‘… মৃতের নাম সুকুমার পতি। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। বাড়ি পুরুলিয়া জেলায়। তিনি পরিযায়ী শ্রমিক কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সুকুমার পতি কোথায় কী কাজ করতেন? কোথা থেকে কীভাবে খড়্গপুর শহরের বাইরে ৬নম্বর জাতীয় সড়কে এলেন–কিছুই জানা যায়নি।
…
রবিবার রাতে ওই ব্যক্তি খড়্গপুরের চৌরঙ্গী এলাকার কাছে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লরির তলায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে লরি চালক বা খালাসি না দেখেই লরিটি চালিয়ে নিয়ে চলে যান। তাতেই পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ওই ব্যক্তির। তিনি কেন লরির তলায় ঘুমোচ্ছিলেন, তা জানা যায়নি। এলাকাবাসী একাংশের অনুমান, পাম্পের আশপাশের দোকানে কেউ ঘুমোতে দেবে কিনা, তা ভেবেই হয়তো দাঁড়িয়ে থাকা লরির তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ক্লান্ত থাকায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ায় লরি স্টার্ট করার সময় বুঝতে পারেননি।
…’ (এই সময় ১২ মে ‘২০)
রেললাইনে নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লরির তলায়। রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা পোড়া রুটি অথবা ছেঁড়া চটির ছবি নেই। এবং মাত্রই একজন। তাঁরও একটা ফটো পর্যন্ত নেই। সুতরাং ভাইরাল হয়ে ওঠার মতো কোনও উপাদান খবরে নেই!
শ্রমিকরা রেললাইনেই কেন ঘুমিয়ে ছিলেন, রেললাইন কী ঘুমানোর জায়গা– ট্রেনে কাটা পড়ে মরে যাওয়া ওই ১৫/১৬ জন শ্রমিকদের মৃত্যুর দায় যাঁরা ওই শ্রমিকদের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চান– তাঁদের বাড়িতে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমানোর জায়গা আছে। নিশ্চিতভাবেই থাকে। এবং সচরাচর প্রয়োজনের থেকে বেশিই থাকে।
করোনা-সংক্রমণ রুখতে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি লকডাউন-এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অপরিসীম দুর্দশার জন্য– দেশের জনসংখ্যাকে, আসলে গরিব মানুষদের পরিবারে অধিক সন্তান হওয়াকে, দায়ী করেন ওই ‘তাঁরা’ই।
ওই ‘তাঁরা’-ই মহানগরের-রাজ্যের-দেশের কিছু ‘নির্দিষ্ট’ এলাকায় লকডাউন না-মেনে স্থানীয় জনগণের রাস্তায় ‘অবাধ’ চলাচলের জন্যে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের দোষী বলতে চান, আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন, ‘প্রগতিশীল’ বিশেষণটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে সরাসরি বলে উঠতে পারেন না।
ওঁরা কেউই কিন্তু অশিক্ষিত নন, বরং উচ্চ শিক্ষিত। মেধাহীন হলেও, ওঁরা কেউ কেউ কবিতা-টবিতা লেখেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি করেন-টরেন।
ওঁরা সম্পন্ন, সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত। শাসনব্যবস্থার, সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার।
যে কোনও সামাজিক ঘটনার স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়ায়, আমাদের শ্রেণিচরিত্রের প্রতিফলন ঘটে, ব্যতিক্রমহীন ভাবেই।
‘মনে থাকবে’, ‘হিসাব নেওয়া হবে’– ফেসবুক-নির্ভরশীল মধ্যবিত্ত প্রতিবাদজীবী, আগুনখোর বিপ্লবীদের এই সব আবেগধর্মী স্লোগান, শেষ পর্যন্ত ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকে, থাকবেও।
প্রকৃত ভুক্তভোগীরা, শ্রমজীবি ওই মানুষেরা যদি না মনে রাখেন, কড়ায়-গন্ডায় হিসেব বুঝে নিতে যদি না চান– তাহলে এইভাবেই চলছে, চলবেও। যতদিন না পর্যন্ত ততদিন!
– কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
কলকাতা ১৩ মে ২০২০