জুঁইফুলের মতো সাদা ভাতের প্রার্থনায়
এই আপনি কিংবা আমি; যারা একটা আধুনিকতার নাগরিক বুদবুদের মাঝে বসবাস করি; তারা দারিদ্র্য দেখেছি চলচ্চিত্র কিংবা ট্রেনের জানালা দিয়ে বস্তিতে। আর বিশ্বায়নের অভিঘাতে আমরা বিশ্বনগরে বসবাস করি; যেখানে আমরা রূপকথার এক জগত সাজিয়ে বসে আছি।
রূপকথার বাসিন্দাদের এই করোনার সময়টিতে দেখলাম; গরিব মানুষ কেন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলছে না; এ নিয়ে এফলুয়েন্ট ভাইয়া আর আপ্পিদের অভিযোগের অন্ত নেই। বিশ্রামে হত কতিপয় একটিভিস্ট দিনে একবার কোথাও জমা হওয়া মানুষের ভীড়ের ছবি পেলে; তা ফেসবুকে শেয়ার করে; গরিবদের গালি দিয়ে “এফলুয়েন্সের আনন্দ” তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন।
অথচ একজন বাদামওয়ালা; যিনি ট্রেনে বাদাম বিক্রি করলে; তবে তার শিশুর মুখে একটু অন্ন তুলে পারেন; জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাতের স্বপ্নে যারা বাঁচে; তারা করোনাকালে কী কষ্টে বেঁচে আছেন; তা অনুধাবন করার ক্ষমতা অভিযোগ ভাই ও আপ্পির নেই। কারণ তারা অভিযোগ করলেই মা খাবার এনে দিয়েছেন ছোটকাল থেকে; কিন্তু নিরন্ন মা তার সন্তানের অভিযোগে “চুলায় পাথর সেদ্ধ করে” মিথ্যা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেন না। সেই নিরন্ন মা তার সন্তানকে নিয়ে করোনাকালে কেমন আছেন; আমরা কী তা জানি!
করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র মানুষের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলে; ঠিক তখন মনে হলো; দরিদ্র মানুষের একটি তালিকা প্রয়োজন। দেশ “ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে একটি দশক হলো”। কিন্তু ঠিক কীরকম অর্থনৈতিক অবস্থা গরিব মানুষের তার কোন “ডিজিটাল তালিকা” তৈরি করার সময় পায়নি সরকারের দপ্তর গুলো।
পরিসংখ্যান ব্যুরো গত দশ বছর ব্যস্ত ছিলো উন্নয়নের পরিসংখ্যান কাব্য রচনায়। ফলে দারিদ্র্য তার ভীষণ অপছন্দের শব্দ। জাতীয় দিবসগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর বাণী দেবার জন্য পরিসংখ্যান বুড়োকে দারিদ্র্য হ্রাসের জাদুকরী পরিসংখ্যান কবিতা রচনা করতে হয়। “দারিদ্র্য রেখা” কবিতাটি মিডিয়ার সৃষ্টি; এরকম একটা ডিনাইয়ালের সুর ক্ষমতাসীন সরকারের সমস্ত বক্তব্য ও বিবৃতিতে ছিলো।
উন্নয়নের ফকির-দরবেশ, বালিশ বিক্রেতার উপার্জিত বিপুল অর্থের সঙ্গে গরীব মানুষের অর্থহীন জীবনের গড় করে; দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; এটা দেখানোর ধনুক ভাঙ্গা পণ লক্ষ্য করা যায় সরকারি পরিসংখ্যানে।
করোনাভাইরাস হামলার পর এই পরিসংখ্যানের প্রতারণার ফল পেতে শুরু করেছে গোটা জনপদ।
ইজম বেচে চর্বি জমানোর দল; দারিদ্র্য লুকায়; তা নিয়ে ব্যবসা করে; এ কারণে করোনার কালে আজ রাতে বিরিয়ানি খাবে নাকি ইফতারে জিলাপি খাবে; মাথার চুল সেনা বাহিনীর লোকের মতো বাটি ছাঁট দেবে নাকি ব্রাজিলের ফুটবলারের মতো কদম ছাট দেবে; এরকম জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত ইজমের পেটমোটা ঠগীরা।
কিন্তু সেই যে বাদামওয়ালা যে ট্রেনে বাদাম বেচতো; করোনার লকডাউনে টেন বন্ধ থাকায়; তার ঘরের উনুনে বেদনার পাথর সিদ্ধ হয়; শিশুটিকে কোলে নিয়ে এই প্রথম সে মানুষের গৃহে গিয়ে অন্ন ভিক্ষা চায়। কোন মহৎ মানুষ করোনায় বন্ধ দরজা খুলে এক থালা জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত দিলে; শিশুটির চোখ জীবনানন্দে হেসে ওঠে।
যে আপ্পিটি তার বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখতে রঙ পেন্সিল দিচ্ছেন; তিনি কী ঐ জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাতের জীবনানন্দে বেঁচে থাকা শিশুটির জীবন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন।
মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র “আকালের সন্ধানে” কিংবা শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দীন শাকেরের “সূর্য দীঘল বাড়ি” কিংবা ইতালির ভিত্তোরিও ডি সিকার “বাইসাইকেল থিভস” ছবি দেখে যারা দুর্ভিক্ষের নিও-রিয়ালিজম শিল্প উপভোগ করেন চিপস কিংবা পপকর্ণ খেতে খেতে; তারা করোনাকালের জীবন বাস্তবতা কিছুটা হলেও হয়তো উপলব্ধি করতে পারবে।
তবে উন্নয়নের চর্বি গায়ে লেগে গেলে বিপদ। এ চর্বি এতো পুরু চর্বি যা গন্ডারের পুরু চামড়াকেও হার মানিয়ে দেয়। ফলে ক্ষুধার কথা-মৃত্যুর খবর তার কাছে দুধভাতে উৎপাত বা গুজব ও উস্কানি বলে মনে হয়।
করোনাভাইরাস কমান্ডো বাহিনীর হামলাতেই জীবন যেখানে জীবন্মৃত সেখানে আবার ক্রুদ্ধ সমুদ্রের আমফান নৌ-হামলা ধেয়ে আসছে। উন্নয়নের জৈব উত্তেজনায় সুন্দরবন উজাড় করে; এখন এক ইজমের চর্বিজীবীকে দেখলাম প্রার্থনা করতে , রক্ষা করো সুন্দরবন; আমফান সাইক্লোনের হামলা থেকে বাঁচাও।
গোপালগঞ্জে এক উন্নয়নের করোনারোগী দেড়শো মানুষের মধ্যে ধর্ম ও দেশ উন্নয়নের প্রসাদ বা তাবারক বিতরণ করে গোপালগঞ্জে পালের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছেন।
করোনা, আমফান কিংবা পঙ্গপাল মানুষের যতটা ক্ষতি করে; তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে বঙ্গপাল, উন্নয়নের ভেড়ার পাল চরিয়ে, উগ্রজাতীয়তাবাদের বলদের পাল পুষে আর উগ্র ধর্মীয়বাদের ছাগলের পাল মোটাতাজা করে।
বঙ্গপালের গুম আর হামলায় জীবন্মৃত মানুষ তাই করোনা কিংবা আমফানের মৃত্যুভয়ে আর ভীত নয়। মৃত্যুটা তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানের বেশি কিছু তো তারা নয়; সুতরাং অস্বীকারের পরিসংখ্যানের গণকবরে তারা জেগে থাকে; শুধু এক থালা জুঁইফুলের মতো সাদা ভাতের প্রার্থনায়।
ক্রমশঃ
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia