ডেস্ক রিপোর্ট : করোনা মহামারি ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা এল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে সমালোচনা। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাওয়া ট্রাম্প প্রশাসন বলির পাঁঠা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে বলে অনেকেই সমালোচনা করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে চীনের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা এবং সত্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান তাদের বিশ্লেষণে লিখেছে, এককভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে সবচেয়ে বড় অঙ্কের অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর এই তহবিলে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ৪০ কোটি ডলার—যা ছিল সংস্থাটির বার্ষিক বাজেটের প্রায় ১৫%। সদস্য ফি ও দান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এ অর্থ দেয়। যদিও তাত্ত্বিকভাবে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থায় কংগ্রেস অনুমোদিত তহবিল আটকাতে পারে না হোয়াইট হাউস। তবে প্রশাসন চাইলে বিভিন্ন উপায়ে সাংবিধানিক বাধা সৃষ্টি করতে পারে। নিষেধাজ্ঞা বা তহবিল জোগানে ব্যর্থতার কথা বলতে পারে। এই তহবিলকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা যেতে পারে, তবে এর জন্য সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে, বা হোয়াইট হাউস যুক্তিযুক্তভাবে অন্য কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে পারে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও সুরক্ষা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক আলেকজান্দ্রা ফেলান বলেন, এটা যে রূপ নিক না কেন এটা যেকোনো সময় বা একটা মহামারি চলাকালে অদূরদর্শী ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিসি ইমপ্যাক্ট ইন গ্লোবাল হেলথের পরিচালক গ্যাভিন ইয়ামি বলেছেন, এটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত যা বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে। বিশ্বে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জঘন্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ট্রাম্প তাঁর প্রশাসন ও নিজের ভুলগুলো থেকে চোখ সরানোর চেষ্টা করছেন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সাধারণত একমত যে, এই মহামারির সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া নিখুঁত ছিল না। তবে ২০১৪ সালের ইবোলা মোকাবিলার তুলনায় ভালো ছিলে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যা করেছে তার তুলনায় ভালো করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গত ৫ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জারি করে। ৭ জানুয়ারি থেকে নিয়মিত টেলিকনফারেন্সে জনস্বাস্থ্য কর্মীদের ব্রিফিং দিতে শুরু করে। ৯ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্য দেশগুলোকে নিজস্ব ঝুঁকি নির্ণয় ও পরিকল্পনার নির্দেশনা দেয়।
ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা ১৪ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি টুইটকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যাতে একটি চীনা গবেষণার কথা বলা হয়। ওই গবেষণায় দাবি করা হয়েছিল, মানুষের কাছ থেকে এটা সংক্রমণের পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সদস্য দেশের সাম্প্রতিক গবেষণার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাধ্য ছিল। তবে ১০ ও ১১ জানুয়ারি কারিগরি ব্রিফিং ও ১৪ জানুয়ারি প্রেস ব্রিফিংয়ে মানুষের কাছ থেকে সংক্রমণের জোরালো আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া উপযুক্ত সতর্কতা নিতে আহ্বান জানেন হয়।
ইয়ামি বলেন, পুরো মহামারির সময় শুরুর দিককার একটি টুইট ধরা হাস্যকর। বিজ্ঞানের পুরো বিষয়টি হলো আমাদের প্রাথমিক অনুমান ও রণা। নতুন তথ্য আসলে আমরা সেসব ধারণা হালনাগাদ করি। ২৩ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের করোনা ঝুঁকির বিষয়টি হালনাগাদ করে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে। এক সপ্তাহ বাদেই তারা জরুরি অবস্থা জারি করে।
গতকাল তহবিল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে যেখান থেকে ভাইরাসের উৎপত্তি সেখানে বিশেষজ্ঞ পাঠানো হয়নি এবং নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে বেইজিং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদের প্রথম সপ্তাহে উহানে যেতে বাধা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউওইচওর প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রোয়াসুস ২৯ জানুয়ারি বেইজিংয়ে সি চিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উহানে ঢোকার অনুমোদন নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান বিশেষজ্ঞরা।
সি চিনপিং ও চীনাদের গৃহীত ব্যবস্থার প্রশংসার জন্য তেদরোস আধানোমকে সমালোচনা করা হচ্ছে। হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা যাচাই করে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। তার আগ পর্যন্ত সংস্থাটিতে তহবিল বন্ধ করার নির্দেশ প্রশাসনকে দিয়েছি।’ গত সপ্তাহে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশ অর্থ দেয় ডব্লিউএইচওকে। কিন্তু কোনো কারণে ডব্লিউএইচও খুব চীনকেন্দ্রিক।
নমুনা সংগ্রহে ডব্লিওএইচওর দেরি হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি হয়েছে দাবিটি মিথ্যা। ১১ জানুয়ারি কোভিড-১৯ এর জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করে দেন চীনের বিজ্ঞানীরা। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা চালানোর অবস্থায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনুমোদন দেয়নি। তারা নিজস্ব পরীক্ষা শুরু করে। কিন্তু তাদের পরীক্ষা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি ছয় সপ্তাহ দেরি হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো পরীক্ষাই হয়নি। ওই সময় সংক্রমণ কম থাকায় ট্রাম্প ভেবেছিলেন তারা পার পেয়ে যাবেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি টুইটে গর্ব করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে।’ কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি গোসা দেখাতে শুরু করেন ট্রাম্প। তাঁর প্রশাসনের একের পর এক খুঁত বেরিয়ে আসতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
ট্রাম্পের তহবিল বন্ধের ঘোষণার প্রভাব অন্য দেশগুলো থেকে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। অনেক দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি এখনো অগাধ আস্থা রেখেছে। যুক্তরাজ্য যেমন ২০ কোটি পাউন্ড নতুন তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে সাড়ে ছয় কোটি পাউন্ড বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে যাবে।
নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বলির পাঁঠা বানানোর বিষয়টি কতটা ভূমিকা রাখতে তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে, বিশ্ব মঞ্চে মার্কিন নেতৃত্বকে পরিত্যাগের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাবে।