১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে; ফ্রান্স-জার্মানীর সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু এই সম্পর্কটি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০০৫ সালে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী জার্মানির প্রাচীন অবকাশ কেন্দ্র বাদেন বাদেনে গ্রীষ্মের অবকাশ কাটানোর সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে; ঐ অঞ্চলে ফরাসী নৃত্য-গীতের নির্মল সাঁঝের আমেজ মেখে নিয়ে মনে হয়েছিলো; এটাই সভ্যতা। আমি অসভ্য দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মেছি বলেই; “চোখের বদলে চোখে” নৃত্যগীতের মাঝে বড় হয়েছি।
ফ্রান্সের সেনাবাহিনী জার্মানীর মানুষ হত্যা করেছে-নারী নির্যাতন করেছে; জার্মানীর সেনাবাহিনী ফ্রান্সের মানুষ হত্যা করেছে-নারী নির্যাতন করেছে; যে ইতিহাস গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়। কিন্তু ফ্রান্স ও জার্মানীর নীতি নির্ধারকরা সভ্যতার চুক্তি অনুযায়ী সেই হত্যা-ধর্ষণের কাল পেরিয়ে বন্ধুত্বে উপনীত হতে পেরেছে; ভবিষ্যতে যেন ফ্রান্স-জার্মানি যুদ্ধ না হয়; রাজনীতি আর বিদেশ নীতির ছক্কা-পাঞ্জায় সাধারণ মানুষের জীবনের শুল্ক আর যেন নেয়া না হয়, সেই রক্ষাকবচ তৈরি করেছে ফ্রান্স ও জার্মানীর নীতি নির্ধারকেরা।
১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়া বিভাজনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে “চোখের বদলে চোখ”-এর নৃশংসতম দৃশ্য চোখে পড়ে। নীতি নির্ধারকদের গ্রাম্য ইগো; কে কার চেয়ে বড় এই বিমূর্ত কলতলা বাড়াপ্পানে; মানুষ মানুষ থেকে আলাদা হয়েছে; পরিবার পরিবার থেকে আলাদা হয়েছে; ভাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে ভাইয়ের কাছ থেকে।
দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু-মুসলমান-শিখ বিভাজন এগুলো রাজনীতিকদের সৃষ্ট কৃত্রিম বিভাজন; এই ধারণাটিকে হাইপোথিসিস হিসেবে নিয়ে , ডয়চেভেলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের কিছু মানুষকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করি। স্যাম্পল সাইজ ছোট। কিন্তু যেহেতু অনাবাসে মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক মেলামেশা দেশের চেয়ে বেশী করে; তাই এই স্যাম্পল সাইজটি বড় হতে হতে সমাজ গবেষণার জন্য যথেষ্ট হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যেহেতু “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়”; তাই ভারত-পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে অবিভাজিত দক্ষিণ এশিয়ার আনন্দে মেলামেশা আমাকে বিস্মিত করে। ভারত আর পাকিস্তানের লোকেরা যখন কথা বলতো; তখন আবিষ্কার করলাম, এতো একই ভাষা; লেখার সময় দুরকম বর্ণে লেখে কেবল। তাদের নেহাত কেউ বলে না দিলে আলাদা দেশের মানুষ হিসেবে বোঝা কঠিন। আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যে গভীর বন্ধুত্ব পেলাম আজো তা আমার জীবনে আত্মীয়তা হয়ে রয়ে গেছে।
কলকাতার সাংবাদিক সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় এক ছুটিতে গিয়ে; আমার আব্বা ঈশ্বরদী থেকে কলকাতায় এলে; তাকে সঙ্গে নিয়ে আব্বার ছাত্রজীবনের স্মৃতিঘন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল হোস্টেল, কফি হাউজ, কলেজস্ট্রিট পুরোটা ঘুরে দেখায়। আমার আব্বা দেশে ফিরে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন সুপ্রিয়’র আন্তরিকতার উষ্ণতায়; ছাত্র জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি নিকেতন থেকে আসা ছেলেদের সঙ্গেই বেশি বন্ধুত্ব ছিলো তার; সুপ্রিয়কে পেয়ে তিনি যেন সেই সোনালি স্মৃতির বারান্দায় ঘুরে আসেন।
কলকাতার সাংবাদিক সঞ্জীব বর্মন একজন আইটি এক্সপার্ট; সে নিজ হাতে ডয়চেভেলের ওয়েব পোর্টাল তৈরি করে; আমার হাতে তুলে দেয়। বিভাগীয় প্রধান আবদুল্লাহ আল ফারুককে সঞ্জীব পরামর্শ দেয়, কম্পিউটার দেখে ভয় পাওয়া লোককেই অনলাইন দেখভালের দায়িত্ব দিন। দেখবেন ঠিক ঠাক চলবে। কলকাতার মানুষের পেশাগত ক্ষেত্রে এই যে নৈর্ব্যক্তিক জাজমেন্টের ক্ষমতা; এটি কলকাতা রেনেসাঁ-র ফসল। ক্ষমতা কুক্ষীগত করে না রেখে; সতপাত্রে দান করার এমন নজির বিরল।
কলকাতার মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে যে সম্পর্কের সেতু গড়ে ওঠে; তাতে আমার মন থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মাঝখানের কাঁটাতারের বেড়াটি উপড়ে যায়। দুই দেশকেই নিজের দেশের মতো ভালোবেসে ডয়চেভেলেতে সাংবাদিকতা শুরু করি।
ডয়চেভেলের হিন্দি ও উর্দু বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো রীতিমতো পারিবারিক পর্যায়ে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর প্রতিরাতে গুলিগালাজ হয়; সেই খবর তৈরি করতে হয় হিন্দি ও উর্দু বিভাগকে। কাজ শেষে কফির টেবিলে তারা আক্ষেপ করে, রাজনীতিক আর সামরিক বাহিনীর যুদ্ধের নেশায় আসলে মানুষ প্রাণ দিচ্ছে; ১৯৪৭ থেকে শুরু হওয়া প্রতিহিংসার দাবানলে পুড়েছে সাধারণ মানুষের স্বপ্নের ঘর; আত্মীয়তা।
দক্ষিণ এশিয়ার এই শিক্ষিত নাগরিক সমাজের ইতিবাচকতা, সেন্সিবল চিন্তা দেখে বুঝতে পারি; কেন ভারত ও পাকিস্তানের দূতাবাসগুলো একে অপর দেশের নাগরিককে ভিসা দেয় না। এর কারণ হচ্ছে, রাজনীতিক-ভিসা কর্মকর্তা-ইমিগ্রেশনের পুলিশ; এরা হচ্ছে ফইন্নির ঘরে ফইন্নি। বৃটিশরা তাড়া খেয়ে চলে যাবার পর নীতি নির্ধারণে অফিসার তো নেই; আছে একদল প্রোমোটি। এই প্রোমোটি মেন্টালিটিটাই হচ্ছে কলতলার কাইজ্জার মেন্টালিটি। “ছোট লোক” শব্দ বন্ধটি এদের জন্য সৃষ্টি। এর সঙ্গে আর্থিক সামর্থের সম্পর্ক নেই। এ হচ্ছে মানসিক দৈন্যের প্রতিশব্দ। তারা ভারত-পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের মেলামেশা বন্ধ রাখতে চায়। ফেসবুকে দেখবেন এরকম ছোটলোকেরা এসেই ঘোষণা দেয়, অমুকরে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখতে পারবেন না; হয় তাকে আনফ্রেন্ড করুন; কিংবা আমার সঙ্গে থাকুন। কী একেবারে মেরিলিন মনরো এসেছেন; তার সঙ্গে থাকতে হবে আমাদের!
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ; কাশ্মীর সংকটের সমাধান করে ফেলেছিলেন। কাশ্মীরের মানুষ নিজেদের মতো থাকবে; ভারত-পাকিস্তান তাদের কেবল সহযোগিতা করবে এমন পথ মানচিত্র তৈরি করা হয়।
কিন্তু যুদ্ধ না থাকলে পাকিস্তান-ভারতের ছোট লোক গোয়েন্দা সংস্থার লোকেদের “সেকেন্ড হোম বানানোর কিংবা পাপিয়া নাচানো”-র টেকা-টুকা আসবে কোত্থেকে? তাই নরভোজীরা যে যার দেশে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে একে অপরের দেশে হামলার নাটক মঞ্চস্থ করে। সাংবাদিকের মধ্যে যে ছোট লোকেরা আছে; তারা বিদ্বেষের কারবারি; নরভোজি সাংবাদিকেরা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার টি আর পি বেচে কাসিনোতে যায়; ফিল্মের এক্সট্রাদের নিয়ে “বাবু বিলাস” করে।
আর পাকিস্তান ভারত উভয় দেশে আছে, গঞ্জে গেলে বড় মামার নামে মামলা করে দিয়ে আসা ছোটলোক তারার মেলা; মামার জমি দখল করে নিজের ব্যর্থ জীবনে একটু সচ্ছলতার দেখা পাওয়ার ফইন্নি স্বপ্ন।
ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিকতার অনুশীলন নেই; গ্রামের টিনের চালা থেকে উঠে এসে লাহোরে বা দিল্লীতে আলিশান প্রাসাদ তুলেছে এমন রাজনীতিকেরা বিরাট মুসলমান আর হিন্দু হবার লেফট রাইট করতে করতে ঘৃণার কারবার চালাতে থাকে। এদেরকে আমরা সরল বাংলাদেশীরা পালা করে “বড় ভাই” কিংবা “জামাই বাবু” বলে ঢাকায় খাতির করে মাথায় তুলেছিলাম। সে কারণে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় পাকিস্তানে করাচি হাইকমিশন অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে “বড় ভাই”-এর পাঠানো “ফইন্নি প্যারা মিলিটারি” মাতলামি করার সাহস পেয়েছিলো। দূতাবাস প্রধানের সাহস আর যৌক্তিক কনফ্লিক্ট রেজোলিউশানের কারণে; ঘটনাটি আর বড় হতে পারেনি। একাত্তরের খুনীদের চেলারা ফিরে যায় সেদিন।
আর “জামাই বাবু”-র পাঠানো সীমান্ত রক্ষীরা পূর্ব সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে বাংলাদেশের মানুষকে। পাকিস্তান আর চীনের সীমান্ত রক্ষীদের কাছে ঘষা খেয়ে অক্ষমতায় কুঁকড়ে যাওয়া ভারতীয় জওয়ান বাংলাদেশ সীমান্তে এসে বাহুবলি হতে চায়।
বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণের মানুষেরা কমবেশি পরিচিত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড মোমেন এক সময় এমেরিকা থেকে ডয়চেভেলের জন্য ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিতেন। একজন বিশ্লেষক হিসেবে প্রতিটি শব্দ হিসেব করে বলতেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রী হবার পর তিনি “বাংলাদেশ ও ভারত” সম্পর্কে দাম্পত্য সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সীমান্তে নিয়মিত মানুষ হত্যা দেখে বোঝা যায়; এই সম্পর্কটি ফেসবুকে “এক যুগ একসঙ্গে কাটাইলাম বলে সেলফি দেয়া স্বামী-স্ত্রী”-র মতো ওপরে ফিটফাট আর ভেতরে সদরঘাট এই কথিত বাংলাদেশ-ভারত দাম্পত্য সম্পর্ক।
সাধারণ মানুষ মরলে কিছু এসে যায় না নীতি নির্ধারকদের। তাদের নিজেদের ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনিরা নিরাপদে আম্রিকা-ক্যানাডায় থাকে। ফলে গরিবের ছেলে বিএসএফ-এর গুলিতে মারা পড়লে বিজিবি “জলিলের মাথা খারাপ আছিলো” বলে দায়িত্ব সেরে ফেলে।
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মাথা তো খারাপই; তা নাহলে তাদের নিজের পয়সায় কেনা বুলেট কেন তাদের শরীরেই আঘাত করবে। তাদের নিজের বেতনে পোষা চৌকিদার কেন তাদেরই গুলি করবে। পড়ে পড়ে মার খাওয়া মানুষ; এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মানুষ। গুম-খুন-ক্রসফায়ারের নরক এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান। রাজনীতি-ব্যবসায়ী-সামরিক বাহিনী-প্রশাসনের নামে “ফইন্নির ঘরের ফইন্নি” ঠগীরা বেশ রুলিং এলিট সেজে মানুষ শিকার করে চলেছে।
আর পোষা ইতিহাসবিদেরা মুসলমান বিরোধী টুথ ব্রাশ বনাম
“হিন্দু বিরোধী” মিছওয়াক বেচে হেইট স্পিচ প্রচার করে চলেছে। কট্টর ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এই উগ্রজাতীয়তাবাদী বুদ্ধিসন্ত্রাসীদের হেইট স্পিচের কোন পার্থক্যই আমি দেখিনা।
করোনাকালে দেশে দেশে স্বাস্থ্য অধিকারের দাবীতে বিক্ষোভ চলছে। ফ্রান্সের রাস্তায় ডাক্তার-নার্সেরা, জার্মানির ডাক্তাররা পিপিই-মাস্ক-গ্লাভসের সরবরাহ যথেষ্ট না হওয়ায়; নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর পাকিস্তানে ডাক্তারদের গ্রেফতার, ভারতে ডাক্তারকে পাগল প্রমাণ করা, বাংলাদেশে মৃত ডাক্তারকে “ছাত্রজীবনে শিবির করিতেন” বলে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে সরকার দলের ক্যানিবালেরা; অথচ কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। সব কিছু মুখ বুঁজে মেনে নিতে নিতে মৃত্যু এখন ঘরের দুয়ারে পৌঁছেছে।
ইন্টারনেটের শক্তিতে মানুষের মনের বিভাজিত মানচিত্র আবার জোড়া লাগতে শুরু করেছে। দূতাবাসের পেজগি লাগানো বিভাজন কর্মকর্তার ধার আর কেউ ধারেনা। তাই ইন্টারনেটের শক্তিতে মুছে যাক রেডক্লিফ লাইনের অভিশাপ; মানুষ বাঁচুক মানুষের সান্নিধ্যে।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia