ঢাকা থেকে উদ্বিগ্ন স্বজন জানালেন সংবাদটি। পাশাপাশি একটা নিউজ ক্লিপও পাঠালেন। বিদেশে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন পত্রিকায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর প্রচারকারীদের পাসপোর্ট বাতিলের কথা ভাবছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রিপোর্টে বলা হচ্ছিল এরই মধ্যে দূতাবাস গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ইউকে‘র একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকসহ অন্য একজন, ইতালী হতে আগত লন্ডনে স্থায়ী হওয়া এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নাগরিক ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক মোঃ মাইনুল ইসলামের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হচ্ছিল।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন এরা সহ অন্য যারা এমন করছে তাদের পাসপোর্ট বাতিলের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
প্রথমে একটা বিষয় বলে নেই এখানে যে চারজনের কথা বলা হয়েছে, খবর নিয়ে জেনেছি তাদের মধ্যে বিএনপি নেতা বাদে বাকিদের তিন জনের বাংলাদেশী পাসপোর্টই নেই, তারা বিদেশী পাসপোর্ট হোল্ডার। মন্ত্রী বলছিলেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এ ধরনের তৎপরতা বন্ধের জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিল। এনটিএমসি শতকরা ১৯ ভাগ অনুরোধ ফেইসবুক বাস্তবায়ন করেছে বলে জানা গেছে। অনুরোধগুলো কেমন? একদিন হয়তো তাও জানা যাবে!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি জানেন না যারা বিদেশী পাসপোর্টধারী তাদের তো বাংলাদেশের পাসপোর্ট ই নেই, তাহলে তিনি কি বাতিল করবেন! আসলে এটা তাদের একটা বাতিকের পর্যায়ে চলে গেছে। কদিন পর একে ফিরিয়ে আনা হবে ওকে ফিরিয়ে আনা হবে‘র মত যে সব রাজনৈতিক স্টান্টবাজি উনারা করেন এটা সম্ভবত: তারই এক প্রকার ধারাবাহিকতা।
গুজব, মিথ্যা তথ্য অর্ধ্বসত্য কখনোই সমর্থনযোগ্য ই তো নয় বরং নিন্দনীয়। কয়েক মাস আগে একজন ইনবক্সে একটা মেসেজ দিলেন কক্সবাজারে কারা নাকি এক ধর্ম গ্রন্থ অবমাননা করেছে। তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম কে বা কারা তাকে এটা ইনবক্সে দিয়েছে, উদ্বিগ্ন তিনি তাই শেয়ার করেছেন। কোন প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়া। এরকম কাজ যে খুবই বিপদজনক হতে পারে- ঐ ভদ্রলোক কে বোঝালাম। ভদ্রলোক কে খোঁজখবর নিয়ে নিয়ে জানাতে বললাম। পরে আর তিনি যোগাযোগ করেননি। অর্থাৎ তিনি নিজেই নিশ্চিত হতে পারেননি বলে ধরে নিতে হচ্ছে। দেখা গেছে একটা গুজব, অসত্য অথবা আধাসত্য তথ্য প্রচার দশটা সত্য ঘটনাকে আড়াল করার সুযোগ করে দেয়। একটা গুজবের সূত্র ধরে সহমত ভাইরা সব সত্য ঘটনাকে অস্বীকার করে। যেখানে সত্যটুকু লিখলে মহাসাগর হয়, সেখানে গুজব বা অর্ধ্ব সত্যের পঁচা ডোবা নালা কেন?
যারা তাৎক্ষণিক লাইক কামানো ব্যবসা, অজ্ঞতা বা রাজনৈতিক কারণে গুজব রটান, আর যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে এমন কথা বলেন যা গুজবের মত শোনায় এই দুই শ্রেণীই সমান বিপদজনক। গুজব রটনাকারী বা ক্ষমতাধরদের যারা স্বভাবসিদ্ধ ছোট বড় সব কিছুতে আত্নম্ভরিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, স্হূল আলোচনা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দরকারি আলাপ আলোচনার উপলক্ষকে ভন্ডুল করে দেয়, জাতীয় সম্পদের চোর ডাকাত ও ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির চেয়ে এদের অপরাধ অনেক বেশি। মানুষকে অবান্তর বিষয়ে ব্যস্ত রেখে মনস্ত্বাতিকভাবে এরা নিজেদের মতই যেন অসুস্থ করে, সমাজ সম্ভাবনা ও বৈচিত্র্যময় প্রতিযোগিতামূলক এ সময়ে জীবন জগতকে বোঝা ও তার জন্য প্রস্তুত হবার পথকে রুদ্ধ করে রাখে। তাই করোনায় আক্রান্তের হবার বিপদের মুখে তার মুখে ভ্যাকসিনের কথা। সর্বসম্মত কোন কার্যকর ঔষধ বিশ্বে না থাকার সময়ে ঔষধ বানানো নিয়ে ব্যস্ততা ও ব্যবসার আয়োজন এবং এ নিয়ে গবেষকদের চেয়েও যারা অহেতুক গালগল্পে ব্যস্ত। যে সব দেশে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন সম্ভাবনা বেশি তাদের নাগরিকরা কবে পাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত না হলেও আশার সওদাগররা এমনভাবে বলছে যেন পাড়ার দোকানে নেক্সট উইকেই যেন ভ্যাকসিনটা পাওয়া যাবে। প্রায় সব দেশ জাতি মহামারীর বিপদে করোনা গ্যালিভারের সাথে যুদ্ধ করছে, তখন আমাদের দৃশ্যত: শারীরিকভাবে দুর্বল উজির রা লিলিফুটিয়ানদের মত করোনাকে সুতায় বাধার জন্য যেন কথার মিসাইল ছুড়ে মারছে!
সচেতন পাঠকের ক্ষেত্রে এ সবে সে রকম সমস্যা না হলেও সাধারণ মানুষ এতে বিভ্রান্ত হতে পারে। বিগত মিডনাইট ইলেকশনের আগে এ রকম ১৫ টি পেজ ও ওয়েবসাইট ফেইসবুক নিষিদ্ধ করে জানিয়েছিল, সরকারের মধ্যকার এক লোক এ কাজটি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক পলিটিকালী নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি এ কাজটির মূল হোতা। মনে পড়ে মাহবুবুল হক শাকিলের কথা। ঢাবিতে এক বিভাগে এক ক্লাসেই পড়তাম। তাঁর সময়ে এমন কাজ হয়েছে বলে কখনো শুনিনি। সব দিকেই যেন শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে দিনে দিনে। যার স্থান পূরণ করছে বিভিন্ন গ্যাং এর পৃষ্ঠপোষকরা, দু:সংবাদ এটুকুই।
সে যাক একই সংবাদে দেখলাম স্বরাস্ট্রমন্ত্রী দাবি করছেন-দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর প্রচার করায় ডিজিটাল আইনে সাংবাদিকদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। মূলত: এ বক্তব্যেই তাঁর মোটিভ পরিস্কার। এটা কে না জানে, সম্প্রতি ত্রাণের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখায় বেশ ক’জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা ও মামলার পরপরই এদের অধিকাংশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনুসন্ধান নয় বরং ডেকে এনে স্ক্যুপ নিউজ দেয়ার কারণে গদগদে সাংবাদিক এ নিয়ে বা এই যে ‘ ‘ সম্ভাব্য গুমের‘ ভিকটিম সাংবাদিক কাজল এখনো জেলে, স্রেফ স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম নিয়ে লেখার কারণে লেখক মুশতাক আহমেদ কিংবা দিদারুল ভূঁইয়া এবং দারুণ শৈল্পিকভাবে অনিয়ম অব্যবস্থাপনার উপর চমৎকার কার্টুন করার অপরাধে কেন কিশোরকে এই মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যগতকারণে মারাত্নক ঝুঁকি পূর্ণ কারাগারে আটক রাখা হয়েছে ; সে সব নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন শক্ত প্রতিবাদ বা পেশাজীবী সাংবাদিকবৃন্দ মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মত নৈতিক সাহস ও পেশাগত দক্ষতা রাখেন কিনা প্রশ্ন তোলাই যায়। রিপোর্টে আবার এক সিনিয়র সাংবাদিকের বক্তব্য প্রচার করা হয়, এক সময় আমরা যাকে অগ্রজ হিসেবে আদর্শ স্থানীয় একজন মনে করতাম, তাঁর কন্ঠে বর্তমানে যে সাংবাদিকদের উপর হামলা মামলা চলছে তা নিয়েও কোন রা ছিল না। বরং সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ পেপারের বিষয়ে কেমন যেন উস্কানিই দিলেন। বিবেক বিক্রি আর সাধারণ সমর্থনের মধ্যে পার্থক্যটুকু তিনি যেন বুঝিয়ে দিলেন।
যারা নিজেরা এমন কথা বলে যে গুলো প্রায়শ: গুজবের মত শোনায়। যে গুলো প্রায়শ: মিথ্যা তথ্যভিত্তিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ, করোনা সর্দি কাশি বা করোনার চেয়ে শক্তিশালী কিসিমের কথা, তখন বরং তাদের একেক একেক জনকে গুজব মিথ্যা তথ্য প্রচারকারী মনে হয়। অব্যবস্থাপনা, চাল চুরি বা নগদ টাকা চুরি বা কাঁচা ধান কাটার দৃশ্য কোনটাই মিথ্যা নয়, তারপরও এ সব নিয়ে কেউ কথা বললে কেন কালো আইনে মামলা হবে? সে মামলা কেন নেয়া হবে? পিপিই সংকট নিয়ে কথা বলায়, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলায় লেখক মুশতাক আহমেদ এবং নানা শৈল্পিক কার্টুনের মাধ্যমে ঘুষ দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে কিংবা বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করে দিদারুল ভূঁইয়া কী অন্যায় করেছেন? না সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের মত ভূমিকা রাখছিলেন। মুশতাক আহমেদকে ৪ তারিখ তুলে নিয়ে ৫ মে তারিখে গ্রেফতার দেখানো এ সব বেআইনি কাজ কেন? ২০১৬ সালে হাইকোর্ট সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতির কথা বলেছে যা যে কোন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কাউকে গ্রেফতার করার সাথে সাথে গ্রেফতারের কারণ এবং তার নিকটাত্মীয়দের গ্রেফতারের বিষয়ে অবহিত করণ এসবের ব্যত্যয় ঘটছে কার ইশারায়? অনাবাসী সাংবাদিক সহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সরকার কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়?? উপরন্ত্ত যে মামলা পুরো সাজানো ও গোঁজামিলের বয়ান বৈ বেশি কিছু নয়। সাদা চোখে যেখানে দেখা যাচ্ছে যৌক্তিক ও তথ্যবহুল আলোচনা সমালোচনা কে এক চিমটি ষড়যন্ত্রের বিষ মিশিয়ে একটা মামলা বানানো হলো তখন, যখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অনেক দেশ তথ্য নিচ্ছে মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য।
দেখা যাচ্ছে, একদিকে হুমকি ধামকি মামলা জুলুম দিয়ে এক পক্ষকে চুপ করানো হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দের বংশবদ সাংবাদিক এবং ঘনিষ্ঠ মালিক পক্ষ ইতোমধ্যে মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকার চেয়ে সরকারের ধামাধরা অবস্থানেই বেশ সাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। নিজেদের লাভালাভেই মূলধারার মিডিয়া র কিছু কথিত সাংবাদিক নেতা সোশ্যাল মিডিয়া র অপ্রতিরোধ্য গতি, বিস্তার ও প্রভাবে সন্তুষ্ট নয়, তাই সোশ্যাল ও অনলাইন মিডিয়ার ভিন্নমত দমন দলনে এরা প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষভাবে উস্কানিও জুগিয়ে যাচ্ছে। গুজব অবশ্যই নিন্দনীয়। পাশাপাশি সত্যকে যারা সত্য বলছে তাদেরকে মামলা হামলার আসামী করে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি দিয়ে স্তব্ধ করার চেষ্টাও চরম নিন্দনীয়। আবার এসব চরম নিন্দনীয় কাজ কিন্তু পরোক্ষভাবে গুজবের ই চাষবাস করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব আপনাকে কানে কানে বলি – আপনি এবং আপনার সহকর্মীদের বেশিরভাগ কথাই মানুষ বিশ্বাস করে না, গুজবের মত করে নেয়।
মুশতাক, কিশোর, কাজল, দিদারুলদের মুক্তি দিয়ে নিজেদের ত্রুটির দিকে মনোযোগ দিন। প্রবাসে থাকা যে সব মানুষজন আপনাদের ক্রিয়া কর্মের বিশ্লেষণ করছে তারা কেউ রাস্ট্রবিরোধী কিছু করছে না। মিডিয়া, নির্বাচন, শিক্ষা, ব্যাংক, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য কোন খাত বাকি রেখেছেন। দয়া করে এ দুর্যোগের দিনে মহামারীতে মনোযোগ দেন, মহামারীটা বিএনপি বা পাকিস্তান জাতীয় কিছু নয় যে, চোপা দিয়েই প্রায় আদ্দেক দমন করে ফেলবেন!
সর্বশেষ: মুশতাক কিশোরদের জামিন আবেদন নিয়মিত কোর্টে উপস্থাপনের পর জামিন নামঞ্জুর করেছে ভার্চুয়াল মেজিস্ট্রেট আদালত। ভার্চুয়াল বলেছেন নিয়মিত আদালতে বিষয়টির সমাধান হবে। এক সময় মেজিস্ট্রেটরাও পলিটিক্যাল কেসের আসামীদের জামিন দিয়ে ফেলতেন, আজকাল জেলা জজও সাহস করেন না, যদি পলিটিক্যাল আসামী ক্ষমতাসীন দলের নেতা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। পিরোজপুরে মিঃ আউয়াল কে নিয়ে আইনমন্ত্রীর নির্লজ্জ ভূমিকাতো তার আমলের আরেকটা কলংক তিলক হয়ে থাকবে।
হতদরিদ্রদের সাহায্যের তালিকা যাছাইয়ের কাজ পেয়ে নিজেকে কলুর বলদ বলায় এবং সহকর্মী তিন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক ফেইসবুকের সেই পোস্টে লাইক দেয়ায় বাগমারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও নির্বাহী কর্মকর্তা চার প্রাথমিক শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। বাগমারার এ দুই জন কর্মকর্তা র মনমানসিকতা মনোলোকে দাসত্বের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে।
– শাহ আলম ফারুক
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী
সম্পাদক (অবৈতনিক) স্ট্রেইট ডায়ালগ ডটকম