গত ১০ মার্চ পুরান ঢাকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল৷ ৫৪ দিন পর ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় বেনাপোলের সাদিপুর সীমান্তে বিজিবি তাকে আটক করেছে৷
করোনা তখন জনপদে ঢুকে পড়েছে; করোনাভাইরাসের জীবনের শুল্ক নেবার আশংকায় মানুষ তখন ভীত। অথচ নিজভূমের গুম কারিগরদের গুমের নেশা থেমে নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের কোন পদক্ষেপের সমালোচনা করলে কিংবা সরকারের কোন নীতি নির্ধারকের সমালোচনা করলে; তাকে ভিন্নমতের ‘উইচ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গুম কারিগরদের নির্দেশ দেয়া হয়, এই উইচ হান্ট করার জন্য। সরকার যেন ইউরোপের মধ্যযুগের চার্চ; যে চার্চের বিরুদ্ধাচরণ করলেই তাকে যাজকেরা উইচ বলে ফতোয়া দেয়। অমনি গুমের কারিগরেরা বেরিয়ে পড়ে উইচ হান্টিং-এ।
কাজল বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়েসি একজন সাংবাদিক, আলোকচিত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাজল নব্বুই-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের সেইসব তরুণদের মধ্যে একজন; যারা স্বপ্ন দেখেছিলো স্বৈরশাসনের শেকড় উপড়ে; বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সভ্যতাযাত্রা শুরু করবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের প্রধান সূচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মানসেই মানুষ সাংবাদিকতার পেশায় যোগ দেয়। কাজল তার সেই স্বপ্নযাত্রায় প্রতারিত হলেন; সমাজ-রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের দ্বারাই; যারা কালের বিবর্তনে আর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতায়’ বিশ্বাস করেন না।
আদিম বঙ্গে জমিদারেরা লাখপতি হলে লক্ষবাতি জ্বেলে জানান দিতো; তারা বিরাট ধনী ও প্রভাবশালী হয়েছে। এই সাফল্য উদযাপনে তারা বাইজি এনে নাচাতো। গ্রামের কোন প্রতিবাদি মানুষ কৃষকের দেয়া করের টাকায় বাইজি নাচানোর প্রতিবাদ জানালে; জমিদার তার লেঠেল বাহিনী পাঠাতো প্রতিবাদী লোকটিকে শায়েস্তা করতে। হয় প্রতিবাদীর লাশ নদীতে ভেসে উঠতো; কিংবা তাকে গ্রামের সীমানা পার করে রেখে আসতো লেঠেলরা। শাসিয়ে দিতো, আর যদি এ গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করিস; জান হারাবি।
২০২০ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ” নব্যধনীদের পাপিয়া বিলাসে”র সমালোচনা করে সাংবাদিক কাজল আওয়ামী লীগের নব্য জমিদারদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। তাকে মামলার দড়ি দিয়ে আদালতে টেনে আনার আয়োজন করে; একজন প্রভাবশালী। পার্টি ইন পাওয়ার ভাইরাস করোনাভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী হওয়ায় কাজল গুম হয়ে যান। কাজলের পরিবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনিশ্চিত জীবনের নৌকায় চড়ে বেদনার সাগর পাড়ি দিয়েছে। কাজলের ছেলের কান্নার শব্দ অক্ষর হয়ে ঝরে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কাজলের শুভাকাংক্ষীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজলের ছবি দিয়ে পার্টি ইন পাওয়ারকে মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে, কাজল তো সেই নব্বুই-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের “অনির্বাণ”। সেই অনির্বাণকে “পার্টি ইন পাওয়ারেরা” ভুলেই গেছে।
৫৪ দিন কাজল নিখোঁজ ছিলো; নিজভূমের গুমের নৃশংস থিয়েটারটি কতকটা প্রাচীন রোমের সেই কলোসিয়ামের মতো; যেখানে গ্যালারিতে বসে রাজন্যবর্গ ও তাদের সহমত ভাইয়েরা নৃশংস মানুষ হত্যার বিনোদন নেয়; কেউ মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে বের হলে তাকে মৃত মানুষের মাথার খুলির মালা পরিয়ে দেয়।
গুম কারিগরদের গুমের চিত্রনাট্য খুব একঘেয়ে। সেই মধ্যযুগে জমিদারের লেঠেলেরা প্রতিবাদী কৃষককে গ্রামের ত্রিসীমানায় পৌঁছে দেয়া চিত্রনাট্যের অস্থিধারণ করেই যেন কাজলের ফিরে আসার গল্পটি রচিত।
৫৪ দিন পর ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় বেনাপোলের সাদিপুর সীমান্তে বিজিবি তাকে আটক করেছে; এমন খবর আসে। কাজলকে গ্রেফতার করে হাতকড়া লাগিয়ে আদালতে নিয়ে যাবার সময়; আসামি কাজলকে দেখে নিরাপরাধ লাগে; আর তাকে যারা হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; তাদের দেখে আসামির মতো লাগে। আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে; নিজভূমে অনুপ্রবেশকারী হাতকড়া পরা সাংবাদিক কাজলের ছবি দেখে মনে হয়; সে যেন বাংলাদেশের প্রতীকী ও প্রতিভূ একটি চরিত্র। ঠিক এইভাবে বেঁচে আছে বাংলাদেশ।
- মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক
Editor-in-Chief, E-South Asia