– মাসকাওয়াথ আহসান
জার্মানি করোনা মোকাবেলায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু করোনাকালে হাসপাতালে দায়িত্বপালনরত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সেবাকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে জার্মান সরকার। এর প্রতিবাদে জার্মানির ডাক্তাররা নগ্ন হয়ে ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অব্যবস্থাপনা তুলে ধরেছে।
এই খবরটি বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর সরকার সমর্থকদের প্রাণে শান্তির পরশ বুলিয়েছে। তারা ডুকরে কেঁদে ওঠার দশা, দ্যাকছেন ভাই; জার্মানিতেই মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই সরবরাহের অভাব হইছে। অথচ আমগো সফল সরকারের সমালোচকরা মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই-র সরবরাহ ও মান নিয়ে কত কথাই না শুনাইছে।
এখন জার্মানিতে ডাক্তারেরা স্বাস্থ্যবিভাগের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে যে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে; তা বাংলাদেশে ঘটলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াতো একটু ভাবা যাক; আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে।
ফেসবুকে নেমে আসতো বিরাট বিরাট দেশপ্রেমিক।
–দেখছেন ভাই আমগো সফল সরকাররে ব্যর্থ প্রমাণের কী গভীর ষড়যন্ত্র! দেশের ভাবমূর্তি যারা এইভাবে বিনষ্ট করলো; তা-গো চিহ্নিত কইরা গ্রেফতার করার জন্য সাইবার পুলিশকে আকুল আবেদন জানাই।
এই ছবি দেখে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে এসে পড়তো বিরাট বিরাট ধর্ম-প্রেমিক।
–হায়াত-মউত সব উনার হাতে। দেখছেননি রোজা-রমজানের দিনে কী বেশরিয়তি কাই-কারবার।
এইসব ছবি দেখে প্রগলভ হয়ে নেমে আসতো বিশিষ্ট লিবিডো-ভারাক্রান্ত শরীরবিদেরা।
পুরুষ শরীরবিদ, নারী ডাক্তারদের ছবির নীচে গিয়ে চ-বর্গীয় কবিতাপাঠ শুরু করতো। আর নারী শরীরবিদ পুরুষ ডাক্তারের ছবির নীচে গিয়ে ‘ক্রাশিত’ হইলাম বলে হুটোপুটি খেতো।
এই প্রতিবাদী ডাক্তারদের নিয়ে আয়োজিত হতো, টিভি টকশো। টকশো হোস্ট কিছু সরকার দলীয় বাক-পান্ডা জোগাড় করে; প্রতিবাদী ডাক্তারদের একজনকে স্কাইপের গামছা দিয়ে বেঁধে এনে ‘মাতবর বাড়ির সালিশ’ জুড়ে দিতো।
সরকারদলীয় এক পান্ডা সেখানে বলতো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিওকলে যুক্ত হয়ে প্রতিটি জেলার মাননীয় প্রশাসক বলেছেন, দেশের কোথাও পিপিই-মাস্ক-গ্লাভসের অভাব নাই। আপনারা অভাব পাইলেন কোত্থেকে?
স্কাইপে সংযুক্ত ডাক্তার এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যদি বলতো, হাসপাতালে করোনারোগী নিয়ে কাজ করছি তো আমরা; আপনাদের চেয়ে কী আমরা কম জানি এগুলোর সরবরাহ সম্পর্কে!
অমনি উপস্থাপিকা নসিহত করতো, এটা একটা একাডেমিক আলোচনা। ডাক্তারদের একাডেমিক আলোচনার ভাষা জানাটা খুব জরুরি।
ডাক্তার রাগ করে স্কাইপ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, সরকার দলীয় বাক-পান্ডা ডাক্তার বলতো, আপনি একজন ডাক্তার হয়ে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানান কীভাবে; এতে সংবিধানের বত্রিশ অনুচ্ছেদের তেত্রিশ ধারার ‘খ’ অনুযায়ী আপনি ফৌজদারী অপরাধ করেছেন।
পরদিন সরকার দলের অর্ধ-সেদ্ধ কলামনিস্ট লিখে ফেলতো; ক্ষমা করবেন ডাক্তারেরা; আপনাদের উদ্দেশ্য মহৎ নয়। আপনারা করোনার বিপদের সময় সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করছেন; ডাক্তারি পেশার সঙ্গে এইভাবে গাদ্দারি করাটা ঠিক হইলো না।
সরকার সমর্থক রিপোর্টারেরা প্রতিবাদ জানানো ডাক্তারদের কোন শ্যালকের ভাগ্নে ছাত্রদল করে; কোন চাচার নাতির ঘরের পুতি ইসলামি ছাত্র শিবির করে; তার ঠিকুজি প্রকাশ করে ফেলতো।
এরপর ফেসবুকে আবির্ভাব হতো ইতিহাস মামার, সে বিজ্ঞের মতো অনুসিদ্ধান্ত টানতো; এই ডাক্তারেরা ছাত্রজীবনে বিএনপি-জামাতের রাজনীতি করতো। অনেকের আবার বামাতি কানেকশান আছে।
‘বামাতি’ শব্দটা শুনে কোন বুড়ো ভাম বাম যে সরকারি দলে পুনর্বাসিত হয়ে হোলিয়ার দ্যান দাও হয়েছে; সে এসে চোখ টিপ দিয়ে বলতো, ল্যাঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড।
এসব দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপি এসে প্রতিবাদী ডাক্তারদের সমর্থন জানিয়ে ‘প্রতিবাদের মূল কারণ থুয়ে প্রতিবাদটিকে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র’ তকমা দেয়ার সরকারি প্রচেষ্টাটির ষোল কলা পূর্ণ করতো।
বাঁশের কেল্লা ‘হউক রোজার মাস তবু ডাক্তারদের নগ্ন ছবি জায়েজ’ ফতোয়া দিয়ে পিপিই-মাস্ক-গ্লাভসের অভাবে প্রতিবাদি ডাক্তারদের “মরলে শহীদ; বাঁচলে গাজি” দুয়াদি প্রচার করে; সরকারের ষড়যন্ত্র সূত্রের জিলাপি ভাজার তেল প্রয়োজনীয় আঁচে গরম করে দিতো।
স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয়ও বসে থাকার পাত্র নয়; সে প্রতিবাদি ডাক্তারদের কালো-তালিকা করে তাদের বরখাস্ত, ওএসডি, বদলির নির্দেশ ঝুলিয়ে দিতো। আর ফরমান জারি করতো, ডাক্তার ও নার্সদের মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সরকারি বিধিমালা মানিয়া চলুন।
সুতরাং দিনের শেষে, সরকারি প্রেস নোটের বেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের পরীসংখ্যানে ভরসা রাখুন।
- মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক
Editor-in-Chief, E-South Asia