়; সেসব হিতোপদেশ দিতে থাকে। কলতলার কাইজ্জায় অভ্যস্ত উপস্থাপক আবার “একাডেমিক আলোচনা” করতে চাই কথাটি চাপ দিয়ে দিয়ে বলে। আহারে কত শখই না মানুষ মনে পুষে রাখে। এই টকশোটি দেখে ছোট বেলায় পড়া জোনাথন সুইফটের “গালিভার’স ট্রাভেলস”-এর ঐ দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে; যেখানে গালিভারকে চারদিক থেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে লিলিপুটরা তার দিকে তীর ছুঁড়তে থাকে।
দেশিয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে টেস্টিং কিট গবেষণার জন্য রক্তের নমুনা পেতে দশ দিন দেরি হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের। ডা. জাফরুল্লাহ-র দেয়া এই তথ্যটা সরকারি দপ্তরের অসহযোগিতার একটা ছোট উদাহরণ।
এখন প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট সুপারিশের পরেও কেন, সরকারি দপ্তরের আমলাদের একাংশ, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি অংশ ও সরকার সমর্থক একটি টিভির এই ডা. জাফরুল্লাহকে “গণশত্রু” বানাবার আয়োজন। এ কেবলই দলীয় অনুভূতি হলে তো প্রধানমন্ত্রী এই টেস্টিং কিটকে স্বাগত জানানোর পরেই সরকারি আমলাদের এ টেস্টিং কিট পরীক্ষার ব্যাপারটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে করে ফেলার কথা।
গণস্বাস্থ্যের টেস্টিং কিট-টি ব্যবহারের উপযোগী নয়; এমন একটি প্রোপাগান্ডা তৈরি করে জনগণের টাকায় সরকারিভাবে টেস্টিং কিট বিদেশ থেকে কিনে আনার কীট-চক্রটিকে খুঁজে পাওয়া যায় ইহাদেরই মাঝে।
- মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক
Editor-in-Chief, E-South Asia
ফেইসবুক পোষ্ট ২৬.০৪.২০২০
শিরোনামের দায় স্ট্রেইট ডায়ালগ”এর