আমাকে নিয়ে এবার যশোর পুলিশের বেরিয়ে পড়বার পালা। এ যেন রিলে রেস। সকালে মায়ের বাসা থেকে জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেবের নেতৃত্বে ঝিনেদা থানায়। দিন শেষে ঝিনেদা থানার ভারপারপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে যশোর পুলিশ সুপারের অফিসে। সেখান থেকে কয়েক ঘণ্টা পর,যশোর পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে নতুন গন্তব্যে রওনা। পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ি সামনে পিছনে,আমাকে নেওয়া পুলিশ পরিবেষ্টিত আর একটা গাড়ি ছিলো মাঝে। মাঝের গাড়িতে আমাকে সামনে ভিতরের দিকে বসিয়ে, সকালে ঝিনেদা মহকুমার এস ডি পি ও-সাহেবের মতোই জানালার পাশে বসলেন যশোর জেলার এস পি সাহেব নিজে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এইভাবে আমাকে নিয়ে পুলিশ কনভয় হুইসেল বাজিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়, আমাকে নিয়ে যাওয়ার গন্তব্যে। রাত তখন সাড়ে ১১টা,বলা যায় নিশুতি রাতই,শুনশান রাস্তা। আমার এবারের গন্তব্য যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার। আমাকে বার বার আশ্বস্ত করা হয়েছিলো,কারাগারেই নেওয়া হচ্ছে-যেহেতু আমি থানায় থাকতে আপত্তি জানিয়েছি। আমাকে কারাগারে নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেও, যাত্রা পথে আমার আশেপাশের পুলিশ সদস্যরা কিছু ধোঁয়াশা মূলোক কথা বলা শুরু করলো। তাতে স্বাভাবিক ভাবেই আমি আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার মনে আবার এই আশংকা ঢুকে গেলো,আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নাতো? তারা নিজেরা বলাবলি করছিলো,আমি কেন যে থানার ব্যাপারে আপত্তি জানালাম,তা তাদের বোধগম্য নয়। ওদের কথার সূত্র ধরেই আমি আবার একটা আতংকের মধ্যে সময় পার করতে লাগলাম। রাগে ক্ষোভে তখন আমার মনে হতে লাগলো মানুষকে আতংকের মধ্যে রাখা পুলিশ জাতের একটা মজ্জাগত অভ্যাস। আমার দিব্যি মনে আছে,এস পি অফিসে তারা আমাকে জেলখানার ব্যাপারে নিশ্চিত করেছিলো। এই ভাবনার মধ্যেই মনে হোলো ঝিনেদা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমি ভালোভাবে বিদায় নিতে পারিনি। শৈলকূপা থানার তৎকালীন ওসি সাহেব মতিউর রহমানের আপ্যায়ন আমার জন্য ছিলো বিশেষ কিছু। তিনি ছিলেন যুবক এবং বেশ কিছুটা চঞ্চল মানুষ। আমাকে চা খাওয়ানোর ব্যাপারে তার আন্তরিকতা এবং আগ্রহ ছিলো চোখে পড়বার মতো। যশোর এস পি অফিসে যতবার চা খেয়েছি,সব সময় ওসি মতিউর রহমান নিজের হাতে আমাকে দিয়ে গেছেন। আমি ধন্যবাদ জানাতে তিনি বলছিলেন,আপা এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাকে সমাদর করছি ভয়ে। বুঝতেই পারছেন আমার থানা শৈলকূপা। এটা আমার সঙ্গে তার এক ধরণের রশিকতা। অত মানসিক চাপের মধ্যেও মতিউর সাহেবের কথায় এবং আন্তরিকতায় বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমি এস পি অফিস থেকে গাড়িতে উঠবার সময় মতিউর সাহেবকে দেখা পাইনি। অনেকেই তখন ভোজবাজীর মতো কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার এ রকম এলোমেলো ভাবনার এক পর্যায়ে,পুলিশ কনভয় যখন কোনো এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো,তখন আমার চিনতে দেরি হোলো না যে,এটা কারাগার। তখনকার অনুভূতি এমন-আঃ কী শান্তি। চলতি পথে আমার সামনে উল্টাপাল্টা কথা বললেও,শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে জেলখানাতেই নিয়ে এসেছে,এটা ভেবে মনে মনে তাদের ধন্যবাদ জানালাম। আমি আগে রাজবন্দী কাউকে কাউকে এই জেলখানায় দেখতে এসেছি। এবং অনেকবার। তাই জায়গাটা আমার চেনা। পুলিশ পরিবেষ্টিত গাড়িতে বসে অন্ধকার রাতে আগে থেকে আমি আন্দাজ করতে পারিনি যে আমাকে কারাগারের পথেই নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া আমি ছিলাম গভীর ভাবনার মধ্যে এবংভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে। কারাগারের গেট সংলগ্ন অফিসে যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হোলো, দেখলাম জেলর সাহেব একজন ডেপুটি জেলর এবং একজন মহিলা জেল পুলিশ নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া জেল কতৃপক্ষও রাতে কারাগারের মহিলা ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে পারেন না। আমাকে নেওয়া হবে মহিলা ওয়ার্ডে। সেই জন্যই মহিলা জেল পুলিশকে আনানো হয়েছে। যশোর পুলিশ কতৃপক্ষ আমাকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ করে আধা ঘণ্টার মধ্যেই জেলখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
নিশুতি রাতে জেলর সাহেব জমাদ্দার্নী ( মহিলা জেল পুলিশ )এবং ডেপুটি জেলর সহ আমাকে নিয়ে মহিলা ওয়ার্ডে প্রবেশ করলেন। আমি আগেই বলেছি,ওয়ার্ড এবং সেলের চাবি সহ জেলখানার সমস্ত চাবি রাতে জেলর সাহেবের কাছেই গচ্ছিত থাকে। এবং রাতে জেলর সাহেবের উপস্থিতি ছাড়া জেলের তালা অন্য কারোর খুলবার নিয়ম নেই। সেই নিয়মের অংশ হিসেবেই,এই মাঝরাতে জেলর সাহেবের উপস্থিতিতেই আমার জন্য মহিলা ওয়ার্ডের তালা খোলা হোলো। তখন আমার মাথায় নতুন ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই চার দেয়ালের মধ্যে একা থাকবো কেমন ক’রে। সাধারণ বন্দী অনেক আছে। কিন্তু বাইরে থেকে শুনেছি রাজবন্দীদের আলাদা রাখা হয়। এই দুর্ভাবনা হঠাৎ ক’রে যেন আমাকে চারদিক দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। তা ছাড়া জেলজীবন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। আর জেল তো জেলই। যেখানে মানুষ বন্দী থাকে,থাকে পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাস থেকে দূরে। যেখান থেকে দেখা যায় না মুক্ত আকাশ। কিন্তু না চাইতেই জল পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেলো। ওয়ার্ডের লোহার বড় দরোজা খুলতেই দেখি আমার সামনে সালেহা আপা দাঁড়িয়ে। সালেহা বেগম তৎকালীন জাসদের কিংবদন্তী নেত্রী ছিলেন। এবং তিনি সরাসরি আমার নেতা। আমি যার হাত ধরে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেছি,তিনি সালেহা বেগম। আমার সামনে যেন ঘটে গেলো এক অভাবনীয় ঘটনা। আমি ভাবতেই পারছিলাম না,আমি সালেহা আপার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে নিয়ে যখন জেলর সাহেব ওয়ার্ডের দিকে এগোচ্ছিলেন,তিনি একবার বলেছিলেন,চিন্তা করবেন না,ওখানে নিজের মানুষ পেয়ে যাবেন। কিন্তু সে যে এতো বড় পাওয়া,তা কিছুক্ষন আগেও আমি বুঝতে পারিনি। আমি যখন এতো সব ভাবছি,ততক্ষনে আমি সালেহা আপার বুকের মধ্যে। আমি জানতাম না,আমি গ্রেফতার হওয়ার ১০ দিন আগে সালেহা আপা গ্রেফতার হয়ে গেছেন। তখন আজকের দিনের মতো পরিস্থিতি এতো সহজ ছিলো না। আমরা সাধারণত পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ পেতাম না। আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট কিছু মানুষ থাকতো। আর কখনো পত্রিকা পড়তে পারা ছিলো সৌভাগ্যের মতো।
জেলখানায় সালেহা আপার উপস্থিতি আমাকে যেন নতুন শক্তি যোগালো। সেদিন আমি যেন দুঃসময়ের এক শক্তিশালী কাণ্ডারি পেয়ে গেলাম। সালেহা আপা ঐ আলো আঁধারিতেই আমাকে চিনে ফেলেছিলেন। অত রাতে জেলের তালা খুলতে দেখে সালেহা আপা ভাবছিলেন জেল কতৃপক্ষ নিশ্চয় রাতের আঁধারে তাকে অন্য কোনো জেলে সরিয়ে দিতে চায়। উল্লেখ করা দরকার, ৭১ সালে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করা বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহা বেগম ছিলেন এক ধরনের বিশিষ্ট বন্দী। তিনি ছিলেন যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং যশোর এম এম কলেজের নির্বাচিত ভি পি। শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের সঙ্গে তিনি একই মামলার বন্দী ছিলেন। এবং তাঁর ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিলো। আমাকে দেখে সেই যে তিনি জড়িয়ে ধরেছিলেন,যেন আর ছাড়তেই চাইছিলেন না। আহা,আমার বোন বন্ধু নেতা সালেহা বেগম। তখনও সালেহা আপা জানেন না,আমাকে কবে ধরা হয়েছে। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে চাইছিলেন আসলে আমি কেমন আছি। ভালো আছি কিনা। আমার উপর কোনো পুলিশি নির্যাতন করা হয়েছে কিনা। ইত্যাদি ইত্যাদি। কারন আমার রাজনৈতিক অবস্থান ছিলো সশস্ত্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আমি ছিলাম গণবাহিনীর সক্রিয় কর্মী। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না ক’রে,আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি অন্তর দিয়ে আমার বর্তমান ভালো মন্দ বোঝার চেষ্টা করছিলেন। অদ্ভুত ভাবে এতক্ষন আমাদের মধ্যে প্রাথমিক সম্ভাষণ ছাড়া ২য় কোনো কথাই হয়নি। আমাদের এই আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে আমাকে ওয়ার্ডে সালেহা আপার কাছে সঁপে দিয়ে জেল কতৃপক্ষ বিদায় নিলো। সালেহা আপা এবার যেন এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললেন। “তুই কবে ধরা পড়েছিস? পুলিশ হেফাজতে কতদিন ছিলি? তোর উপর কি কোনো নির্যাতন করা হয়েছে? তিনি রীতিমত বিচলিত এবং অস্থির হয়ে পড়লেন। আমাকেও যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় দিতে চান না তিনি। আমি তাঁকে সব খুলে বলার পর,তিনি সেই রাতে আমাকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমার সামনে সেই সময় সালেহা আপার উপস্থিতি ছিলো শক্তি এবং আনন্দের এক অসাধারণ উৎস। এখানে সালেহা আপাকে নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। সালেহা আপা আমার জীবনের অনেকখানি। এবং তা আজও। এই সালেহা বেগমের স্নেহের শাসনেই আজ আমি বামপন্থী ঘরানার একজন হয়ে উঠতে পেরেছি। তিনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় এবং পথ প্রদর্শক। তিনিই ছিলেন আমার জীবনের আলোকবর্তিকা। তিনি আমার মুক্ত জীবনের কাণ্ডারী ছিলেন। এবং জেল জীবনের অনেক দুঃসহ পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে পেরেছি এই সালেহা বেগমের শক্তিতেই। আজ জেল জীবন স্মরণ করতে বসে,সালেহা আপাকে জানাই আমার অন্তরভরা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী