১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ আর ১৯৭১ সালের গণহত্যায় বিপন্ন মানুষের ছবি শেয়ার করুন। একটু বেশি বেশি করে করুন; কুচক্রী বৃটিশ আর খুনে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের মুখোশ খুলে দিন। এই করোনাকালে সুচক্রী স্বদেশী শাসকদের “ভুলগুলো ফুল হয়ে ফুটুক”; টাইম মেশিন মেথডে।
আপনি কী জানেন, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু’র সময় কী ঘটেছিলো! বৃটিশেরা তখন এতোটুকু চেষ্টা করেনি ভারত-বর্ষের মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। উপরন্তু সহজ-সরল জনগণকে বিভ্রান্ত করতে প্রথমে বলেছিলো, স্প্যানিশ ফ্লু স্পেনের ব্যাপার। এতোদূর অব্দি পৌঁছাইতে পারিবে না। আর পৌঁছাইলেও ফ্লু-ভাইরাস উচ্চ তাপমাত্রায় অক্কা পাইবে ।
ভারত-বর্ষের নানা জায়গায় মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যেতে থাকলে; বৃটিশেরা কলকাতায় প্রেস-কনফারেন্স করে বলেছিলো, এগুলো স্প্যানিশ ফ্লু’তে মৃত্যু নয়; সর্দি-জ্বর-শ্বাসকষ্ট-ওলাওঠায় মৃত্যু। বৃটিশ সাহেব ধমক দিয়ে বলেছিলেন, খবরদার “স্বাভাবিক মৃত্যুকে” স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যু বলিয়া গুজব রটাইতে চেষ্টা করিবেন না। ফোর-টোয়েন্টি আইনে জেলে ভরিয়া দিবো গুজবদিগকে।
এইসময় বৃটিশ কুইন ইংলন্ড হইতে কিছু ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বৃটিশের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান আর মেম্বরেরা সেই ত্রাণ লুট করে গুদামজাত করেছিলেন।
এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, বৃটিশদের সহমত ভাইয়েরা বলেছিলো; অল্প ক’টি চোরের জন্য কুইনের দুর্নাম করিবেন না। আপনারা কৃতজ্ঞ হইতে শিখুন। কৃতঘ্ন হইবেন না। এমন রাণীমা আর পাইবেন না বলিলাম কিন্তু।
এই স্প্যানিশ ফ্লু ভারতবর্ষে পৌঁছায় নাই বললেও; এই সময় বৃটিশ সাহেব-বিবি-গোলামদের চিকিৎসার জন্য ভি আই পি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা তাদের নিম্ন-বর্গের মানুষের ছোয়াচ বাঁচিয়ে চলার প্রথাটিকে আরো কড়াকড়ি করেছিলো। উচ্চ বর্ণের মুসলমানেরা নিম্ন-বর্গের মানুষদের বলেছিলো, কেবল আমাদিগের কাহারো জানাজা হইলে ঝাঁক বাঁধিয়া আইসো। অন্যথায় শত-হস্ত দূরে দূরে থাকিও।
স্প্যানিশ ফ্লুর নিউ নরমাল লাইফে বৃটিশ রাজ-কর্মচারী ও তাদের শ্যালক-শ্যালিকারা পিপিই পরে বৈঠকখানায় বসে, সংগীত চর্চা ও সাহিত্য আলোচনা অব্যাহত রাখে। থেমে থাকেনি লাবণ্য ও অমিতের প্রেম। সেসময় প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে এমনিতেই যে “সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং”-এর নিয়ম ছিলো তাতে স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণের ভয় ছিলো না। তবুও কী হয় না হয়; তাই অমিত-লাবণ্যের প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভয়ভরে “শেষের কবিতা” বলে ডাকতেন।
এইসময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দরিদ্রদের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা এ সম্পর্কে বলেছিলো, ব্রাহ্ম হইয়া জাত হারাইয়াছে যে; সে তো এমন বেজাতের মানুষ বাঁচাইতে আকুল হইবেই। সেসময় রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেন, “ভাবিয়াছিলাম স্প্যানিশ ফ্লু’র মহামারীতে মানুষের জীবন বোধ ও মানবতাবোধ জাগ্রত হইবে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা ইহারা কখনোই লাভ করিবে না।”
এসময় কিছু বিপ্লবী তরুণকে বৃটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে বৃটিশবিরোধী ষড়যন্ত্রের দায়ে। অনেক বিপ্লবী তরুণ এসময় গুম হতে থাকে। এইভাবে “স্প্যানিশ ফ্লু”-র খবরাদি গুম করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে বৃটিশ প্রশাসন।
বৃটিশ কুইন এসময় ভারতবর্ষের ঋণখেলাপী ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা পাঠান। স্প্যানিশ ফ্লু’র মৌসুমের আর্থিক প্রণোদনায় অনেক সহমত ভাইয়ের কপাল খুলে যায়। মানুষ যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে মরছে; সহমত ভাইয়েরা তখন দালান তোলার জন্য ভাটায় ইট পোড়াচ্ছে।
এইসময় ভারতবর্ষের দুটি ওষুধ কোম্পানি বৃটেন থেকে কুইনের নামে আবিষ্কৃত “ক্লোরো-কুইন” ওষুধ আমদানি করে। এই ওষুধ কেবল বৃটেনের ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিলো; সেইখানে সস্তায় এমন মানুষ পাওয়া কঠিন যার ওপরে “ওষুধ পরীক্ষা” করা যায়। তাই সে ওষুধ পরীক্ষা ভারত-বর্ষের সস্তা মানুষের ওপর প্রয়োগ করার বন্দোবস্ত হয়।
ওষুধ কোম্পানি দুটি তাদের দুটি পত্রিকায় এই ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। ওষুধের মূল্য নিয়েও প্রতিযোগিতা হয় কোম্পানি দুটির মাঝে। মহকুমা শহরগুলিতে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ধারে ওষুধের দোকানে বসে বৃটিশের সহমত ভাইয়েরা জোরে জোরে পত্রিকা পড়ে খবর রটিয়ে দেয়, “ওরে খগেন ওরে খায়ের শুনিয়া যা, ধন্বন্তরী ওষুধ আসিয়া পড়িয়াছে। মানুষ এবার বাঁচিয়া যাইবে। ওষুধের নাম কুইন; জয় রাণী মাতার জয়।”
মানুষ মহাজনের কাছে জমি বন্ধক দিয়ে টাকা ধার নিয়ে উচ্চ মূল্যের ওষুধ কেনে। আশার সওদাগরেরা তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে, বৃটিশই পারে; বৃটিশরাই পারিবে।
আশার সওদাগরেরা বলে, মহামারীতে বৃটিশ সরকার সম্পূর্ণ সফল। ব্যর্থ হইলো আমাদিগের জনগণ। উহারা অসচেতন হইয়া কোয়ারিন্তিন ভঙ্গ না করিলে মৃত্যু তাহাদিগকে অন্তরীণ করিতে পারিতো না।
তখন ভারত-বর্ষে মৃতের সংখ্যা জনগণ জানতে পারেনি; তাদের কাছ থেকে এই তথ্য গোপন করা হয়েছিলো ছলে-বলে-কৌশলে। যেকোন মূল্যে বৃটিশ রাজের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখার মহান ব্রতে, রাজ-কর্মচারী ও সহমত ভাইয়েরা “জনমানুষের মৃত্যুর তথ্য গুম” করেছিলো। পরে জানা যায়; বছর তিনেক স্থায়ী হওয়া মহামারী স্প্যানিশ ফ্লুতে ভারত-বর্ষের কমপক্ষে ৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো।
(ইতিহাস নয় ‘রম্য-ইতিহাস’)
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia