আহমদ ছফা প্রচন্ড উন্নাসিক, রাগী, প্রতিভাবান, সৎ, সাহসী, স্পষ্টভাষী, অন্যের প্রশংসায় ও নিন্দায় অকৃপণ, একজন দেশপ্রেমিক, ও একজন চরমভাবে অবহেলিত বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমানের কবি ও প্রাবন্ধিক, একজন নিষ্ঠাবান ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানী ও উন্নত মানের অনুবাদক। এক কথায় ছফা ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ টাইপ কবি, মুনতাসির মামুন টাইপ ঐতিহাসিক, জাফর ইকবাল ও হুমায়ুন আজাদ টাইপ “লেখা চোর”, ও মোনেম খানের পা-ধরা বাটপার কবির চৌধুরীদের পাশে নিতান্তই একজন বেমানান, বিস্ময়কর প্রতিভা।
তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশে ছফা ছিলেন একজন অপাংক্তেয় বিরল প্রতিভা। যে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী — যারা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় “শিক্ষাপ্রাপ্ত” — শতকরা ৯০+ জন না জানে ভালভাবে তার মাতৃভাষা, না জানে কোন ইতিহাস বা সমাজ বিজ্ঞান বা বিদেশী কোন ভাষা। সে দেশে ছফা ভাই দারিদ্র ও অবহেলা নিয়ে ৫৭ বছর বেঁচে ছিলেন সেটাই তো এক অবাক কাণ্ড!
তাঁর মারা যাবার দুদশক পরে তাঁকে নিয়ে হাতে গোনা ক’জন বাংলাদেশী একটু হৈচৈ করছে! এদেশে আপনি যদি একজন ধুরন্ধর, নির্লজ্জ, অসৎ, ও ক্ষমতাবানদের পা আঁকড়ে ধরার “যোগ্যতা” না রাখেন – যেমন কবির চৌধুরী মোনেম খানের পা ধরেছিলেন প্রকাশ্যে, আর নির্মলেন্দু গুণ হাসিনারটা ধরেন একটু পর্দার আড়ালে – তাহলে আপনার বিদ্যার বা প্রতিভার কে ধার ধারে!? আর বাংলাদেশীরা জীবিত জ্ঞানী জনের প্রশংসা করে না বললেই চলে। আমি “বাঙ্গালী” বলছি না কেননা ভারতীয় বাঙ্গালীরা অনেক বেশী শিক্ষিত, মার্জিত, ও আধুনিক।
এবার ছফা ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার কথা বলি। ওঁকে প্রথম দেখি ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের শিক্ষকদের লাউঞ্জে। আমার ঢাকা কলেজের বন্ধু, সিরাজুল আলম খানের তথাকথিত নিউক্লিয়াসের সাবেক সদস্য, জাসদপন্থী সৎ মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মাসুদ আহমদ রুমি কানে কানে বলল: “আহমদ ছফা, খুব বড় ইনটেলেকচুয়াল, মুক্তিযোদ্ধা”। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। ঐ শিক্ষক লাউঞ্জেই ছফা ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এক সময় আমি ভুল করে “দরিদ্রতা”র স্থলে “দারিদ্রতা” বলে ফেলি। ছফা ভাই অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বললেন: “শব্দটা দরিদ্রতা বা দারিদ্র, তবে অনেকেই ভুল করে”। তারপর বহ বছর টিকে ছিল আমাদের বন্ধুত্ব। আমরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। উনি অকপটে আমাকে অনেক কিছুই বলতেন। উনি থাকতেন ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে আর আমি জসীমউদদীন হল সংলগ্ন শিক্ষক কোয়ার্টারে। প্রায় রোজই কথা হতো।
কোন এক কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে উনার একটু বা বেশ বচসা হয়। ১৯৭৯ বা ১৯৮০/৮১র দিকে একদিন উনি ঢাবি লাউঞ্জে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: “সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখেছেন? আমি ওঁকে একটা চড় মারার জন্য খুঁজছি। উনি শেকসপিয়র, শেলি, কীটস, বাইরন পড়ান আর বলেন যে বাংলাদেশের কবিরা নাকি অপদার্থ!” ছফা ভাই প্রফেসর চৌধুরীকে আরো কি বলবেন সেটাও বল্লেন। কথাটা এত অশ্লীল যে লিখতে পারব না! এই ছিলেন ছফা ভাই!
আহমদ ছফা উনিশ শতকের বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, সাহিত্য, ১৮৫৭/৫৮ সালের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ, বাঙ্গালী মুসলমান ও বুদ্ধিজীবীর স্বরূপ নির্ণয় এ যেমন ছিলেন পারদর্শী, তেমনি সাবলীল ছিলেন ইউরোপীয় সাহিত্য ও সভ্যতার ইতিহাসে। তাঁর বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীর সুবিধাবাদী ও অসততার উপর লেখাগুলো একদিকে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ, অন্যদিকে সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীর এক অপূর্ব মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ! তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের একটা পঙতি আমার এখনও মনে আছে। অনেকটা এরকম: বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কথা যদি সত্য হতো, তাহলে কোনদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
তিনি আওয়ামীলীগ যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে , তার বিরোধিতা করেন। তাঁর একটু জাসদের উপর অনুরাগ ছিল বলা যায়, আবার বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক ছিল। এক কথায়, তিনি ছিলেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক আগ্রাসন বিরোধী সহযোদ্ধা।
একদিন আজিজ মার্কেটে আমাকে নিয়ে গেলেন। এটা ২০০০ বা ২০০১ সাল হবে। আমি তখন IUBর ডীন। উনি উনার প্রায় সবগুলো কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ও অনুবাদের বই আমাকে উপহার দিলেন। পরে আমিও আমার Westview Press প্রকাশিত পার্টিশনের উপর লেখা Pakistan As a Peasant Utopia (1992) উনাকে উপহার দিলাম। উনি বইটি পড়ার পর বলেছিলেন অনুবাদ করবেন। তার কয়েক মাস পরেই তিনি মারা গেলেন। আমি জোর করে ওঁকে IUB তে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ও রাজনীতিক সংস্কৃতি পড়ানোর জন্য খন্ডকালীন শিক্ষক হতে রাজী করলাম। পরে উনি মত পরিবর্তন করলেন। আর কিছুদিন পরেই তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।
– ড: তাজ হাশমী
টরনটো, ৩ /৭ / ২০২০