মোসাহেবদের প্রিয় অজুহাত ইতালিতেও তো আইসিইউ সঙ্কট ছিল, সেখানেও তো আরও মৃত্যু হয়েছে!
ইতালিতে গত বছর সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার পর্যন্ত রোগী ছিল প্রতিদিন, মৃত্যু ছিল ৮০০ পর্যন্ত। এখনো সেখানে মৃত্যু ৪০০র বেশি, প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সেই তুলনায় বহুগুন সামান্য চাপেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে। এটা কেন?
বরিশালে এবারে বিপুল সংখ্যক করোনা রোগী, বরিশালে ঠিক কয়টা আইসিইউ আছে? সংখ্যাটা হাস্যকর।
আইসিইউ বাদ দেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ঠিক কতজন রোগীকে অক্সিজেন দেয়া যায়? সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উচ্চঘনত্বের অক্সিজেন দেয়া যায় একসাথে যে কজনকে, সেই সংখ্যাটা শুনলে মনে হবে এখনই এই নীতিনির্ধারকদের কারাগারে পাঠানো উচিত। এক্ষুণি। এবং তাদের অবিলম্বে পদচ্যুত, এবং অপরাধ অনুযায়ী বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও শাস্তি দেয়া দরকার।
সংবাদে অনেকেই দেখতে পেয়েছেন, গত বছর বসুন্ধরাতে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যায়ে একটা হাসপাতাল বানানো হয়েছিল, সেটাকে তারা আবার গুড়িয়েও দিয়েছে, রোগী ছিল না বলে! মানে গর্ত খুড়ে আবার তা ভরাট করে জলাধার উন্নয়ন প্রকল্প বানানো, আর টাকা লোপাট করা!
করোনা ইউনিট মানে কী শুধু কয়েকটা বিছানা আর অক্সিজেনের বন্দোবস্ত, আইসিইউ? অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক নয়? গত পরশু একজন চিকিৎসককে আমার ঘনিষ্ঠ এক রোগীর প্লেটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করে যে উত্তর পেলাম, তাতে বুঝলাম অভিজ্ঞতাও কত গুরুত্বপূর্ণ। রাত তখন প্রায় বারোটা, সকাল থেকে কাজ করা এই অধ্যাপকটির কাছ থেকে রোগীর অবস্থা জানানর জন্য তখনও অপেক্ষা করছেন আরও বহু রোগীর স্বজন। এক বছরে আমরা কতজন এমন চিকিৎসকও বানাতে পেরেছি? নার্স ও অন্যান্য জনবল?
এবার মূল বিষয়টা আসি। এই সঙ্কটটা কিভাবে হয়, কোত্থেকে? কারা এই নীতিনির্ধারক? বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর অল্প কয়েকটা দেশের একটা, যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোন পেশাজীবী অভিজ্ঞ চিকিৎসক নাই। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকান, সেখানে স্বাস্থ্যসচিবের পাশে আরেকটা ছবি দেখবেন, তিনি একজন সংক্রামক ব্যধি বিশেষজ্ঞ। পাবেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকেও। এছাড়া বিভিন্ন স্তরে সেখানে আছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমলাতন্ত্র সেখানে কিছু সুনির্দিষ্ট দাফতরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজই করেন। কিন্তু এই বিশেষজ্ঞরা নীতি নির্ধারণ করেন, সেটার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিউজিল্যান্ড বলেন, বা যে কোন সভ্য দেশ, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আপনি পাবেন নীতিনির্ধারণে। এটা করা হয় সরকারের স্বাস্থ্যনীতির সাথে সমন্বয় রেখে। ফলে মূল পরিকল্পনার দায়টা সরকারের, নীতিগতভাবে তা বাস্তবায়নের রূপরেখা ও নীতিকৌশলে ভূমিকা রাখেন এই বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে যে কোনটার জন্য কাকে দোষারোপ করবেন, সেটা বের করাই মুশকিল। এই যে বললাম, এতগুলো প্রাণহানি ও বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুবরণের জন্য নীতিনির্ধারকদের শাস্তি দেয়া উচিত অবিলম্বে। এই তালিকায় স্বাস্থমন্ত্রী তো অবশ্যই থাকবেন। আর থাকার কথা কার? কে ওই হাসপাতাল বানিয়ে গুড়ো করার জন্য দায়ী? দুই দুই জন সচিব স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে বদলি হয়েছেন। তাদের দায় তো আপনার মনে পরিস্কার, কিন্তু সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন? তারা দায় চাপাবেন জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘাড়ে, যারা আসলেই ঠুটো জগন্নাথ। কিন্তু দুর্নীতির জালে সেটাও যে মন্ত্রণালয়ের মতই বহুভাবে আবিষ্ট, তা তো আমরা গত কোভিডের সময়ে মন্তণালয় আর অধিদফতরের কাদা ছোড়াছুড়িতে দেখলাম।
কিন্তু কাদা ছোড়াছুড়িই দেখতে পেলাম আমরা। কে দায়ী, কার কতটুকু ভূমিকা, কে কে টাকা লোপাট করেছিলেন দুই নম্বরী মাস্ক চিকিৎসকদের দিয়ে, সেগুলো আমরা আর জানতে পারলাম না। কারণ আমলাদের শাস্তি দিয়ে দুর্নীতিপরায়ন রাজনীতিবিদরা তাদের দুর্নীতির রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, অধিদফতরের চিকিৎসকদের কেউ দুর্নীতির সাথে যুক্ত থেকে থাকলেও তারা আছেন অধস্তন ভূমিকায়, সহযোগীর বলা যায়। তাদের কঠোর শাস্তি দিলে চিকিৎসক সমাজ সঙ্গত কারণেই প্রতিবাদ করবেন। কেননা আসল অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে।
এই গোলকধাঁধায় একটা কথাই বলা যায়, পচনটা মাথার। সেখান থেকেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সেটা রাজনীতি।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক ও বিশ্লেষক
( বানান রীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব। – সম্পাদক, সোজা কথা ডটকম)