– আহমেদ আমান মাসুদ
সংবাদপত্রের দায়িত্ব এবং গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম। বর্তমান সভ্যতা বিশেষত: গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম খুঁটি সংবাদপত্রের অভাবে সভ্যতার রথচক্র থেমে যেতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক দ্বন্দ্ব সংঘাত সংঘর্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্পসহ নানা খবর মানুষের দরবারে পৌঁছে দেয় সংবাদপত্র। যার চলার পথে কোনো বিরাম নেই, অহোরাত্র জাগ্রত থেকে সুখ-দুঃখের পাচালির খোঁজে ছুটে অবিরত। আদর্শিক মতভেদ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রেম-বিরহ, বিবেক- কার্যকলাপে সংবাদপত্রই আমাদের শুভবুদ্ধি জাগরণের মহৎ প্রেরণা। সমাজের উপর যখন অশুভ শক্তির ছায়া পড়ে, যখন দিকে দিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দম্ভ, রণ হুংকার, রক্তোম্মাদনা, যুদ্ধের বিভীষিকা সভ্যতাকে গ্রাস করে তখন সংবাদপত্রই মানবতাবিরোধী হিংস্রক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে গড়ে তোলে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। ধিক্কার ধ্বনিতে সোচ্চার হয় বিশ্ববাসী, গণ বিক্ষোভের পটভূমি হয় জোরালো। যারা এই সংবাদগুলো নানাপ্রান্ত থেকে সংগ্রহ করে সকলের মাঝে তুলে ধরেন তারা সংবাদকর্মী, অতিপরিচিত ভাষায় সাংবাদিক। সাংবাদিকদের মাঝে আবার নানা শ্রেণীবিভাগ দেখা যায়। কেউ কেউ শুধুমাত্র দপ্তরে বসেই কাজ সম্পন্ন করেন, কেউ মাঠ থেকে খবর সংগ্রহ করেন। আবার মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের মধ্যে মফস্বল শহরে যারা সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত থাকেন তারা পরিচিত হয়ে থাকেন মফস্বল সাংবাদিকরূপে।
জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের নানা প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়। স্বীয় ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ জনগণের সমস্যা, সম্ভাবনা বা উন্নয়নের চিত্র উপস্থাপন করে থাকেন। সাংবাদিকদের লেখনীতে ফুটে ওঠে এলাকার সার্বিক চিত্র। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দেন। হয় এর প্রতিকার। যে সাংবাদিকের লেখনীতে জনজীবনের চিত্র বাস্তবায়ন হয় সে সাংবাদিকের বেলায় কী দেখি। একটি সংবাদ সংগ্রহ করতে শহর থেকে শহরে, গ্রাম গ্রামান্তরে ছুটে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শারীরিক ও আর্থিক দুর্ভোগে পড়েন তারা। ঝুঁকি তো আছেই। অনেক সময় ক্রাইম রিপোর্ট বা সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে অসাধু ব্যক্তি বা মহলের রোষানলে পড়তে হয়। জীবনের নিরাপত্তা হয় বিঘ্নিত। কিন্তু সে তুলনায় এসকল সংবাদকর্মীদের যে মূল্যায়ন হয়ে থাকে তা একেবারেই নগণ্য বলা যায়।
দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের ঢেঁকুর তোলে। কিন্তু বাস্তবতার চিত্র অনেক বেশী নির্মম। এই দেশে প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। বিভিন্ন সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, কখনো শিকার হচ্ছেন হয়রানির। কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন। গণমাধ্যমের এ আক্রান্ত অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র যে রুগ্ণতম সময় পার করছে তা অনুমেয়। কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র একই সুতোয় গাঁথা।
স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রায় প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ এবং সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু আজো প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচারপ্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটি ক্ষেত্রেও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বারবার সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ করে হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের পেশায় ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে বলে আশা করা যায়? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজো আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে এসব পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিচার দাবি করতে হচ্ছে। অথচ এসব হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষসহ গণতান্ত্রিক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। তাই সরকারের কাছে আবেদন রাখছি, সুষ্ঠু বিচার ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের।
ঝুঁকিপূর্ণ মফস্বল সাংবাদিকতার যুগে যারা প্রতিকূলতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে নিজেদের আপন প্রতিভা মেলে ধরে সমাজ ও দেশকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নানা দুর্যোগ দুর্বিপাকে পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রয়োজন তাদের সমস্যা চিহ্নিতপূর্বক সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা যাতে সোৎসাহে নিজেকে জনকল্যাণে নিবেদিত করে পেশার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখে। সাংবাদিকদের দুর্দিনের আঁধারে অগ্নিসেতু বাঁধতে এগিয়ে আসা প্রীতিপ্রদ। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতাই মুখ্য নয়। পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে বিজয়কেতন ওড়ানো সম্ভব। ক্ষেত্রবিশেষে দরজা না খুলেই খুলে ফেলা যায় সেই হৃদয়। জয় করা যায় ভয়। নিজেদের মধ্যে আর বিচ্ছিন্নতা নয়, প্রতিহিংসা নয়, একে অপরের সহযোগী ও সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে হবে। পেশাদারি মনোভাব নিয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতায় সমৃদ্ধ করতে হবে সাংবাদিকতাকে। ওই যে ১০০ বছর আগে কাঙাল হরিনাথ বলেছিলেন, সৎ সাংবাদিকের কোনো বন্ধু থাকতে নেই। চলমান বাস্তবতায় সত্যকে মেনে নেয়ার সৎ সাহসে একসাথে সব শুভশক্তিকে এগিয়ে যেতে হবে। সব অশুভশক্তি, অন্যায় আর হিংসাকে বিনাশ করতে হবে। এবার মুক্ত করে দেয়া হোক বন্দী বিবেককে। সত্যের জয় হোক, সংবাদপত্র ও সৎ সাংবাদিকতার জয় হোক।
আহমেদ আমান মাসুদ:
সমাজকর্মী ও ফ্রীল্যান্স লেখক