সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ নিহতের ঘটনায় থানার ওসিসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা করেছেন তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
বুধবার সকালে টেকনাফ উপজেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারহার আদালতে মামলাটি (নম্বর ৩-টেকনাফ) করা হয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানার ওসিকে এজাহারের ধারা অনুযায়ী হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলাটি রেকর্ড করে সাত দিনের মধ্যে আদালতকে অবগত করার আদেশও দেন আদালত। মামলা রেকর্ডের পর কক্সবাজারস্থ RAB-১৫ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার আজিম আহমেদকে তদন্ত করার নির্দেশও দেন আদালত।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল ও মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, মামলার এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছে টেকনাফ বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে। ২নং আসামি করা হয়েছে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে।
এ ছাড়া অন্য সাত আসামি হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
জানা গেছে, সিনহার বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ খান অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন। ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেছিলেন সিনহা।
২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ভ্রাম্যমাণ এক ব্যবসায়ী জানান, মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে একটি প্রাইভেটকার পৌঁছলে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ব্যারিকেড দেন।
এ সময় হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন একজন (সিফাত)। এর পর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন মেজর (অব.) সিনহা মো, রাশেদ। তিনি নামার সঙ্গে সঙ্গে কোনো জিজ্ঞাসা না করেই গুলি ছোড়েন লিয়াকত আলী। মুহূর্তেই সিনহা মাটিতে ঢলে পড়েন।
একপর্যায়ে ১০-১২ মিনিট পর সাদা নোয়াহ (মাইক্রোবাস) যোগে ঘটনাস্থলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ উপস্থিত হন। কয়েক মিনিট পর একটি মিনি ট্রাকে (পিকআপ) সিনহা মো. রাশেদকে তুলে কক্সবাজারের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন ওসি।
ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হামিদ আরও বলেন, ‘আমার চোখের সামনে ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা কখনও ভোলার নয়।
তবে পুলিশের ভাষ্য ভিন্ন। পুলিশ বলছে– চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সিনহা বাধা দেন। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে রাশেদ পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর গেস্ট হাউসে সিনহার কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বিদেশি মদ ও গাঁজা উদ্ধার করে।
এ ঘটনার পর কক্সবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেন।
এ সময় চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করলে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়।
এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই সিনহার মৃত্যু হয়েছিল। শনিবার সকালে তার ময়নাতদন্ত হয়েছে। তার বুক ও পিঠে জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়।
এদিকে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদের মৃত্যুর ঘটনায় প্রথমে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি হয়। পরে ওই তদন্ত কমিটি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে পুনরায় গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানকে।
পাশাপাশি কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপপুলিশ মহাপরিদর্শকের মনোনীত অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মোহাম্মদ জাকির হোসেন, রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডারের মনোনীত লে. কর্নেল এসএম সাজ্জাদ ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) মো. শাহাজান আলী।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১, ৩৪ ধারায় দায়ের করা এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামে। দুই নম্বর আসামি হয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মামলার অপর সাত আসামি হলেন থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। তাঁর বাড়ি বরগুনার পূর্ব শফিপুর গ্রামে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর (অব) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এই পোশাক তিনি পরেছিলেন।
এজাহারের ভাষ্যমতে, রাত আটটা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তাঁরা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছালে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত ওপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন।
এ পর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত ওপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ্য করে আরও গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু।’ এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাঁকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরও একটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এ ছাড়া নিজের বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষীদের ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন।
রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।