গ্রেড টু তে পড়ছে রুশদা। গ্রেড থ্রীতে পড়ছে ফালাক। তানাজ গ্রেড নাইনে, আর ইকতিনা পড়ছে গ্রেড টুয়েলভে। জুন মাস ছিল তাদের জন্ম দিনেরমাস। কিন্তু কোবিড ১৯ বা মহামারী করোনার কারণে তাদের ধুমধাম করে আর জন্মদিনপালন হয়নি। এরা সবাই কানাডার রাজধানী অটোয়ার বারহাভেনেই থাকে। বারহাভেন একটি ক্রম বর্ধমান আবাসিক এলাকা যাডাউন-টাউন অটোয়া থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে।
জন্মদিন মানে অনেক অনেক গিফট, শত শত ক্যান্ডি, স্কুলের বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে হাসিখুশি আর রং-বেরঙের পোশাক-আশাক। শিশু-কিশোররাজন্মদিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। এটি তাদের আনন্দেরক্ষণ। কিন্তু মার্চ মাসে ইরুশদা, ফালাক, তানাজ আর ইকতিনা বুঝতে পেরেছিল হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ মানে একটি অশনি সংকেত। তাদের হয়ত এই বছরে খুব সুন্দর করে সবাইকে নিয়ে আর জন্মদিন পালন করা সম্ভব হচ্ছেনা।
করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিক শুরু হওয়ার পর থেকে শিশুরা এমনিতেই মানসিক কষ্টে আছে। শিশুরা করোনা ভাইরাসে অপেক্ষাকৃত অনেক কমআক্রান্ত হলেও তারা বিভিন্ন চাপে ও হতাশায় ভুগছে। কারণ তাদের স্কুলবন্ধ, খেলাধুলা করতে পারছেনা, বন্ধুদের সাথে দেখানেই বহু দিন। পার্কে যেতে পারছেনা। চার দেয়াল ছাড়া কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা। ইউনিসেফের মতে, শিশুদের সারা বিশ্বে খুব ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। তাদের পুষ্টির অভাবেরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ক্ষুধা, অপুষ্টি ও একাকীত্ব ছাড়াওশিশুরা ঝুঁকির মুখে পড়ছে নানা ভাবে।
প্রবাসে বাচ্চারা বড় একা। বলতে গেলে এই প্রবাসে অনেক বাচ্চাদের নিকটআত্মীয় (নানা, নানী, দাদা, দাদি, আঙ্কেল, আন্টি আর কাজিন) বলতে কেউ নেই। শুধু রুশদা, ফালাক, তানাজ আর ইকতিনার কথা বলছিনা বরং উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও সারা বিশ্বে বাংলাদেশীবাচ্চাদের একই অবস্থা। বাবা-মার বন্ধুবান্ধবরাই প্রবাসে তাদের আঙ্কেল ও আন্টি। আবার এদের ছেলে মেয়েরাই তাদের বন্ধু –বান্ধব ও কাজিনের মতো।
শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাচ্চাদের জন্মদিন কিভাবে পালন করতেহবে তা সন্তানদের সাথে পরামর্শ করা যায়, বাবা-মা বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন আইডিয়া দিতে পারেন। আমেরিকার ফ্লোরিডা ভিত্তিক শিশু মনোবিজ্ঞানীরোজান লেসকের মতে, “বাচ্চারা হয়তোবা ইতিমধ্যে একটি পরিকল্পনা করেফেলেছে, তা কিন্তু বাস্তবতার সাথে মিল না ও থাকতে পারে।” তাই বাবা-মাকে সব সময় কৌশলী হতে হবে এবং তাদের চাহিদার উপর নজর দিতেহবে।
এইতো সে দিন পাঁচ বছরের লিওপোল্ড নামের অটোয়ার একটি শিশু টিভির একটি লাইভ শো তে অটোয়া পাবলিক হেলথের চিফ ডাক্তার ভেড়াএটসেসকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলো: “Can I have a birthday party with my friends?” চিফ ডাক্তার উত্তরে বলেই দিলেন, না-পারবেনা, কারণ এতে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। তবে হ্যাঁ পারবে তাহলো তুমি “ফেসটাইম” বা “জুম” এর মাধ্যমে জন্মদিনের আনন্দ শেয়ার করতে পারবে বা “You can still have a birthday party with the people that live in your house.” সব বাচ্চাদেরই প্রায় সে একই প্রশ্ন।
কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিলো রুশদা, ফালাক, তানাজ আর ইকতিনারমায়েদের সাথে। এ চারটি পরিবার বারহাভেনে খুব কাছাকাছি থাকে, বলতে গেলে একই লোকালয়ে। প্রায়শই ফেসবুকে ভার্চুয়ালি কথা বলেন তারা, অন্তত সপ্তাহে চার/পাঁচ দিন। তারা জানালেন, হতাশাতো আছেই বরং বাচ্চাদের বাৎসরিক একটি অনুষ্ঠান তারা করতে পারলোনা, এ করোনার কারণে। “না পারার” তো একটা বেদনা মনের মধ্যে গেঁথে আছে তাদের।বিশেষ করে বাচচছাদের মানসিক কষ্ট তাদেরকে অনেকাংশে আহত করেছে। আর “আমরাতো প্রকৃতির বাইরে যেতে পারবোনা, ”তা আমাদেরমেনে নিতে হবে, এটাই নিয়ম।
যৌথ ভাবে জন্মদিন পালন করার উদ্যোগ নিয়েছিল এ চারটি পরিবার কিন্তু তাও করতে পারেনি অন্টারিও প্রাদেশিক আইনের কারণে। ১০ জনের বেশি একত্রিত হওয়া যাবেনা, আবার সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখতে হবে। তাদের সে আশাও ভেস্তে গেলো কারণ তাদের এ চার পরিবারের সদস্যের সংখ্যা আবার ১০ এর চেয়েও অধিক।
ফালাকের মা ফারাহ জাবিন আহমেদ বলছিলেন, এখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বাচ্চাদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করা কঠিন ব্যাপার।এ করোনা পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়ে উঠছেনা, বরং প্রতিদিন একটি রুটিন করতে হয় যাতে বাচ্চাটা একটু আনন্দ পায়।করোনার কারণে তারা এখন ঘরে বন্দী, তাদের মানসিক চাপ কমানোর অন্যতম মাধ্যমহলো ঘরের বাইরের পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়া-মানে খেলাধুলা, পার্কেযাওয়া ও সুইমিং পুলে সাতার শিখা বা গল্পের বই পড়া বা কার্টুন আঁকা। তানাজের মা রওশন আরা বনা ও তার বাচ্চাদের বিনোদনের কথাভাবছেন।তিনি জানালেন, সময় পেলে তাদেরকে নিয়ে ব্যাকয়ার্ড বাগানে ব্যস্ত থাকেন ও মাঝে মাঝে দূরে কোথাও চলে যান। তবুও যেন সময়কাটছেনা।ইকতিনার মা কোহিনূর আখতার চায়না তার একমাত্র মেয়েকেনিয়ে গার্ডেনিং ও শব্জীর চাষবাদ করছেন নিজের বাড়ির আঙিনায়।এতেইকতিনা অনেক খুশি। এর পেছনে অনেক সময় চলে যায় চায়নার। তিনি জানালেন, ইকতিনার লেখাপড়া ও অনেক, আবার অনলাইনে সামারক্লাসও নিয়েছে ইকতিনা। আর রুশদার মা হুমায়রা আফরিনের দিন কেটেযাচ্ছে বাগান করে ও ছোট আরেকটি বাচ্চার দেখা শুনা করে।রুশদার টিউটরের দায়িত্বতো আছেই তার ঘাড়ের উপর।
কিভাবে বাবা-মারা এই ক্রান্তিকালে প্রবাসে তাদের বাচ্ছাদের শুধু জন্মদিন কেন প্রতিদিন ও প্রতিমুহূর্তে আনন্দ ও উল্লাসে মাতিয়ে রাখবেন, এটি এখনতাদের জন্য বড় একটি চালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাদের একাকিত্ব দূরীকরণে বাংলাদেশী পিত-মাতাদের অনেক করণীয় ও দায়বদ্ধতা আছে। তারা বাচ্চাদের সাথে সময় দিতে পারেন নিজেদের ব্যাস্ততার সাথেভারসাম্য রক্ষা করে। বলা যায়, বাবা-মাতাদের সাথে ঘরে দাবা খেলতেপারেন, ওয়ার্ড-বিল্ডিং এর মতো খেলাও খেলতে পারেন,বা ঘরে বসে টিভিতে শিক্ষণীয় কোনো ডকুমেন্টারি ও কার্টুন ছবিও দেখতে পারেন।বাবাড়ির আঙ্গিনায় তাদের সাথে বাস্কেট বল ও সকার (ফুটবল) ও খেলাযায়। এতে বাচ্চাদের অনেক অবসাদ বা একাকীত্ব লাঘব হবে।
জন্মদিন প্রতি বছরই আসবে আমাদের শিশুদের জীবনে। কিন্তু এ করোনা মহামারী শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি একটি দাগ কেটে দিয়েগেছে। শুধু জন্মদিন পালন নয়, বরং প্রবাসে বাংলাদেশী মা-বাবাদের অনেক করণীয় ও দায়বদ্ধতা আছে তাদের বাচ্চাদের জন্য। মা-বাবাদের দায়িত্ব হবে প্রবাসে তাদের বাচ্চাদের একাকিত্ব ও অবসাদ থেকে অনেক দূরেরাখা।প্রবাসে বাচ্চাদেরকে আমাদের শিকড় সম্পর্কেও জানাতে হবে। আমাদের কৃষ্টি ও কালচারকে তুলে ধরতে হবে যেন তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের সম্পর্কে জানাতে পারে।
আমাদের আঙিনা থেকে করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারি খুব দ্রুত প্রস্থান হউক, এটা আমাদের সবারই আন্তরিক কামনা।কেননা আমরা সবাইআমাদের শিশু-কিশোরদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি।
ছবি: তারেক আলী ও লেখক