১. আমার জন্মস্থান, সাওতাল ক্যানেল ও সন্দ্বীপকে নিয়ে ফেড্রিকের ঐতিহাসিক বর্ণনা:
আজ ২৫ জুলাই। আমার বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। আজ থেকে ২০ বছর আগে তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে পরলোক গমন করেন। তিনি মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
আজ সুদূর কানাডায় বসে তাঁর সন্তান হতে পেরে নিজেকে খুব ধন্য মনে করছি। বাবাকে আজ বিশেষ ভাবে স্মরণ করছি কারণ তার স্বপ্ন পূরণ করতে মূলতঃ আমি কানাডায় আসি। দশ ভাই-বোনের মধ্যে আমি অষ্টম। তিন বছর বয়স থেকে বাবা আমাকে “ডক্টর ইকবাল” বলেই ডাকতেন। তিনি কিন্তু আমার আর কোনো ভাই-বোনকে “ডক্টর” নামে ডাকতেন না । আমার নাম রেখেছিলেন প্রাচ্যের দার্শনিক ও মহাকবি আল্লামা ইকবালের নামে।
সাওতাল ক্যানেলের তীরে সন্দ্বীপ টাউনের পোলঘাটে আমার জন্ম। আমার পিতা হলেন মরহুম আলহাজ্ব আলী আহমেদ তালুকদার আর মা কালাপানিয়ার মনসুর আলী ভূইয়াঁ বাড়ির আলহাজ্ব ফয়জুন্নুর বেগম ভূইয়াঁ। বর্তমানে মা লন্ডনে থাকেন।
ভাবতে অবাক লাগে এমন একটি দ্বীপে আমি বড় হয়েছি যার সোন্দর্য্য ও রূপ দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ভিনিশ দেশীয় (ইটালিয়ান) বিশ্ব ভ্রমণকারী নাবিক সিজার ফেড্রিক। ১৫৬৫ সালে বিশাল আকৃতির জাহাজটি যখন মেঘনার কোল ঘেঁষে সাওতাল ক্যানালে ঢুকছিল, নাবিকদের কষ্ট হচ্ছিলো জাহাজটিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে। এতক্ষনে আনন্দে উচ্ছসিত নাবিকরা- সন্দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, বিশ্ব-সেরা উর্বর ভূমি ও প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলা নিকেতন তাদেরকে বিমোহিত করে তোলে। ফেড্রিকের বর্ণনায়: “to my judgement the fertilest I[s]land in all the world… and with great trouble wee brought our ship into the same channell”। তার লিখাই তিনি সন্দ্বীপকে “Sundiva Island” ও “Sondiva” হিসেবে উলেখ করেছেন।
বিদেশী নাবিকদের জাহাজ দেখে লোকালয়ের বাসিন্দারা দ্রুত জমজমাট বাজারের পসরা বসিয়ে ফেললো সাওতাল খালের তীরে। ফেড্রিক বলছেন, “And when the people of the I[s]land saw the ship, and that we were comming a land: presently they made a place of Bazar or Market, with Shops right over against the ship with all manner of provision of victuals to eate, they brought downe in great abundance, and sold it so good cheape, that wee were amazed at the cheapnesse thereof.”
ফেড্রিক একটি বিশাল আকৃতির (নোনতা) গাভী [salted kine] ও বড় একটি মোরগ কিনেছিলেন মাত্র এক টাকা পৌনে নয় আনা দিয়ে। শুধু তাই নয় তড়িত গতিতে বাজারের পসরা বসিয়ে ফেলা সাওতাল খালের সেই ফেরিওয়ালারা বা ব্যাবসায়ীরা তাদেরকে এক বস্তা চাউলও দিয়েছিলন বিনে পয়সায়। তার ভাষায়: “Also a sacke of fine Rice for a thing of nothing, and consequently all other things for humaine sustenance were there in such abundance”। কেমন আতিথিয়েতা জানতেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। আমরা তাদেরকে অভিবাদন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বলতে হবে, তাদের এই মহানুভবতা আজকের দিনের আতিথেয়তাকেও হার মানায়। আজও তাদের এই বদান্যতাকে সারা বিশ্ব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। বলতে হয়: “A Big Thank You to Our All Ancestors of the Island”।
শুধু দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নয়, সন্দ্বীপের পশুসম্পদ,মৎস্য সম্পদ ও অঢেল নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেখে অভিভুত হয়ে পড়েন ফেড্রিক। তাই তিনি ৩ টি শূকর ও অন্যান্য জিনিস পত্র ক্রয় করলেন। সাথে সন্দ্বীপ টাউনের নগর পিতা বা প্রশাসক তাদেরকে অভয় দিলেন: তোমাদের ভয় পেতে হবেনা, পর্তুগিজরা তোমাদেরকে আক্রমণ করবেনা, আর আক্রমণ করলে আমরা প্রতিহিত করবো। “the Governour of the Towne did comfort us, and bad us that we should feare nothing”। তিনি সন্দ্বীপবাসীদেরকে মুর বা a race of Arab (বা North Africa মানে তিউনিসিয়া, মরক্কো বা মাগরেব) বলে বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য, তার লেখায় হরিশপুরের ও রহমতপুরের বর্ণনা অন্য রকম ভাবে এসেছে, যদিও তিনি নাম দুটো উল্লেখ করেননি। তার ভ্রমণ পঞ্জিতে তিনি বলছেন, এ ক্যানেলটি গোটা দ্বীপটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। “the [Island ]which is devided into two parts by a channell which passeth betweene it.” হয়তো তখন দুটো মৌজা/গ্রাম ছিল। ফেড্রিক হরিশপুর ও রহমতপুরের নাম হয়তো জানতেন না বা এ দু’টো নাম পরবর্তী সময়ে দেয়া হয়েছে (এ বিষয়ে আমার কোনো গবেষণা নেই, কথাগুলো শুধু ধারণা করেই বললাম মাত্র)।
[এখানে একটা কথা বলে রাখছি, ফেড্রিকের বর্ণনায় যে ইংরেজি ব্যবহার হয়েছে, তা বহু পুরোনো ইংরিজে। বর্তমানের ব্যবহৃত ইংলিশের সাথে এর অনেক তফাৎ, পড়তে একটু কস্ট লাগে বৈ কি!]
২. সাওতাল ক্যানেল থেকে রিডু ক্যানেল: আমার পিতার স্বপ্ন ও আমার বেড়ে ওঠার গল্প:
সন্দ্বীপের সাওতাল ক্যানেল থেকে আমার শিক্ষার যাত্রা শুরু। কার্গিল প্রাইমারি স্কুল, বশিরিয়া মাদ্রাসা, ঢাকা কলেজ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে BA (Hons), MA করি। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে তিনটি MA সমমানের ডিগ্রী লাভ করি। মন্ট্রিয়েলের Concordia Universityতে দু’টো ডিগ্রী (Journalism এ Post-Graduate Diploma ও Public Policyতে MA) লাভ করে রিডু ক্যানেলের দিকে ধাবিত হই। ইউনেস্কোর অফিসিয়াল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের ঐতিহাসিক রিডু ক্যানেলের পাশেই অটোয়ার কার্লটন ইউনিভার্সিটি দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Critical Geopolitics এ আমি PhD করি ও এখানে অনেক বছর শিক্ষকতা করি।
এখানে আমার পিএইচডি’র সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। প্রায় তিন ঘন্টার মতো আমার পিএইচডি’র ডিফেন্স বা ইন্টারভিউ হচ্ছিলো। আমার একদিকে ইন্টারভিউ বোর্ড আর অন্যদিকে অডিয়েন্স। এক্সটার্নাল এক্সপার্ট হিসেবে কঠিন প্রশ্ন করছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। প্রায় একঘন্টার মতো তীর ছোড়ার মতো করে প্রশ্ন করছিলেন লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। আমিও উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম একাধারে। আমার চোখে মুখে হাসি, আর বার বার আমার পিতার মুখখানা আমার সামনে ভেসে এসছিলো। আমি জানি কিছুক্ষনের মধ্যে আমার পিতার স্বপ্ন পুরণ করতে যাচ্ছি।
সবশেষে, ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান সম্মানিত প্রফেসর এমিরেটাস দাঁড়িয়ে বললেন: “Iqbal, yes! you did it.” আমার ৩৩৯ পাতার পিএইচডি গবেষণাকে আমার বাবার নামে উৎসর্গ করেছি ও প্রথম পাতায় লিখেছি: To my dad…[Marhum Ali Ahmed Talukder] Yes! I did it…
আমি দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনীতি, আঞ্চলিক সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক যোগাযোগ, ট্রান্স-বর্ডার ইন্টিগ্রেশ, আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা ,আঞ্চলিক হুমকি, এবং বিশ্বশক্তির ভূমিকার উপর PhD করি। আমার পিএইচডি’র শিরোনাম হলো: “Critical Geopolitics and the Construction of Security in South Asia”। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো আমার মরহুম বাবা আমার Doctorate উপাধিটা দেখে যেতে পারেন নি। আমার গবেষণাটি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ হিসেবে সারা বিশ্বের পাঠকের জন্য উন্মুক্ত। আপনি গুগল এ আমার নাম “Iqbal Shailo” টাইপ করে ক্লিক করলেই যেকোনো সময়ে পড়তে পারবেন।
বর্তমানে আমি কানাডা সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ ন্যাশনাল ডিফেন্স এ (DND) পলিসি এডভাইজর হিসেবে কর্মরত। আমি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে ইংলিশে BA (Hons.), MA পাশ করার পরপরই ADAB এ যোগদান করি। ADAB এর foreign desk এর আমি প্রধান ছিলাম। ADAB এ আমি ADAB News ও Grassroots নামক দু’টি Journal এর Executive Editor হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করি। ২৭ বছর বয়সেই এই এডিটরের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমাকে সাউথ এশিয়ার ইংলিশ জার্নালের সর্ব কনিষ্ঠ এডিটর হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ বেতারে ঢাকা কেন্দ্রে সংবাদ প্রবাহের প্রযোজনার দায়িত্বেও ছিলাম অনেক দিন। এর আগে আগে আমি ENAতে (Eastern News Agency) স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছি। দৈনিক দেশ পত্রিকায়ও প্রায় চার বছর প্রতি সপ্তাহে একটি কলাম লিখতাম । ডেইলি অবজার্ভার, ডেইলি ষ্টার, ঢাকা কুরিয়ার এ লিখেছি অনেক দিন। কানাডায় এসেও East-West Dialogue, Health Asia ও GSA Bulletin এ এডিটর হিসেবে কাজ করেছি। মন্ট্রেলের সবচেয়ে প্রাচীনতম সাপ্তাহিকী The Monitor এর স্টাফ রিপোর্টার ও এডিটোরিয়াল এসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করি। আমার ত্রিশটিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ পেন্টাগন সহ আন্তর্জাতিক জার্নাল এ প্রকাশিত হয়েছে।। চারটি পুস্তকও প্রকাশ করেছি। উল্লেখ্য,”সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকায় রোমান্টিসিজম” বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিস ডিপার্টমেন্ট, এরাবিক ডিপার্টমেন্ট ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রেফারেন্স বুক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আমি Concordia Universityর গ্রাজুয়েট সংসদের (প্রায় ৬০০০ হাজার ছাত্রের) VP Services হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। আমি প্রায় ৬টি ভাষা পারদর্শী ও দুটি ভাষা আংশিকভাবে ব্যবহার করি: বাংলা, ইংলিশ, ফ্রান্স, উর্দু, আরবি, ফার্সি, হিন্দি (আংশিক) ও রাশিয়ান (আংশিক)।
ঢাকা কলেজে প্রতিভা শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলাম। ঢাকা কলেজ থেকে “রক্ত রেখা” নামে একুশে সংকলনও বের করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল থেকেও একুশের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্দালয়ের প্রজ্ঞা অনুশীলন কেন্দ্রের সভাপতি ছিলাম। “অভিজ্ঞান” নাম একটি সাহিত্য সংকলনও বের করতাম।
সন্দ্বীপে ও ৮০ এর দশকের প্রথম দিকে দ্বীপ সাহিত্য গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি প্রায় দু বছর। সবাইকে সাথে নিয়ে কালচারাল বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করি। মনে আছে, সম্মিলিতভাবে আমরা দ্বীপ সাহিত্য গোষ্ঠীর ব্যানারে ক্রসড্যামের জন্য মিছিল করে UNOকে স্মারক-লিপিও প্রদান করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা কালীন ঢাকায় আমি সন্দ্বীপের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন মিছিল-মিটিং এ অংশ গ্রহণ করতাম।
৩. একজন সওদাগরের “সওদাই” ছিল সন্তানদের মাঝে শিক্ষার প্রসার:
আমার বাবা ছিলেন সন্দ্বীপের একজন প্রবীণ ব্যবসায়ী। আমার বাবা বিভিন্ন ধরনের ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি সন্দ্বীপ টাউনে টিন, সিমেন্ট, রড ও কাঠের ব্যাবসা করতেন। TCB থেকে লাইসেন্স এর মাধ্যমে ১৯৭৪ ও ৭৫ সালে মাল্যাশিয়া থেকে প্রায় দু’বছর retailer হিসেবে নারকেল তেল আমদানি করতেন। ১৯৭৬ ও ৭৭ সালের দিকে আমার আব্বা সন্দ্বীপের কাতার প্রবাসী মুসা মিয়ার সাথে দীর্ঘ দিন ধরে কাপড়ের এক্সপোর্ট ও ইম্পোর্টের ব্যাবসা করতেন। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ব্যাবসার জন্য রেংগুন, কলকাতা, আসাম, দিল্লী সহ বিভিন্ন শহরে যাতায়ত করতেন।
তাঁর উপার্জনের সব টাকাই আমাদের লেখা পড়ার পিছনে খরচ করেছিলেন। আমরা সবাই হোস্টেল, ড্রম বা হলে থাকতাম। অর্থের ব্যাপারে কোনোদিন আমাদের চিন্তা করতে হয়নি। আমাদের দশ ভাই বোনদের মধ্যে আমরা আটজনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছি। আমার পাঁচ ভাইবোন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এক ভাই ভাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET) থেকে আর আমি ও শিব্বীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেছি। আমার বড় ভাই মরহুম মোঃ শাহজাহান তালুকদার আব্বার সাথে একত্রে ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন। আর আমার মেজভাই মোঃ রফিকুর রহমান তালুকদারও মাঝে মাঝে আব্বাকে ব্যবসায়ীক কাজে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতেন।
আমার বাবা আমাদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সন্দ্বীপে বসবাস করে রীতিমতো সংগ্রাম করে গেছেন। একজন সওদাগর হয়েও তিনি শুধু শিক্ষার স্বপ্নিল সওদা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এখানে দু’একটি উদাহরন না টানলে আমার বাবার অবদানকে মনে হয় ভালোভাবে উপস্থাপন করা হবে না। তাই বলছি।
ক.
আমার বড় বোন প্রিন্সিপাল বেগম নুরজাহান আকবর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা মাওলানা। তিনি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে টাইটেল (কামিল) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগী লাভ করেন। তিনি যখন সন্দ্বীপ বশিরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৪ সালে আলিম পাশ করলেন, তখন উক্ত মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ মানে কতিপয় শিক্ষক (হুজুর) আব্বাকে এসে বললেন “আপনার মেয়েকে আর না পড়ানোই ভালো। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, বয়স হয়েছে, বিয়ের ব্যবস্থা করুন। সে আর ছেলেদের সঙ্গে একত্রে পড়তে পারবেনা, মাদরাসায় যেতে পারবেনা।” আব্বা শুধু ওই হুজুরের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন, হ্যাঁ/না কিছুই বললেন না। মোটামোটি আমার বড় বোনকে মাদ্রাসা পড়তেই তারা একরকম নিষেধ করলেন।
আমার আব্বা থেমে থাকার মানুষ না। আমার বোনকে আর মাদ্রাসায় যেতে দিলেন না বরং উক্ত মাদ্রাসার হেড মুহাদ্দিস ও হেড মাওলানাকে বাসায় লজিং রেখে ফাজিল ও কামিল পাস করালেন। বেগম নুরজাহান আকবর ফাজিল পাস করেন ১৯৬৮ সালে। তারপর তিনি Eden Girl’s College ভর্তি হন কিন্তু হোস্টেলে সিট না পাওয়াতে তিনি Comilla Women’s College এ ভর্তি হয়েও সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও BA পাস করেন। তিনি ১৯৭২ সালে কামিল (টাইটেল) পাশ করেন। তারপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ফিলোসফিতে MA ডিগ্রী লাভ করেন। MA পাস করার পর পরই তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি বর্তমানে ঢাকার মীরপুরে মাস্তুরাত নামে একটি মহিলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল।
তার হাজারো ছাত্রী দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। তার ছাত্রীরা আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্য এ মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করে ইসলামের সেবা করে যাচ্ছেন। তিনিই বলতে গেলে মহিলা মাদ্রাসা আন্দোলনের অগ্রদূত। বর্তমানে তিনি মূলত মহিলা মাদ্রাসায় প্রবর্তনে বাংলাদেশের পথ প্রদর্শক।
আজ যদি আমার আব্বা আমার বড় বোনকে মাদ্রাসায় না পড়িয়ে লেখা পড়া বন্ধ করে দিতেন, তাহলে কি তিনি সন্দ্বীপবাসীর জন্য এই বিশাল সন্মান ও গৌরব বয়ে নিয়ে আনতে পারতেন। আজ আমার বোন শধু সন্দ্বীপের নয়, সারা বাংলাদেশের প্রথম মহিলা মাওলানা। এটা সন্দ্বীপের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এটা ছিল ইসলামী শিক্ষার প্রতি আমার আব্বার মহান ভালোবাসা। আমার তখন জন্মও হয়নি, আব্বা কি ভাবে এতটা সুদুর প্রসারী ও ভিশনারি ছিলেন, ভাবতে অবাক লাগে। আমার বোনকে স্কুলে ভর্তি না করিয়ে তিনি মাদ্রাসায় পড়ালেন ও কলেজ-বিশ্বশ্বিদ্যালয় থেকে শিক্ষিতা করলেন।
খ.
আমার মেঝো বোন শারাবান তহুরা হলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মহিলা মাওলানা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে বি এ অনার্স, এম, এ ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৭৭ সালে ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ড থেকে কামিল (টাইটেল) পাস করেন ১৯৭৪ সালে। এম, এ পাশ করার পর পরই তিনি একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি Deputy Director হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহিলা শাখার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশের ছাত্রী ও মহিলাদেরকে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় সংগঠিত করার চেস্টায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি নিজেও একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন মিরপুর আমীন বাজারের কাছে।
গ.
আমার বড় ভাই মরহুম প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদার কার্গিল হাই স্কুল থেকে ষ্টার সহ এসএসসি পাশ করেন ১৯৭২ সালে। তারপর চিটাগাং কলেজ থেকে HSC পাস করেন। BUET থেকে Mechanical Engineering পাশ করার পর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ WAPDAতে যোগ দান করেন। তিনি আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে CIVIL এ BSc ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ওয়াপদার Executive Engineer থাকা কালীন ২০০৮ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইহকাল ত্যাগ করেন।
একজন সৎ ও মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সারা WAPDA অফিসে তার সুনাম ছিল। তিনি WAPDAতে যোগদান করেই আমার পিতার সঙ্গে সন্দ্বীপে দেখা করতে আসেন, তখন আব্বা ওনাকে একটা কথাই বলেছিলেন: “জাহাঙ্গীর, WAPDAতে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ, ভালো কথা। এটি একটি সুখবর কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ঘুষের ব্যাপারে অনেক বদনাম আছে, জীবনে এক টাকাও ঘুষ খাবেনা, যদি ঘুষ খাও তাহলে তুমি আমার ছেলে নয়। আরেকটা কথা শুনে রাখো, আমাকে তোমার একটা টাকাও দিতে হবে না। তুমি আল্লাহর পথে থাকবে আজীবন”।
ঘ.
আরেক ভাই মরহুম হুমায়ুন কবির তালুকদার কার্গিল হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে কয়েকটি লেটার সহ এসএসসি পাশ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে Statistics এ BSc (Hons) ও MSc পাশ করে রংপুর বিভাগে RDRS নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে অকাল মৃত্যু বরণ করেন।
ঙ.
আরেক বড় ভাই দিদারুল আলম তালুকদার কার্গিল হাই স্কুল থেকে কয়েকটি লেটার সহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে BA (Hons) ও MA এ ডিগ্রী লাভ করে গাজীপুরে একটি কলেজ বেশ কিছুদিন আধ্যাপনা করেন। তারপর তিনি ১৯৮৯ সালে ডাচ সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে Development Studies আবার MA ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে কর্মরত। তিনি আবার ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি ডিগ্রীও লাভ করেন।
চ.
আমার ছোট ভাই শিব্বীর আহমেদ তালুকদার ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্সে স্নাতকোত্তর করে ঢাকার বিখ্যাত lawyerদের সাথে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি আবার ঢাকা থেকে তিন বিষয়ে MA সমমান ডিগ্রী লাভ করেছেন। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় অধ্যয়ন কালীন তিনি প্রতিভা শিল্পী গোষ্ঠী সহ বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি “রক্ত রেখা” ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনের সাথেও সহ-সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। সন্দ্বীপে ও ৮০ এর দশকের প্রথম দিকে দ্বীপ সাহিত্য গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় কেন্দ্রিক সন্দ্বীপ ছাত্র পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
তিনি জাপান, বেলজিয়াম, ইতালি, ফ্রান্স সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছিলেন। পৃথিবীর প্রায় দেশে তিনি বাংলাদেশীরদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে সামাজিক ভাবে সংঘঠিত করেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষায় পারদর্শী শিব্বীর বর্তমানে লন্ডনে অনেক বছর ধরে আইন ব্যাবসা ও ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত।
তিনি বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের সংগঠন Connect Bangladesh এর কো-প্রতিষ্ঠাতা এবং যৌথ ও কালেকটিভ লিডারশিপ তত্ত্বের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। কোস্টাল বেল্টের উপর তার গবেষণা আছে। যুক্ত আছেন সন্দ্বীপ ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। তিনি সন্দ্বীপের পৌরসভার পূর্ব দিকে ৬ নং ওয়ার্ডে আমার প্রয়াত ভাই হুমায়ুন কবির তালুকদারের নামে একটি একাডেমী (দাখিল মাদ্রাসা, নূরানী ও হেফ্জ খানা) প্রতিষ্ঠা করেন।
ছ.
আমার ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস আফরিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় BA (Hons), MA পাশ করেন। তিনি MA পরীক্ষায় First Class First হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্বাবিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে Assistant Professor হিসেবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে কানাডায় আসেন ও Concordia University থেকে আরেকটি MA ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডায় PhDতে সম্পৃক্ত আছেন। আফরিন আবার মাদ্রাসা বোর্ড থেকে টাইটেল (কামিল) পাশও করেন।
৪. শেষ কথা:
আমার বাবার সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু জানেননা হয়তো। তাঁকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই। অত্যন্ত নিরহংকারী ও স্বল্পভাষী এ মানুষটি খুব নিবিবৃত ভাবে শিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে আমাদের সামনে হেঁটেছেন, আমরা তাঁকে অনুসরণ করেছি মাত্র।
আজীবন সন্দ্বীপে বসবাস করে (পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় চলে আছেন) তাঁর চিন্তা কিভাবে এমন উর্বর ছিল, একদিন বাবাকে জিগ্যেস করলে তিনি হেসে হেসে উত্তর দিলেন: “জীবনে অনেক শহরে ঘুরেছি, দেখেছি অনেক- সে অভিজ্ঞতার ফসল ও আমার সাধনা ছিল তোমাদেরকে সৎ ও শিক্ষিত করে তোলা। তোমাদের জন্য অঢেল সম্পত্তি রেখে যেতে পারিনি, কিন্তু সু-শিক্ষায় শিক্ষিত ও সৎ হতে অনুপ্রাণিত করেছি যা হলো আমাদের ইসলাম ধর্মের শিক্ষা। আমি শধু তাই করে গেছি, আল্লাহ যেন পরকালে এর অসীলায় আমাকে নাজাত দান করেন।“
আমার পিতা শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না বরং ছিলেন শিক্ষার প্রসারে একজন আলোকিত মানুষ। তার একান্ত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও আন্তরিকতা না থাকলে আজ আমি এতদূরে আস্তে পারতামনা। আমার তিন বোন ও ভাইয়েরা সন্দ্বীপের জন্য গৌরব বয়ে আনতে পারতেননা। আজ আমার বড় বোন শুধু সন্দ্বীপের গর্ব নয় বরং সারা বাংলাদেশেরই গর্ব।
আমার ছেলে ফালাক তালুকদার শাইলো সবসময় আমাকে বলে: “বাবা, I follow you always, কিন্তু তাকে আমি বলি- না বাবা, আমাকে না তোমার দাদু ভাইকে follow করো। আমি আমার ছেলেকে বলি, আমাদের প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) পরে তুমি যাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা করবে এবং যে হবে তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মডেল তিনি তোমার দাদু ভাই”। আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এ দোয়াটিই করি সব সময় (রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা)।
সন্দ্বীপের সাওতাল ক্যানেল থেকে কানাডার রিডু ক্যানেল নিয়ে অনেক কথাই বললাম, আর বলার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল আমার পিতার স্বপ্ন কিভাবে আল্লাহর রহমতে বাস্তবায়য়িত হলো, তা একটু আপনাদের জানিয়ে রাখলাম ওনার এই ২০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে।
লড়াকু দ্বীপবাসী হিসাবে বেড়ে ওঠার গল্প আপনারও আছে নিশ্চয়।
———
নোট:
আশা করি এই দুই পর্ব আপনাদের ভালো লেগেছে।
আগামী রোববার ২ অগাস্ট ২০২০ ইং, সময়: সকাল ৯ টা: আমার দেখা সন্দ্বীপ (পর্ব নং ১৩) পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।
সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিকথনমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ –
শিরোনাম থাকবে: সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (১)
আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। ঈদ মোবারক। ধন্যবাদ।
শিব্বীর আহমেদ তালুকদার।