দিগন্তে সোনালি রেখা
লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে; ছোটবেলায় এই ছড়া পড়ার কারণে; গাড়ি কেনা বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একটা অনেক বড় স্বপ্ন পূরণের ব্যাপার। কারো যদি গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকে; তাহলে তার পক্ষে করোনাকালে কমপক্ষে তিনমাস “কোন উপার্জন না করেও” টিকে থাকতে পারার কথা।
কিন্তু সামর্থ্য না থাকার পরেও নেহাত ছোট বেলায় পড়া গাড়ি-ঘোড়ার ছড়ার প্রভাবে জীবনে প্রথম উপার্জন শুরুর পরেই ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি কিনে ফেলে অনেকে। সেকারণে ঐ গাড়ির কিস্তি শোধ করার জন্যই কাজের সন্ধানে বেরিয়ে করোনাকালে রাজপথে রীতিমত গাড়ির জট পাকিয়ে ফেলেছে “গাড়িওয়ালারা”।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রধান প্রধান মেট্রোপলিটানগুলোতে মেট্রোরেল রয়েছে; বাস সার্ভিস রয়েছে। কেবল দুটো প্রধান শহরে কোন গণপরিবহন ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের ঢাকা আর পাকিস্তানের করাচিতে সর্বদলীয় মাফিয়ারা কোন পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেয়নি। বাস মালিক সমিতির মাফিয়ারা ঢাকা ও করাচিতে নাগরিকদের জিম্মি করে রেখেছে। করাচিতে বৃটিশের প্রচলিত ট্রাম উঠে গেছে বাস-মাফিয়াদের ষড়যন্ত্রে।
এই বাস্তবতার কারণে দিল্লি কিংবা মুম্বাইয়ে যে উপার্জনের মানুষ মেট্রোরেলে চড়ে; ঢাকা কিংবা করাচিতে সেই একই উপার্জনের মানুষ গাড়ি কিনতে বাধ্য হয়।
আর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে দুর্নীতি বিপ্লবের মাধ্যমে অনেক হত-দরিদ্র রাতারাতি ধনী হয়েছে। ফলে ঠিক কয়টা গাড়ি হলে তাদের চলে, সেই নিড এসেসমেন্টের ক্ষমতা নেই তাদের। তাই একটা গাড়ি নিয়ে স্বামী যায় ধান্দায়, আরেকটি গাড়ি নিয়ে স্ত্রী যায় পার্লারে; আরেকটি গাড়ি নিয়ে ছেলে যায় কোকেন খেতে; চতুর্থ গাড়ি নিয়ে মেয়ে যায় ক্রাশের সঙ্গে কফি খেতে। চারজনের একটি পরিবার রাস্তায় চারটি গাড়ির জায়গা নিয়ে রাখে; ফলে দুঃসহ জ্যামে নাকাল হয় পুরবাসী।
ভারতে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত গাড়ি কেনে সেখানকার মানুষ। কালে-ভদ্রে রাস্তায় বিদেশে প্রস্তুত করা গাড়ি চোখে পড়ে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি দেখা যায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাস্তায়। এতো দামি গাড়ির বহর ইউরোপেও চোখে পড়বে না কারো। ইউরোপে সব বিত্তের মানুষ ট্রামে চড়ে। একটু বয়েসিদের গাড়ি থাকলেও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তারা সে গাড়ি বের করেন না। ইউরোপে তাই আজকাল দামি মডেলের নতুন গাড়ি দেখলেই সবাই বুঝে ফেলে, এটা নিশ্চয়ই আরব বিশ্ব বা দক্ষিণ এশিয়ার কোন অভিবাসী; যে কাঁচা পয়সার মুখ দেখেছে।
বড় বড় গাড়ির কালচারটি এমেরিকায় উপস্থিত। সে কারণে এমেরিকার গণপরিবহণ ব্যবস্থা পশ্চিমা বিশ্বে নিকৃষ্ট। এমেরিকার মননটি আরব বিশ্ব আর ভারতীয় উপমহাদেশের আদলে গড়া; টেকাটুকা-অশিক্ষা-শো অফ; এই রোগগুলো উপস্থিত বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোক সেখানকার জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা।
দক্ষিণ এশিয়ায় এসে যাওয়া উবার ও অন্যান্য ট্যাক্সি সার্ভিস পরিবহণ সমস্যার কিছুটা সমাধান এনেছে। কিন্তু নিজের একটা গাড়ি থাকা যেহেতু “স্টেটাস সিম্বল”; তাই “তোরা যে যা বলিস ভাই; আমার সোনার গাড়ি চাই”; এই আউটডেটেড চিন্তার ভ্রান্তি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে বের করে আনা কঠিন।
এর মধ্যে একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা দক্ষিণ এশিয়ার দিগন্তে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণযুগ ১৯৬০-৯০ এই সময়কালের মানুষেরা জীবনের গভীরের জীবনকে খোঁজার প্রতীতী নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ১৯৯০ থেকে ২০২০; এই সময়টি ফাঁপা চিন্তার ফ্যাশানবাদিতা আর টেকাটুকার চিন্তায় দিশেহারা হলো। একটা পরিবারের দাদা ছিলেন, সাদাসিধে দর্শনের লোক; ছেলে “হলেন টাকা টুকা হাওয়া; আর চেটে চুটে খাওয়া”র পেট মোটা সব লোকেরা। এই পরিবারের নাতিটিকে আবার দেখতে পাই দাদার সোনালি যুগের অনুসন্ধান করতে।
করোনাকালে সোনালি যুগের দাদা চলে গেলে; বাবাকে ধূসর যুগের বিভ্রান্ত মানুষ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করে; নাতি দাদাকেই আইকন হিসেবে বেছে নিচ্ছে। যে দাদার বাহিরি চটক ছিলো না; দামি রেষ্টুরেন্টে খাওয়ার জেল্লা ছিলো না; বড় গাড়িতে চড়ার বাতিক ছিলো না। স্থূল সুখের খোঁজ মোহরের মাঝে না করে যে দাদা সূক্ষ্মতম গভীর বোধের মানুষ ছিলেন।
এই তো আর চার-পাঁচ বছর; মনে হবে আবার যেন ২৫ বয়েসী যুবক আপনার জন্য সাদাসিধে যুগের প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছে। সোনালি যুগের মানুষের সাদাকালো ছবির পাশে; আসন্ন বোধের প্রত্যাবর্তনের নিভৃত নায়ক যে একবিংশের প্রথম আলোয় চোখ মেলেছিলো; তার একখানি ছবি রেখে দেখুন; কত মিল তাদের চোখের তারায়; স্মিত হাসির ঝিলিকে।
(ক্রমশঃ)
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia