আনিসুজ্জামানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের কোন কোন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ছে। সংখ্যায় তাৎপর্যহীন, বিবেচনাশক্তিতেও গুরুত্বহীন ভেবে এসব নিয়ে কিছু সাধারণত বলি না। কিন্তু এবার বলছি রাষ্ট্রের মাঝে সমাজ কিভাবে কাজ করে, সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেই।
আনিসুজ্জামানকে মৃদু বক্রোক্তি করা যে উদ্ধৃতিটি সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমে ঘুরছে, সেটা অধ্যাপক আহমদ শরীফের। আনিসুজ্জামান সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন, কখনোই শক্ত কোন ভূমিকা নেননি এসবই সেখানে বলা হয়েছে, যেন পদ্মপাতা, জলে থাকলেও সেখানে জলের ফোঁটা লেগে থাকে না।
আহমদ শরীফ ও আনিসুজ্জামান উভয়েই পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। আহমদ শরীফ নিজের জন্য একটি নিরাপোষ আর অনমনীয় ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেটা করেননি। এইটা আহমদ শরীফের বলা তা্ই মানায়। আমরা তো সমকালীন বহু মানুষের নীরবতার সমালোচনা করি, তাদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশ্যা করি বলেই। আহমদ শরীফ সেটা আরেকটু স্পষ্ট করে করেছেন।
কিন্তু এরপরও সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গুরুত্ব বিপুল, এবং সেইখানে আমি নিশ্চিত, আহমদ শরীফ কিংবা বদরুদ্দীন উমরের মত মানুষও তাকে অশ্রদ্ধা করবেন না। খুব মোটা দাগে তাকে অন্যান্য মোসাহেব বুদ্ধিজীবীর সাথে মিলিয়ে ফেলাটা অন্যায় হবে।
সকলের ব্যক্তিত্বের ধরনটি একই হয় না। সমাজবিশ্লেষণ ও রাষ্ট্র বিষয়ে আকাঙক্ষা সকলের একই রকম হতে হবে, এটা আশা করা মূর্খতা। কিন্তু আনিসুজ্জামানের মত মানুষ যে সততা, ইতিহাসনিষ্ঠা এবং সহিষ্ণুতা জীবনভর দেখিয়েছেন বলে জানি, তা গুরুত্বপূর্ণ।
একটা ঘটনার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। ৯৮ সালের দিকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব বিষয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হয়, গাফফার চৌধুরী সেটার উদগাতা ছিলেন। বদরুদ্দীন উমর সেই বিতর্কের অবসানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে উদ্ধৃত করেছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব যদি কাউকে বলতেই হয়, সেটা যে বিস্মৃতপ্রায় অলি আহাদই ছিলেন, তা প্রতিষ্ঠিত করতে। আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরকে পত্রে লিখেছিলেন: ” অলি আহাদের পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মপন্থা সম্পর্কে আমার তীব্র বিরাগ থাকলেও ভাষা আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বের জন্য আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। প্রকাশ্যে তাঁর নাম বহু সভায় বলেছি – যখন তাঁর কথা ভুলে সবাই শেখ মুজিবের নাম বলছিলেন।”
এমন উদাহরণ অজস্র দেয়া যাবে। মোরশেদ শফিউল হাসান আরও অন্তত একটি উদহারণ হাজির করেছেন তার বুদ্ধিবৃত্তিক সততা আর তথ্যের প্রতি নিষ্ঠার, যে বিষয়ে এখনো অধিকাংশ মানুষ ভুল জানেন। মোরশেদ শফিউল হাসানকেই উদ্ধৃত করা যাক: ” বছর দুই আগে আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে এক আলোচনা সভায় তিনি বললেন, নজরুলের ‘চল চল চল’ গানে ‘মহাশ্মশান’কে ‘গোরস্থান’ করার কাজটি আসলে পাকিস্তানি শাসকরা নয়, নজরুল নিজেই করেছিলেন (‘নব-নবীনের গাহিয়া গান /সজীব করিব মহাশ্মশান’-এর পরিবর্তে ‘তাজা-বতাজার গাহিয়া গান/সজীব করিব গোরস্তান’)। আর ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’-র পরিবর্তে ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি’ করা হয়েছিল ১৯৫০ এর দশকে ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। পাকিস্তানবাদীদের ভাষা ও সাহিত্য সংস্কার প্রয়াসকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে একটি সম্ভাব্য নমুনা হিসেবে। ”
এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইতিহাসের বহু ভুল নির্মাণ এই বদ্ধ ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গেও মোরশেদ শফিউল হাসান বলেছেন, “এ নিয়ে আগে একবার লিখতে গিয়ে আমি বলেছি, ‘এর মধ্যে প্রথম তথ্যটি আমার (এবং নিশ্চয় আরো কারো কারো) জানা থাকলেও, পরেরটি সেভাবে জানতাম না।’ “আর ‘আমাদের সরলীকৃত ইতিহাসচর্চার বিপরীতে’ ড. আনিসুজ্জামান না হয়ে ‘অন্য কেউ বললে, হয়তো কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করা হতো’। ”
হয়তো কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করা হতো না, সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রশত্রু হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারতেন। গাফফার চৌধুরী বনাম বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের মামলাতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিকভাবে তাঁর অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, এবং এরপরও আনিসুজ্জামান ইতিহাসের প্রতি তার নিষ্ঠার কারণে যখন যাকে কৃতিত্ব দেয়া প্রয়োজন তা দিতে দ্বিধা করেননি।
মোসাহেবী বুদ্ধিজীবীপনা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান করেননি। সেই কারণেই প্রয়োজনীয় স্থলে রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। স্মরণযোগ্য বর্তমান সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের বলে পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে বহু শিক্ষাবিদ কথা বলতে কুণ্ঠিত বোধ করেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অবলীলায় বলেছেন, ‘আমরা শিশুদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর কথা বলছি। অথচ সেই চাপ কমাবার পথে না গিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতেও একটি পরীক্ষা যোগ করেছি। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও বলেছেন—এই পরীক্ষার কোনো আবশ্যকতা নেই, এটা শিক্ষার্থীদের জন্য পীড়ন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।’ ”
উদাহরণ ভারী করবার প্রয়োজন নেই। এগুলো বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার অবস্থান। কিন্তু এর চাইতেও বড়কথা হলো সমাজে সকল কিছু সর্বদা কেবল প্রতিপক্ষ হিসেবে চলতে পারে না। প্রতিটা ধর্মঘটের পর এমনকি শ্রমিকদেরও দরকষাকষির প্রতিনিধি লাগে, যাদের একটা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা অপরের কাছে আছে। খেয়াল করবেন, যখন আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের মত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, যাদের প্রধান ভাবমূর্তিটি ছিল রাষ্ট্রের সমালোচনা, পর্যালোচনা এবং বিকল্প উপস্থাপনের, তখন আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রাজ্জাক কিংবা এমনি সব মানুষেরা ছিলেন যাদের একটা সর্বমান্যতা, যোগাযোগের সক্ষমতা ছিল, সকলেই এই টুকু আস্থা রাখতেন যে, দলীয় স্বার্থকে জাতির স্বার্থের চাইতে বেশি গুরুত্ব তারা দেবেন না। দলীয় লাঠিয়াল বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা তিনি পালন করেননি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের রাজনৈতিক পক্ষপাতের সাথে আমাদের ভিন্নমত থাকুক, সেটা সমাজের জন্য স্বাস্থ্যকর। বরং বাংলাদেশ যে বিশেষ সংকটে আছে, সেটা হলো যে ধরনের শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত আছে, তাতে বুদ্ধিজীবীদের কোন প্রয়োজনীয়তাই সমাজ থেকে প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের রাস্তায় নামার ফলে খালেদা জিয়ার বিএনপি লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের অধিকার কেড়ে নেয়া ব্লাসফেমী আইন প্রণয়ন থেকে বিরত থাকেন। আজকে কোন বুদ্ধিজীবী সমাজের ন্যুনতম কোন পাত্তা রাষ্ট্রের কাছে নেই, এটা একটা সম্পূর্ণত আমলাতন্ত্রচালিত একটি রাষ্ট্রযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ফলে আলাপ, সংলাপ, জাতীয় প্রশ্নগুলোতে সমঝোতা ইত্যাদি অসম্ভব প্রায় শব্দে পরিণত হয়েছে। এই কারণেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাকট এর মত ভয়াবহ আইন বাংলাদেশে আনায়াসে চলতে পারছে, ওই অর্থে বলা যায় বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের কোন সামাজিক ভিতত্তি এখন তেমন একটা নেই, সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব দেয়ারও কোন প্রয়োজন রাষ্ট্রের তাই নেই।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর এই সামাজিক ভূমিকা দিয়েও অনেক বড় একটা স্থান অধিকার করে ছিলেন, এবং তাঁর বিদায়ে অনেক বড় একটি শূন্যস্থানই তৈরি হলো।
– ফিরোজ আহমেদ
রাজনৈতিক সংগঠক, বিশ্লেষক