গতকাল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ নাসিমের চলে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে একটি এপিটাফ লিখি। এর আগে রাজনীতিক খোকার মৃত্যুতে লিখেছিলাম। খ্যাত-অখ্যাত যেসব মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে; যার সঙ্গে জীবনের একটি সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে; ঐ মুহূর্তটি একটা স্মৃতির স্টিল ফটোগ্রাফ হয়ে রয়ে গেলে; তার মৃত্যুতে আমি শব্দের ফুলের একটি তোড়া ভার্চুয়াল কফিনে রাখি।
জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর মুহূর্তগুলো; বাকিটা রুটিন জীবন যাপন। এক মুহূর্তের প্রেম যেমন সংসারের যাবজ্জীবন কারাগারের চেয়ে শ্রেয়।
নাসিমকে নিয়ে এপিটাফের সমালোচনায় অনেকে লেখককে অতি-আবেগ আক্রান্ত বলেছেন। এটা খুব স্বাভাবিক। করোনাকালে যখন দুর্নীতিবাজদের লুন্ঠনে ঝাঁঝরা স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা মৃত্যু ঘড়িতে জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে; তখন মানুষ বিক্ষুব্ধ হবেই। রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে উন্নয়নের সোনার তরীতে জায়গা না পেয়ে ফুটপাথে পড়ে মারা যাচ্ছে; আর সে সময়; এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ; সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মৃত্যুতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে; তাকে কেউ শ্রদ্ধা জানাতে গেলে; তাকে বাস্তবতা বিবর্জিত রূপকথার জগতের লোক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
“সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণে বিতর্ক” এই আইডিয়ার ফিল্ড রিসার্চে কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশান ২০০২ সালে আমাকে মাল্টা নামের একটি দ্বীপ রাষ্ট্রে পাঠায়। সেখানে সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভ্যালেটার এক বাসায়; যেখানে ২০ জন খুনী বসবাস করে। তাদেরকে সংশোধনের জন্য একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে। একজন ধর্মযাজক আর একজন নারী তাদের অভিভাবক। অন্য বাড়িতে বাবা-মা যেমন অভিভাবক হিসেবে থাকেন।
সেই ২০ জন খুনীর সঙ্গে একটি পুরো দুপুর গল্প করে কাটে। আগে খুনী মানে যে রাক্ষসের ছবি আমার মনে ছিলো; তাতে প্রথম প্রথম বেশ ভয় লাগছিলো। পরে দেখলাম; তাদেরকে অসীম ক্ষমায় আর সম্ভাবনায় মানুষের অধিক মানুষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। তারমানে জীবন রূপকথার মতোই সুন্দর হতে পারে; আমি বা আপনি যদি চান।
এই ২০ জন খুনীর প্রত্যেকেরই এক একটি বিশেষ গুণ ছিলো। কেউ খুব ভালো রান্না করে; কেউ খুব ভালো বাজার করে, কেউ খুব সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করে, কেউ কেউ খুব সুন্দর করে বাসন মাজতে পারে। কেউ খুব ভালো ডেজার্ট বানায়, সে ডেজার্ট খেতে খেতে শুনি কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাইছে, কেউ ছবি আঁকছে; কেউ কবিতা লেখে, কেউ ডায়েরি লেখে ভালো।
এই গুনগুলো তাদের মধ্যে সুপ্ত ছিলো; যা প্রত্যেক মানুষের মাঝে থাকে। প্রতিটি মানুষের যাপিত জীবনে ঘরের সঙ্গে যেমন একটা খোলা হাওয়ার ব্যালকনি থাকে; যেটা ঘরের চেয়ে অধিক আনন্দের জায়গা। ঠিক তেমনি যাপিত জীবনে আমরা যা কিছু করি তার চেয়ে একটু বেশি আনন্দের জায়গা হচ্ছে একটু বই পড়া, একটু প্রার্থনা করা, একটু চলচ্চিত্র দেখা, বাগান করা, ডাকটিকেট কিংবা কয়েন জমানো।
বাবা-মায়েরা জীবনে কোন ভুত দেখেছেন জানিনা; সন্তানদের শুধু জিপিএ ফাইভের পিছে লাগিয়ে রেখেছেন। এ ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়; পুরোনো সময়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা ছেলেটি মুখ ফুটে বলতে পারে নি; সে ফিল্ম স্কুলে কিংবা আর্ট স্কুলে পড়তে চায়। কারণ বাপ-মা-পাড়া-প্রতিবেশী তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতো; তোমাকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। ঐ কম্যুনিটির চাপে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার ধারা থেকে বাজার বুঝে এমবিএ-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আজকাল বিসিএস কিংবা সরকারের সহমত ভাইয়ে ঠেকেছে পাড়া-প্রতিবেশীর প্রত্যাশার পারদ।
অন্যের প্রত্যাশার চাপে জীবন গড়তে গিয়ে মানুষ বিষণ্ণ হয়; মনের যে দুটি মেরু; বিষণ্ণতা আর আনন্দের মেরু; সেইখানে মানুষের শখ চাপা পড়ে যাওয়ায়; তার মনের আনন্দমেরু শুকিয়ে বিষণ্ণতার সাগর আরো প্রমত্তা হয়।
অপরাধ প্রবণ মনের সৃষ্টি বিষণ্ণ শনির বৃত্তে। টাকা-বাড়ি-গাড়ি-বাহিরি চটক-ঘুষ-টেন্ডার বাজি, জুয়া খেলা, পাপিয়া ভাইরাসের ইন্দ্রিয়প্রবণ সুখ বিক্রির দোকানের সওদাগর হয়ে; পশ্চিমে সেকেন্ড হোম কিনে; অপরাধ-বৃত্তের টালমাটাল কলোরাডো ড্রাইভে; খুন-ধর্ষণ-নৈরাজ্য-লুন্ঠন; কোন কিছুই যেন পারে না; মরে যাওয়া মনকে বাঁচিয়ে তুলতে।
মৃত মন নিয়ে মানুষ তবু বেঁচে থাকে; যে আর মনমরা জীবন চায় না; সে মৃত্যুর কাছে খবর পাঠায় তাকে নিয়ে যেতে। তখন অসুখ আসে; মরা মনের কাছে মৃত্যু যন্ত্রণাই আনন্দের। কারণ পৃথিবীর কোথাও আনন্দ নেই; ভাইরাসের আলোছায়ার নৃত্য অনেক দিন পরে যেন একটু বৈচিত্র আনে। হাসপাতালে কমলালেবুর সঙ্গে সে গল্প করে ভাইরাস নৃত্যের গত হাওয়া রাতের কথা।
এই যেখানে মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডি; সেখানে তুলনামূলক জীবন যাপন-অন্যের অনুপস্থিতিতে তার স্বাস্থ্যপান; হিংসা-প্রতিহিংসার অরিজিন্যাল সিন বা আদিপাপকে ঘন করতেই মানুষ কতোগুলো ইজমের চক এনে দাগ দিয়ে গেম অফ থ্রোনসের নরভোজি কাবাডি খেলাগুলোকে জমিয়ে তোলে।
এ কারণে পকেটমার পেটানোর মুঠি পাকিয়ে নাগরিক পাবলিক বাসে ঘোরা ফেরা করে; মব লিঞ্চিং বিষণ্ণ নাগরিক জীবনের ক্ষোভের প্রশমন ঘটায়। সে কারণে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার অসভ্যতা পৃথিবীর সব অকল্যাণরাষ্ট্রে দৃশ্যমান। ঘুষখোর লোকটিও পকেটমার পেটানোর সময় স্বঘোষিত পোপ হয়ে ওঠেন।
ফেসবুকেই আমরা দেখি, কলতলার ফেসবুক ট্রায়ালগুলোতে সব সাধু-সন্ন্যাসীরা নেমে এসে এমন করে অমল-বাণী বর্ষণ করে যেন; বিরাট এক নিষ্কলুষ মানুষ তিনি; ডানা বা ম্যাজিক কার্পেট পেলেই উনি স্বর্গে উড়ে যাবেন। তার আগে এসেছেন, কলতলার হুরমতীর কপালে সিকি-আধুলির ছ্যাঁকা দিতে।
বিস্মিত হয়েছিলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একজন মৌলবী বাবা যখন তাঁর সন্তান হত্যাকারী নরভোজিদের ক্ষমা করে দেন। কিংবা রাহুল গান্ধী যখন তার বাবা রাজিবের হত্যাকারীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ভাবেন, এই খুনীর মৃত্যু হলে তার সন্তানেরাও তো একই কষ্ট পাবে; যা রাহুল তার পিতার মৃত্যুতে পেয়েছিলো।
আর আমাদের খালা-মামীরা দেখেন, তাদের তো স্বজনহত্যার প্রতিশোধের কোন শেষ নাই; এটা একটা ধারাবাহিক প্রতিশোধ নাটক। আর এই প্রতিশোধের মাজারের বিপরীতে মাজারের বাটপারি ইজমের চক দিয়ে লিখে দেয়া “আমরা বনাম ওরা”-র চক্করে প্রাণ দেয়, কতো অনাম্নী জীবন। করোনাভাইরাস যে জীবনের শুল্ক নেবে; তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনের শুল্ক নিয়েছে এই “খালা-মামী”র প্রতিশোধ ক্ষেত্রের যুদ্ধ।
চোখের বদলে চোখ নিতে নিতে বাংলাদেশ অন্ধ আজ। ক্ষমা শব্দটি মানুষের অভিধান থেকে মুছে গেছে। অবোধ শিশুরা যে দেশে বড়দের অনুকরণ করে শ্লোগান দেয়, অমুকের চামড়া তুলে দেবো আমরা; ফাঁসি চাই, ক্রসফায়ার চাই।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কিছু লাইন প্রতিশোধ-প্রতিহিংসায় অন্ধ মানুষদের জন্য পেশ করছি; লেখার সব শেষে।
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান–
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia