ত্রয়ীনগরীর গল্প
দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের তিনটি শহর ঢাকা-কলকাতা-করাচি; এই তিনটি কসমোপলিটান শহর; আমার জীবনকে এতোটা ঋদ্ধ করেছে; এতো ভালোবাসা দিয়েছে; আর শহরগুলোর জীবনধারায় এমন মায়া; যে করোনাকালে এই তিনটি শহরের ট্র্যাজেডি মুষড়ে দেয়; এই আনন্দনগরীতে শোকের মিছিল অবিশ্বাস্য লাগে।
আমি অভ্যস্ত ঢাকার শাহবাগ বইপাড়া-বাংলা একাডেমি, কলকাতার কলেজ-স্ট্রিট-নন্দন, করাচির প্রেস-ক্লাব-আর্টস কাউন্সিল এর জীবনানন্দে পার্থিব জীবনের গ্লানি কাটাতে। খুব আশ্চর্য্যের বিষয়; এই ত্রয়ী-নগরে সবসময় ভালোবাসার উষ্ণতা পেয়েছি; একটিও তিক্ত স্মৃতি নেই, নেই কোন প্রত্যাখ্যানের বেদনা।
ইন্টারনেট যুগে আমি যেন একসঙ্গে তিনটি নগরে বসবাস করি। তিনটি শহরের সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-একটিভিস্টদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে গুলিয়ে ফেলি কে কোন ভৌগলিক অবস্থানের।
ঢাকার কবি হুমায়ূন রেজা, কলকাতার কবি সুবোধ সরকার, করাচির কবি ফাযিল জামিলি; তিন রোমান্টিক কবির যে কোমলতা-মানবতা বোধ, শিষ্টাচার আর ধর্ম-দল-দেশ নিরপেক্ষতা; তা আমার কাছে ত্রয়ী নগরীর মায়ার জাল বিছিয়ে দেয়।
যেমন ঢাকার কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, কলকাতার কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর করাচির কথাশিল্পী আনওয়ার মাকসুদের রসবোধ এই ত্রয়ী রসনগরীর আনন্দ খুঁজে নিতে সাহায্য করে আমাকে।
বিস্মিত হই ঢাকার ঔপন্যাসিক আনোয়ার শাহাদাত আর করাচির ঔপন্যাসিক মোহম্মদ হানিফের লেখা উপন্যাসে যখন সামরিক আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহ সিঞ্চিত হয় একই ভাবে। মাঝে মাঝে অবাক লাগে; শাহাদাত-হানিফ সমবয়েসি দু’জন লেখক; তাদের কোন ব্যক্তিগত পরিচয় নেই; সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূগোলে বসে যে স্বৈর-বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন; তাতে বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই; কোনটা ঢাকার ছবি; আর কোনটা করাচির গল্প।
এই তিনটি শহরের নাগরিক অন্তঃমিলের জায়গা হচ্ছে, এখানকার মানুষ নানা ধর্ম-বর্ণ-জাত-পরিচয়ের মানুষকে ভালোবেসে থাকতে দেয়। তারা রাজনৈতিক আর ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে অস্বীকার করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম আর সাদাত হাসান মান্টো; এখনো এই তিনটি শহরের সাহিত্য আড্ডায় ঘুরে ফিরে আসেন। বসে গল্প করেন। পানপাত্রে জীবনবারি উচ্ছলিয়া ওঠে; কারো যেন ফিরে যাবার তাড়া নেই; একই ভাবে আঙ্গুল উঁচিয়ে ক্ষ্যাপাটে কোন চিত্রকর সেই আড্ডায় এসে সরকার আর প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেকচার দিয়ে অবশেষে শান্ত হয়; কারো কন্ঠে একটু গান বা দুটি কবিতার ছত্র শুনে। সমাজে সাম্য কেন এলো না; এই আক্ষেপে বাতাস ভারি হয়ে এলে; রবীন্দ্রনাথ হাঁক ছাড়েন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে; তবে একলা চলোরে।
এরপর মান্টো সাহিত্যে অশ্লীলতা প্রশ্নে উগ্রধর্মবাদিদের সমালোচনার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। “একটি পাতকূয়ায় চোর এনে চিনির বস্তা ফেলায় সেই কুয়ার পানি খেয়ে মানুষ শরবত বাবাকে যেভাবে পীর মানে” সেই কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজের সমালোচনা মান্টো গ্রাহ্য করেন না।
সে আড্ডার রেশ এ তিনটি শহরের নির্বাচনী ফলাফলে থাকে। ঢাকা থেকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী জামায়াত, কলকাতা থেকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী বিজেপি আর করাচি থেকে উগ্র সন্ত্রাসবাদি জামায়াতকে ভোট না দিয়ে বিদায় করে এ নগরত্রয়ীর ভোটারেরা।
মান্টো হাত তুলে বলেন, ভিক্ষা হবেনারে তলোয়ার ও ত্রিশূল বাবারা; বিদেয় হও।
অসাম্প্রদায়িক সাম্য চিন্তার শক্ত ঘাটি ঢাকা-কলকাতা-করাচি। তিনটি শহরের মানুষ যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে পথে নামতে পিছপা নয়।
করোনার গ্রাসে এ ত্রয়ী শহর যখন বিপন্ন; তখন আমফান ঝড়ে কলকাতার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি আর করাচির বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ইন্টারনেটে ত্রয়ী শহরে মন খারাপের হাওয়া দুলিয়েছে।
এ ইন্টারনেট ত্রয়ী শহরে আবার এক্সট্রা পাকি প্রেমি ও চাড্ডি প্রেমি রয়েছে। পাকি প্রেমি হচ্ছে কট্টর ইসলামপন্থী; যে ইয়াহিয়াকে ভালোবেসে মোদিকে ঘৃণা করে। চাড্ডি প্রেমি হচ্ছে কট্টর হিন্দুত্ববাদি; যে ইয়াহিয়াকে ঘৃণা করে মোদিকে ভালোবাসে। পাকি প্রেমির পছন্দ নয়; কলকাতার আপফান ট্র্যাজেডি নিয়ে বাঙ্গি তার অশ্র ঝরাক। চাড্ডি প্রেমির পছন্দ নয় করাচির বিমান দুর্ঘটনায় কেউ দুঃখপ্রকাশ করুক।
কারণ এরা হচ্ছে রক্ত ঝরানোর দল। এরা বাঙ্গিকে পাকি ও চাড্ডি দুইভাগে বিভক্ত রেখে রক্তপাত চায়; রক্তপান চায়। পৃথিবী তো স্বর্গ হয়না; সেখানে ঘৃণার দোকানদারিটাই অকম্মাদের একমাত্র করে কম্মে খাওয়ার জায়গা।
কিন্তু ঢাকা-কলকাতা-করাচির স্বর্ণযুগের নবজাগরণের আলো যাদের মনে পৌঁছেছে; তারা সভ্যতা চর্চার অনুগামী। এমন মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিভাজক ঘৃণার দোকানদারেরা সেখানে আজকাল, আরিচা ঘাটের মলম বিক্রেতার মতোই অপ্রাসঙ্গিক ও শব্দ দূষণকারী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তিনটি শহরের টিনেজ কিংবা একুশ বছর বয়েসি তরুণ তরুণীদের ভাবনা পড়ে বুঝি; আউটডেটেড ঘৃণার ব্যাপারীদের মালিন্যকে তারা রিলেট করতে পারেনা। ওরা সতিই বুঝতে পারেনা, তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ধর্ম ও দেশপ্রেম নিয়ে কেন উপযাচক হয়ে কথা বলতে আসে কিছু উপযাচক প্রাক-বৃদ্ধ পুলিশ আর পুলিশিনী।
চিন্তার অচলায়তন ধসে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগের সতত সুবিধায়। করোনায় গৃহবন্দী পুরবাসীর ত্রয়ী শহরে; দীর্ঘ ছুটিতে টেকা-টুকার গল্প কমে আবার জীবনের গভীরের জীবনকে দেখার আকুতি ফিরে এসেছে; “করোনায় যদি বেঁচে থাকি; সভ্য মানুষ হয়ে বাঁচবো;” -এ অঙ্গীকারের সুর শুনে মনে হয়, দক্ষিণ এশীয় হীনমন্যতা, কাঁকড়া স্বভাব আর হিংসা- পরচর্চার বিষ পান করেছে যেন করোনা।
এই মনখারাপের দিনেও হয়তো একটু আশা নিয়ে বাঁচতে ত্রয়ী শহরে তাই আলোর উদ্ভাস দেখি; দেখি স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তন।
ক্রমশ:
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia