কার্গিল হাই স্কুলের মাঠ, খেলাধুলা ও টুর্নামেন্ট
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
কার্গিলের খেলার মাঠে হেলিপ্যাড ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হেলিকপ্টার পরিষেবা দিতো পিআইএ (পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা)। ১৯৬০ এর দশকে পরিচালিত হেলিকপ্টার পরিষেবা প্রথম দিকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিস্তৃত হেলিকপ্টার নেটওয়ার্ক ছিল (পূর্ব পাকিস্তানে) বাংলাদেশে।
১৯৫০ এর দশকে (পূর্ব পাকিস্তানের) বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমেরিকান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সময় নাগরিকদের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহারে আগ্রহ শুরু হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে, জাতীয় বিমান সংস্থা পিআইএ (যা কলকাতা ভিত্তিক ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল) ঢাকা এবং আঞ্চলিক শহরগুলির মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে নির্ধারিত হেলিকপ্টার চালু করে।(পূর্ব পাকিস্তানের) বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলে সংক্ষিপ্ত পর্বতারোহণের জন্য, পিআইএ সিকোরস্কি এস -১১এন ব্যবহার করে নির্ধারিত হেলিকপ্টার রুটের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করে। প্রথম বাণিজ্যিক আকাশ পথটি ১৯৬৩ সালের ২৫ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে। প্রথম রুটগুলি ছিল (পূর্ব পাকিস্তান) বাংলাদেশ পাট শিল্পের কেন্দ্র ঢাকা ও খুলনার মধ্যে; এবং ঢাকা ও ফরিদপুরের মধ্যে।
পিআইএ এস -৬১এন ৪ জন আকাশ কর্মী নিয়ে ১,৮০০ পাউন্ড কার্গো সহ মোট ২৪ জন যাত্রী বহন করতে পারতো। প্রথম পাঁচজন পাইলটকে ব্রিটিশ ইউরোপীয় এয়ারওয়েজের (বিইএ) সাথে ইংল্যান্ডের কিডলিংটনের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তারা ব্রেন্টলি বি -২ হালকা হেলিকপ্টার উড়াতে শিখেছেন। এরপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কানেকটিকাটের সিকোরস্কির কারখানায় এস -৬১এন-তে রূপান্তরিত হয়। খুলনা, ফরিদপুর,বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মংলা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, চাঁদপুর, সন্দ্বীপ এবং হাতিয়া উপজেলা সহ ২০ টি শহরে আকাশ পথের এই নেটওয়ার্ক ছিল। চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ রুটে ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা (রুপী)। এটি ছিল সরকারিভাবে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার নেটওয়ার্ক।
১৯৬৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সিকোরস্কি এস -৬১এন হেলিকপ্টারটি তেল লিক হয়ে ও মূল গিয়ারবক্স বিকল হয়ে একটি নির্ধারিত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, ফরিদপুরের কাছে বিধ্বস্ত হয় এবং ২৪ জন যাত্রীর মধ্যে ২৩ জন যাত্রী শহীদ হন। ফলে আকাশ পথের পরিষেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। সন্দ্বীপের স্টেশন ম্যানেজার ছিলেন (সন্দ্বীপের আমানউল্ল্যা চৌধুরী বাড়ীর সুদর্শন ফর্সা স্মার্ট) আনোয়ার হুসেন চৌধুরী (যিনি কয়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন). তখন সুদর্শন ফর্সা স্মার্ট দেখে বিমান পথে বা বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হতো।
ইতিমধ্যে আপত্তি জানানো হলো হেলিপ্যাড অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য। কেননা হাই স্কুলের ক্লাস টাইমে হেলিকপ্টরের শব্দ দূষণ হতে থাকে। পরে অবশ্য টাউনের উত্তর পাশে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। সে মতে হেলিপ্যাড ও রেস্ট হাউস সমেত অফিস তৈরী করা হয়েছিল। হেলিকপ্টার পরিষেবা বন্ধ হবার পরে আকাশ পথে বিমান পরিষেবার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় টাউনের পূর্বে সিও অফিস সংলগ্ন। পরবর্তীতে আকাশ পথ আর এগোয়নি। ওই সব অধিগ্রহণকৃত জমি নদী সিকস্তি হয়ে পয়স্তি হয়েছে। নদী পথ সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে। সাস্টেইনেবল এজেন্ডা থাকা চায়। তাই কথামালার ফুলঝুড়ি বয়ে যাচ্ছে জলরাশির উপরে শেওলার মতো। এক সময়ে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হতো গুপ্তছড়া ও কুমিরা ব্রীজ নির্মাণ করতে। আর এখন ………. । সত্যিকার অর্থে কেউ কথা রেখে নি।
শুনেছি কার্গিলের জন্মলগ্ন থেকে কার্গিল হাই স্কুলের মাঠে খেলাধুলা ও টুর্নামেন্ট হতো। বড় বড় টুর্নামেন্টের খেলাধুলা হতো কিনা জানি না। তবে জানা যায় যে, দেশ ভাগের আগেও কার্গিল হাই স্কুলের মাঠে টুর্নামেন্ট হতো। কার্গিল হাই স্কুল ও সন্দ্বীপ হাই স্কুলের মধ্যে ফুটবল খেলা ছিল জমজমাট, টান টান উত্তেজনা ও উদ্দীপনাপূর্বক। নুতন কেতন উড়তো দুই শিবিরে। কার্গিলের মাঠ থাকতো দর্শক কানায় কানায়। স্বাধীনতার আগে পরে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের উপস্থিতি দেখেছি। কোনো কোনো বছর টিকেটের ব্যবস্থাও দেখেছি।
সন্দ্বীপের বাইরের ফুটবল খেলোয়াড়দের টুর্নামেন্টে খেলতে নিয়ে আসা হতো। আশে পাশের এলাকা ও পার্শবর্তী থানা/উপজিলা থেকে খেলোয়াড়দের হায়ার করে খেলার জৌলস বাড়ানো হতো। ফলে ঘরের খেলোয়াড়রা বেড়ে উঠতে পারেনি। মোহামেডানের পক্ষ থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আসা হতো চিটাগাং থেকে। আমার বড় ভাই শাহাজান তালুকদার ছিলেন মোহামেডানের সেক্রেটারি। স্বাধীনতার পর আবাহনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও পরে একটা অংশ মোহামেডান করেন। আবাহিনী ছিল টাউনের পাঁচ রাস্তার মোড়ে ও মোহামেডান ছিল পোলঘাটে। টাউনে এই দুই স্পোর্টিং ক্লাব প্রসিদ্ধ ছিল।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ের পূর্বাপর যে টুর্ণামেন্টগুলো হয়েছে তা মূলত `রসিক কাপ`কে নিয়ে। আমার যতটুকু মনে পড়ে আমি `রসিক কাপ` কার্গিলের টিচার্স রুমের আলমিরাতে দেখতে পেয়েছি। সাথে অন্যান্য শীল ও কাপ দেখেছি। ধারণা করছি `রসিক ক্যাপ` প্রায় ৮০/৮৫ বছর পুরোনো একটি ঐতিহ্যশালী এন্টিক। যাহোক, চায়না’র দুটো জিনিষ ইংরেজরা বিশ্বময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। একটি হলো চা আর অন্যটি হলো ফুটবল।
কার্গিলের মাঠে পাড়া প্রতিবেশী ছেলেরা (মেয়েরা) বিকালে খেলাধুলা করতো। আমরাও খেলেছি। হাডুডু, ছুটাছুটি, হাই জাম্প, লং জাম্প, হাফ স্ট্রেট জাম্প, লাঠির দৌড়, কেম্বিশের বল দিয়ে ফুটবল, বেডবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বেডমিন্টন (ক্রক), ইত্যাদি। আমরা টুর্নামেন্টের বা প্রতিযোগিতার জন্য অন্য মাঠ বেছে নিতাম। যেমন পোলঘাট খালপাড়ের আমাদের ঈদ্গাহ ও থানার সামনের লাল ডাক বাংলার মাঠ। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে চকলেট বা ট্রপির ব্যবস্থা করতাম। রেফারির জন্য অপেক্ষাকৃত সিনিয়রদের রিকোয়েস্ট করতাম। বড়দের টুর্নামেন্টের রেফারীর মধ্যে মরহুম এন এম সেলিম ভাই উল্লেখযোগ্য ছিলেন।
শীতের আগে হেমন্ত ও শীত মৌসুমে ঘুড়ি উড়ানোর হিড়িক পড়ে যেতো। ঘুন্ডি উড়ানোর সুতায় মাইজ্যা দেয়া, কাচ গুড়া করা, ফনি মনসার ডোগা, ময়দা জাল দেয়া, সুতায় মাইজ্জা দেয়া ছিল অনেক আনন্দের অথচ প্রতিযোগিতামূলক কাজ। ঘুড়ির সুতাকে ধারালো করার প্রক্রিয়া। প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, শিরিষ আঠা, রং, পানি, সাগুদানা অথবা এরারুট পাউডার, হামনদিস্তায় গুড়া করা কাপড়ে ছাঁকা কাঁচের গুড়া বা চুর, সুতা, নাটাই এবং দৈ’এর হাঁড়ির মত মাটির হাঁড়িতে নিয়মমত পানি দিয়ে শিরিষ এবং সাগুদানা/এরারুট দিয়ে জ্বাল দেয়া। এইগুলো ছিল মৌসুমের আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
রং বিরং এর ঘুড়ি বিক্রি হতো। (৭০সালের পূর্বাপরে) ঘুন্ডির দাম ছিল প্রায় ০.১০-০.১২ পয়সা ও নাটাই ছিল ৩ থেকে ৪ টাকা। কার নাটাই এ কেমন কারুকাজ করা হয়েছে, ফেন্সি নাটাই ছিল বাহারি, রঙিন পেইন্ট করা কি না?, দৃষ্টি নন্দন কি না?; তা দেখার বিষয় ছিল। সাধারণত ফেন্সি নাটাই এর জন্য কাঠের দুটি চাকা কাঠ মেস্তুরী থেকে নেয়া হতো। মুলি বাঁশের তৰ্জা ও সুপারির গাছের চেড়া থেকে বানানো হতো স্টিকটি। মূল নাটাইওয়ালার সাথে থাকতো দু’তিন জন সহযোগী। স্পেয়ার ঘুন্ডি, স্পেয়ার নাটাই ও বাকেট হলে খুঁজে আনা ছিল সহযোগীদের কাজ।
কার্গিলের মাঠে শীত কালে ভলিবল খেলা হতো। আমাদের বড়রা খেলতেন। অন্য প্রান্তে আমরা খেলতাম। ভলিবল টুর্নামেন্ট হতো। আমার মনে আছে যে, ৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় পাকিস্তানী আর্মি ত্রাণ কাজে সন্দ্বীপ এসেছিল। মেজর হাফিজও উনাদের সাথে ভলিবল খেলতেন। একবার আমার মেঝু ভাইয়ের সাথে বাদানুবাদ হয়েছিল। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে সিনিয়ররা বেডমিন্টন (ক্রক) খেলতেন। আমাদের সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে বেরোনোর অনুমতি ছিল না। পরে বেডমিন্টন (ক্রক) আদালত প্রাঙ্গনে হতো। ব্যবসায়ী ও সিনিয়ররা খেলতেন। উনাদের মধ্যে টুর্নামেন্ট হতো। খেলাতে জয় পরাজয় বলে কথা ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল। আমাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন বিরাজ করতো। প্রতিযোগিতামূলক খবরাখবরের জন্য আমরা উন্মুখ থাকতাম।
তখনকার দিনে সন্দ্বীপ টাউনের বড় ভাই ও ছোট ভাই বলে কথা ছিল। বড় ভাইদের আড্ডায় ছোটরা যেত না। বড়রা ছোটদের বেশ আদায় যত্ন করতো। কেউ বড়দের দ্বারা নাজেহাল হয়েছে, তা কখন শুনেনি। সন্দ্বীপ টাউনের নানা কোণের নানা এলাকার মানুষ জনের বাস ছিল। তাদের মধ্যে এমন সম্প্রীতি ও সহানুভূতির পরিবেশ সত্যিই বিরল। গ্রাম থাকে যাঁরা বিভিন্ন কাজ কর্মে টাউনে আসতেন; তাঁদেরকে অতিথির মত গণ্য করা হতো। ছোটদের মধ্যে একটু করে সম্প্রীতি গড়ে উঠতো, যখন গ্রাম থেকে কার্গিলের মাঠে সাইকেল চালনা শিখতে আসতো নবীনরা। তখন হনগুলের চাঁদা ধরা হতো। হেলিপ্যাডের বৃত্তের চতুর্দিকে ও পরবর্তীকালে ওই চিহ্নের চতুর্দিকে এক বা দুই ঘুর্না দেয়াকে হনগুলের চাঁদা বলতো। আমি শুনেছি, হনগুলের রেওয়াজ ৮০ এর দশকেও চালু ছিল।
ব্যাপারটা ফানি ছিল, বেশ মজাদারও বটে। এই যা `বেল` বানানো আর কি?
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
—————-
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। কোনো রকমের তথ্য বিভ্রাট হলে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিবেন বা ইমেইল করবেন। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি স্মৃতিকথনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিকথনমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – পরবর্তী দুটি পর্ব (১৯ জুলাই ও ২৬ জুলাই) আমার বড় ভাই ডঃ ইকবাল শাইলোকে লিখার জন্য অনুরোধ করেছি।
শিরোনাম থাকবে: “অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদের (আইডিপি) ক্ষমতায়ন: এ কেস স্টাডি অফ সন্দ্বীপ, বাংলাদেশ”