আমেরিকায় এখন বর্ণবাদ-বিরোধী তীব্র প্রতিবাদ চলছে। বর্ণবাদ বা রেসিজম বলতে আমাদের অনেকেরই ধারণা সাদা এবং কালোর মধ্যে দ্বন্দ্ব। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। এই রেসিজমের অন্তর্গত মিনিং বহুমাত্রিক।
আমার এক চিকিৎসক কলিগকে একবার আমার প্রতি তার এক ব্যবহারের জবাবে আমি বলেছিলাম তোমার কাজটা কিন্তু রেসিস্ট এর মত হয়ে গেলো। সে জবাবে বলেছিল আমি আর আপনি তো একই রেস তাহলে racist এর মতো আচরণ হয় কিভাবে? এখানেই আমাদের বুঝার ভুলটা। রেসিস্ট হতে হলে ভিন্ন রেইস বা বর্ণবাদী হতে হলে ভিন্ন বর্ণ হতেই হবে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়।
চোখে দেখা একবার এক তরুণীকে একজন বয়স্ক লোক এবং আরেকজন তরুণ দুজনেই দুটো গিফট দিতে চেয়েছিল। তরুণীটি বয়স্ক লোকটির গিফট প্রত্যাখ্যান করলেও তরুণেরটিকে না করেনি। এই যে বয়স এর মাধ্যমে বিচার করা বা কাউকে exclude করে দেয়া এটাও কিন্তু racist আচরন বা বর্ণবাদ যাকে বলে Ageism (https://www.who.int/ageing/ageism/en/)।
মেডিসিন বিভাগের রেফারেল চিঠি পেয়ে আমাদের বিভাগের এফসিপিএস এমডি পাস করা একজন সহযোগী অধ্যাপক একবার কেবিনে শ্বাসকষ্টে ভোগা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই কর্মকর্তা ওই চিকিৎসকের সাথে পরিচিত হবার আগেই তার চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন। সহযোগী অধ্যাপক ঠিকই বুঝতে পারেন তার শারীরিক গঠনের কারণে কর্মকর্তার মন সায় দেয়নি চিকিৎসা নিতে। তিনি ডিপার্টমেন্টের ফিরে এসে অতঃপর একজন নাদুসনুদুস মেডিকেল অফিসার কে পাঠিয়ে দেন সেই চিঠির জবাবে চিকিৎসা দিয়ে আসতে। অবাক ব্যাপার এবার সেই কর্মকর্তা তার চিকিৎসা নিতে কোন প্রকার অস্বীকৃতি জানাননি। দুক্ষেত্রেই তিনি কারো পদবী জানতে চাননি।
এই যে শারীরিক গঠনকে কেন্দ্র করে একজন বড় ডাক্তার আরেকজন ছোট ডাক্তার discriminate করা হলো এটাও একটা রেসিজম।
আমি অমুক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সুতরাং সারা জীবন ধরে আমি অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের চেয়ে সেরা এই মনোভাবটা মনের ভিতর পুষে রাখা, আচার-আচরণে হাবভাবে প্রকাশ্যে সেটার ঘোষণা দিয়ে যাওয়া সেটাও রেসিজম।
আমার ক্যাডারই সেরা ক্যাডার, আমার ক্যাডারের লোক কঠিন অন্যায় করলেও তাকে যেভাবেই হোক রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে আর অন্য ক্যাডারের কেউ লঘু পাপ করলেও তাকে গুরুদন্ড দিতে হবে এটাও রেসিজম।
আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি ism হয় নারী-পুরুষ বৈষম্যে যাকে বলে sexism। সারাদিন পাথর ভেঙে একজন পুরুষ শ্রমিক মজুরি পায় একজন নারী শ্রমিক ততটা পায় না। কারণ একটাই শ্রমিকটি নারী। লোকমুখে প্রচলিত স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, কিন্তু স্ত্রীর পায়ের নিচে স্বামীর জন্য কিছু নেই- এটাও sexism.
কোন প্রতিষ্ঠানের এক ডিপার্টমেন্ট যদি আরেক ডিপার্টমেন্টের চেয়ে সুপিরিয়র মনে করে, ছোট বিভাগগুলিকে শাসন বা ডমিনেট বা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার তাদের আছে বলে মনে করে সেটাও তাদের রেসিস্ট মানসিকতার প্রতিফলন।
অফিসে দুইজন রহিম থাকলে একজন শুকনা রহিম আরেকজন মোটা রহিম এভাবে ভাগ করে ফেলা হয়। দুইজন কেয়া থাকলে ফর্সা কেয়া শ্যামলা কেয়া এভাবে ভাগ করে ফেলা হয়।
আমাদের এমনকি শিক্ষিত সমাজেও এই ব্যাপারগুলি যেন কিছুই না। এগুলো কিন্তু সমাজে চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলা রেসিজম।
হিন্দুদের জাত পাত প্রথা, মুসলিমদের আমরাই একমাত্র স্বর্গে যাব- বাকি সব নরকবাসী এই রেসিস্ট ধারণাগুলি অনেকটা সাইকো লেভেলের। তাদের কোনদিন জানা হয়ে উঠেনা আমেরিকার সেই সাদা পুলিশটির চেয়ে সেও কম বর্ণবাদী নয়। সে সমাজে তবু অন্য সাদারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু ধর্মীয় বর্ণবাদে সব শুয়োরের এক রা।
ছোটবেলায় পাশের গ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের লোকদের উপর দেখেছি আশেপাশের হিন্দু-মুসলিম সবাই কি রকম আচরণ করতো। এ নিয়ে আমার একটি পূর্বের স্ট্যাটাস নিম্নরূপ:
অগ্রহায়ন মাসে যখন ধান কাটা হয়ে যেত, জমিতে ধান গাছের বাকী যেটুকু পড়ে থাকতো তাকে ”নারা” বলা হতো। ছোট বেলায় দেখেছি পাশের গ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের দরিদ্র বালকেরা সে নারাগুলি নেড়েচেড়ে তার তলায়, যেমন সারাবেলায় সের খানেক, ধান খুজে পেতো সেগুলি নিয়ে তারা ঘরে ফিরতো। একদিন দেখি আমাদের গ্রামের এক বালক তাদের ধমক দিয়ে বলছে, ”এই তোরা কি করছিস? সেই এক বালকের ধমকে তিনজন ঋষি বালক ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে যায়। তাদের ভয়ার্ত চোখ এই এতো বছর পরও আমার মনটাকে নাড়া দিয়ে যায়। তাদের কি অপরাধ কেউ জানেনা তবু জড়ো করা কয়েক সের ধান না নিয়েই তাদের চলে যেতে বলা হয়। গরু নিয়ে ঘরে ফিরতে থাকা এক নারী বলে উঠেন, আহহারে ওরা সারাদিন খাইটা ধানগুলি একখান করছে। বালকটি গর্বভরে বলে, ”আরে ঐ গুলিতো ঋষি!” তারপর সুপ্রিমেসীর অহংকার নিয়ে সে বুক ফুলিয়ে হাটতে থাকে। যেন আদেশ দেয়া বালকটি শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়ের বলে তার সব অন্যায় মুখবুঁঝে মেনে নিতে বাধ্য দূর্বল ঋষি গোত্রের বালকেরা।
আমরা চাই সব ধরনের বর্ণবাদহীন একটা সুন্দর সাম্যের পৃথিবী। যত শিক্ষিতই হই, বোধ ও জ্ঞানের অভাবে আমরা অনেকেই যে একেকজন রেসিস্ট সেটা আমাদের নিজেদেরই জানা হয়ে ওঠে না।
– ডা: আমিনুল ইসলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক