ঈদের বিকেল, প্রায় সাড়ে ৪টা বাজে। শহরের ব্যস্ত মোড়ে ভিড় নেই, তবে তিন চারটা ছোট ছোট জটলা। সামনে এগুতেই দেখি তিন কোরবানির মাংস বিক্রির অস্থায়ী দোকান। কেজি হিসেবে নয়, মাংস বিক্রি হচ্ছে ভাগ হিসেবে। তিন পরিমাণের ভাগ, দাম ৩শ, ৫শ এবং এক হাজার টাকা। স্বভাব দোষেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছি এবছর এসব মাংসের মূল ক্রেতা কারা।
রিকশা ও মিশুক চালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষরা প্রচুর দরদাম করে মাংস কিনছেন। এদের ফাঁক গলে কিছু মানুষ দ্রুত মাংস কিনে চলে যাচ্ছেন। তাদের আচরণে সংকুচিত ভাব যেনো কেউ দেখে না ফেলে, ইজ্জত রক্ষার সচেতন চেষ্টা। ক’জনকে দেখলাম জটলাকে কেন্দ্র করে ঘুরছেন, কিন্তু জটলায় মিশে যেতে পারছেন না, জটলা থেকে দূরেও যেতে পারছেন না। বিশেষ করে একজনের প্রতি চোখ আটকে গেল। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে, শরীরে পরিচ্ছন্ন ক্রিম কালার পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি পরনে।
তিনি রিকশা থেকে নেমে জটলা কেন্দ্র করে দুই তিনবার ঘুরলেন। একবার ঠেলে ভেতরে যেতে চেয়েও ব্যর্থ হলেন। এরপর খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ভিড়ের দিকে। তার চোখ দেখেই বুঝা যায় ভিড় কমার অপেক্ষা করছেন, এমন ভিড় ঠেলে সস্তায় মাংস কেনায় তার অভ্যাস নেই বা অস্বস্তিবোধ করছেন। কোনোকিছু না ভেবেই এগিয়ে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি কি মাংস কিনতে আসছেন?
কিছুক্ষণ কি যেনো ভেবে, বা আমাকে তার দলের লোক মনে করে বললেন,
– হু।
– কিনে ফেলেন, দেরি করলে তো শেষ হয়ে যাবে।
– এই ভিড় ঠেইলা কেম্নে কিনি! আপনেও তো কিনতে পারতাছেন না।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কত টাকা বাজেট?
– পাঁচ/ছয় শো টাকার মাংস কিনুম।
– আমার পছন্দ মত কিনা দিলে হইবো?
তিনি সম্মতি জানাতেই তাকে দাঁড় করিয়ে মাংস কিনতে জটলার মধ্যে ঢুকলাম, দুইভাগা কোরবানির মাংস কিনলাম ৬০০টাকায়। ওজনে কমবেশী আড়াই কেজি। মাংস ভর্তি পলিথিন তাকে এনে দিতেই জানতে চাইলেন, ‘আমারটা কিনিনি কেনো!’ তাকে জানালাম, ‘আমি মাংস কিনতে আসিনি।’ এবার তিনি আমার পোশাক খেয়াল করলেন, আমার শরীরে পুরানো পাতলা গেঞ্জি আর ট্রাউজার, পায়ে বৃষ্টিজনিত কাদায় ব্যবহারের জন্য অতি সস্তা দামের রবারের স্যান্ডেল। কড়কড়ে রোদের ঈদের বিকেলে খুব সন্তর্পণে আমার দিকে ২০টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন, সম্ভবত আমাকে মাংস কেনার দালাল মনে করেছেন। তাকে বললাম,
– বখশিশের দরকার নেই, কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবেন?
– বলেন..
– বাজারে তো মাংস পাওয়া যায়, এখান থেকে মাংস কিনলেন ক্যান?
– কিনছি কি আর সাধে! গত চার মাস ধইরা অফিস অর্ধেক বেতন দেয়। এইবার দেশেও (গ্রামের বাড়ি) যাইতে পারি নাই। বাজার থেকা গোশত কিনার ক্ষমতা থাকলে কি আর এইখান থেকা কিনি!
– সর্যি। এবার কোরবানির মাংস পান নাই?
– না। আমরা ভাড়াটিয়া, ভাড়াটিয়ারে কে মাংস দিবো! এদিকে তিন’টা বাচ্চা দুপুর থেকা জ্বালাইতাছে ‘কোরবানির গোশত’ খাইবো। না, পাইরা এইখানে কিনতে আইলাম।
এরপর কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন,
– আপনে এইখানে কি করেন?
– কিছু করিনা। ঘটনা দেখি, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি।
– ও! কি জানি! তবে একটু চা খান?
– তা খাওয়া যাইতে পারে।
চা খাওয়ার সময় আর কোনো কথা হলো না। চায়ের বিল তিনি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চাওয়ালাকে আগেই ইশারা করে রাখায় তার কাছ থেকে বিল নেয়নি। দ্বিতীয়বার তিনি বিব্রত হলেন হয়তো। তিনি রিকশা দিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। তার সন্তানদের চিনিনা, দেখার প্রশ্নও আসেনা। তবুও যেনো দেখতে পাচ্ছি- কোরবানির গোশত দিয়ে তাদের মা সালুন রান্না করেছে, ওই সালুনের খুশবু ছড়িয়ে পরছে বাতাসে। গরম পোলাও থেকে ধোঁয়া উঠছে। সবাই মিলে গোল হয়ে খেতে বসেছে। সবার মুখে কোরবানি ঈদের আনন্দ আর উচ্ছাস। শুধুমাত্র বাবার মনটা খচখচ করছে, তার সব অশ্রু গোপন বাষ্প হয়ে মিশে যাচ্ছে সালুনের খুশবু আর পোলাওয়ের ধোঁয়ায়, নিজের অভাবকে কোরবানি দিতে না পারার গাঢ় অক্ষমতায়।
ঈদুল আযহা/১আগস্ট’ ২০২০
#দিনযাপন
– আবু সাঈদ আহমেদ লেখক ও সাংবাদিক