সম্প্রতি ভাত কম খেয়ে অন্যান্য পুষ্টিযুক্ত খাদ্য খেতে পরামর্শ রাখা হয়েছে। আমরা তো ভাত কমই খাই। নানারকম অনুভূতি খাই, উন্নয়নের প্রসাদ খাই, সাফল্যের মিঠাই মণ্ডা খাই। ভাত খাওয়ার সময় কোথায়; নানারকম ইস্যুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খেয়ে সময় করতে পারি না অন্য কিছু খাওয়ার।
গতকাল অনেকদিন পর দুটো ক্রিকেট ম্যাচ দেখলাম। আমাদের ক্রিকেট টিম ১৭১ রানের টার্গেট রেখে দেয়ার পর; অনায়াসে জয় আসছে এমন নিশ্চিন্ত হয়ে খেলা দেখতে গিয়ে শ্রীলংকার ছয়ের মার দেখে হতাশ হতে থাকলাম। এরা সেই জয়সুরিয়া-রানাতুঙ্গার যুগে ফিরে গেছে মনে হলো। এদের জয়রথ ঠেকানো কঠিন। হেরে গিয়ে মনটা খারাপ হলো। মনটা আরো খারাপ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘যত দোষ লিটন ঘোষ’ জাতীয় ক্লিশে কথা দেখে। ধর্মীয় অনুভূতির আদিম চর্চা ক্রিকেটেও মালিন্য এনেছে। সামান্য শিক্ষিত প্রগতিশীলরা ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেশায়; আরো কম শিক্ষিত পরকালশীলেরা ক্রিকেটের সঙ্গে ধর্ম মেশায়। আমরাই প্রকৃত সংখ্যালঘু যারা শিল্প-সংস্কৃতি-সংগীত-ক্রীড়াতে কোন কিছু না মিশিয়ে নির্মল আনন্দ পেতে চেষ্টা করি।
পূজার সময় সনাতন ধর্মীরা যে হামলা আর ট্রমার মাঝে কাটালেন; তাতে লিটন দাস যে খেলতে পেরেছেন; এটাই অনেক। লিটনের মুখমণ্ডলে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ট্রমা আর নৈরাশ্য খালি চোখেও দেখা যায়।
নিশ্চিন্তে দ্বিতীয় ম্যাচটি দেখলাম। এই ম্যাচে যে কেউ জিতলে আমার কিছু এসে যায় না। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচে খেলোয়াড়দের পারস্পরিক সৌহার্দ্য চোখে পড়ার মতো। যুদ্ধপাগল রাজনীতিকদের অশনি ছায়া থেকে দূরে কোহলি-রিজওয়ানের আলিঙ্গনের উষ্ণতায় সভ্যতার আলো খুঁজে পাওয়া গেলো। প্রাজ্ঞ খেলোয়াড় রবি শাস্ত্রী আর মহেন্দ্র ধোনি পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের আশীর্বাদ দিতেও ভোলেননি এক ফাঁকে।
যুদ্ধবাজ রাজনীতিকদের বিদ্বেষের বিষ নিঃশ্বাসের বাইরে দুবাই স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিলো খেলার সঙ্গে ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি না মেশানো খুব অপরিচিত এক সভ্য জগতে।
খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে আইপিএলে বাবর-রিজওয়ানদের আসতে না দিয়ে অপরিচয়ের অন্ধকারে কোহলির দলটি দশ উইকেটে হেরেছে। খেলার সঙ্গে পরিচিত হলে লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হতো। আমরা দর্শকরা বঞ্চিত হয়েছি; সেরকম একটা ম্যাচ থেকে।
ঠিক এইভাবে পাকিস্তানে ভারতের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করে ডুবে গেছে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগত; যা ভারতের চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নবজাগরণের ইঙ্গিত দিয়েছিলো কয়েকবছর আগে। খেলার সঙ্গে-চলচ্চিত্রের সঙ্গে বিষাক্ত রাজনীতি মেশালে এইতো হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের খেলোয়াড় শামীকে যত দোষ শামী ঘোষে পরিণত করায়; আবার সেই খেলার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির বিদ্বেষের বিষ মেশানো চোখে পড়লো।
দিনশেষে লিটন আর শামীর সংখ্যালঘুর বেদনা বুকে পুষে ঘুমাতে যাবার আগে দেখলাম পাকিস্তানে বিজয় উদযাপনের ফাঁকা ফায়ারে ১২ জন আহত। এইসব আদিম কোলাহল আর নির্বোধ ঘটনাপ্রবাহের বিষাদসিন্ধুই দক্ষিণ এশিয়া। অন্য কোন গ্রহের দোজখ যেন এই অবিমৃষ্য অন্ধকারের জনপদগুলো।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক