সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীরা স্বামীর কৃষি জমির ভাগ পাবেন বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে এ অসংগতি দূর করে গতকাল রায় দিল হাইকোর্ট। এ রায়ের ফলে হিন্দু নারীরা সেই উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি পেলেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজনীতিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা এ রায়কে যুগান্তকারী রায় হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ৮৩ বছরের গ্লানি থেকে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। এ রায়ে শুধু হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকারের স্বীকৃতিই নয়, বাংলাদেশের মর্যাদাও বেড়েছে। তবে এ সংক্রান্ত আইন সংসদে প্রণয়ন চান বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তারা বলেন, শুধু স্বামীর সম্পত্তি নয়, আমরা চাই বাবার এবং স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের সমান ভাগ।
খুলনার বাটিয়াঘাটা এলাকার অধিবাসী গৌরী দাসের নামে তার স্বামীর কৃষিজমি রেকর্ড হয়। ওই জমি রেকর্ডের বিরুদ্ধে সহকারী জজ আদালতে ১৯৯৬ সালে মামলা করেন তার দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মন্ডল। কিন্তু আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয়। আদালত রায়ে বলে, অকৃষিজমিতে বিধবা হিন্দু নারীরা অংশীদারিত্ব পেলেও কৃষিজমিতে সেই অধিকার রাখেন না। এর বিরুদ্ধে যুগ্ম জজ আদালতে আপিল করলে আদালত মামলাটি খারিজ করে রায়ে বলে, স্বামীর কৃষিজমির ভাগ পাওয়ার অধিকার রাখেন বিধবা হিন্দু নারীরা। এরপর এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ।
আপিলের ওপর দীর্ঘ শুনানিতে কৃষি ও অকৃষি জমিতে হিন্দু বিধবা নারীরা অংশীদারিত্ব থাকার বিষয়ে ১৯৩৭ ও ১৯৪৭ সালের দুটি আইনের বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। ওই পর্যালোচনা শেষে হাইকোর্ট বলে, অকৃষি জমির পাশাপাশি কৃষিজমিতেও অংশীদারিত্ব পাবেন হিন্দু বিধবা নারীরা।
আদালতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মতামত দেন ব্যারিস্টার উজ্জ্বল ভৌমিক। তিনি বলেন, হিন্দুদের মধ্যে সাধারণত বিধবা নারীরা স্বামীর বসতভিটার মালিকানা লাভ করতেন। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে হিন্দু বিধবা নারীরা এখন থেকে কৃষিজমিরও ভাগ পাবেন। আদালতে বাদীপক্ষে অ্যাডভোকেট আবদুল জব্বার, বিধবা নারী গৌরী দাসের পক্ষে ব্যারিস্টার সৈয়দ নাফিউল ইসলাম শুনানি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি এটর্নী জেনারেল শাহ মো: আশরাফুল হক। তিনি বলেছেন, এই রায়ে হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর সব সম্পত্তিতেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।
“এই রায়ের ফলে কোর্ট যেটা বলছেন, একজন হিন্দু বিধবা নারী তার স্বামীর কৃষি জমিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, ভাগ পাবেন। আনুপাতিকহারে সম্পত্তির ভাগ পাবেন।”
৮৩ বছর আগের ১৯৩৭ সালের হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইনে স্বামীর বসত ভিটাতেই শুধু বিধবা নারীদের অধিকার ছিল।
তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারিরা বলেছেন, এমন আইন থাকলেও বিধবা নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই শুধু বসতভিটায় কোনভাবে থাকার অনুমতি পেতেন।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) সমন্বয়কারী জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণ নাগরিকের চাহিদা অনুযায়ী এটা কিছুই নয়। আমাদের দেশের চাহিদা হচ্ছে সন্তান হিসেবে সব সম্পত্তির (বাবা ও স্বামীর) অর্ধেক পাবে নারী। কিন্তু এখানে শুধু স্বামীর সম্পত্তির ভাগের কথা বলা হয়েছে। এ আইনটা পাস হওয়া উচিত সংসদে। হাইকোর্টে এ রায়টা পাস হওয়ায় এক ধরনের আশঙ্কা থেকে যায়। যে কেউ এসে এ আইনের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। তাই আমরা চাই এটা সংসদে পাস হোক।
বিধবা বৌদি স্বামীর কৃষিজমি পাওয়ার অধিকার রাখে না এমন দাবি করে ১৯৯৬ সালে খুলনা কোর্টে মামলা করেন দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল। এতে নিম্ন আদালত বলে, বিধবারা স্বামীর অকৃষি জমির অধিকার রাখলেও কৃষিজমির রাখেন না। আপিল করার পর জেলা জজ দেন ভিন্নমত। রায়ে বলা হয়, বিধবারাও স্বামীর কৃষিজমির অংশীদার হবেন। বিষয়টি গড়ায় উচ্চ আদালতে।
১৯৩৭ সালে হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইনে, স্বামীর অকৃষি জমির অধিকার দেওয়া হলেও কৃষিজমি থেকে বঞ্চিত করা হয় তাদের। আইনটি নিয়ে দুপক্ষের দীর্ঘ শুনানি শেষে অ্যামিকাস কিউরির মত নেয় হাইকোর্ট। পরে রায়ে জানায়, হিন্দু বিধবারা অকৃষি জমির মতো স্বামীর কৃষিজমিরও মালিক হবেন।
হিন্দু বিধবা নারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ নাফিউল ইসলাম বলেন, ‘এতদিন বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকারিত্বে যারা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে শাস্ত্রমতে পিণ্ডদান করতে পারেন তারাই মৃত ব্যক্তির একমাত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকার। হিন্দুদের মধ্যে সাধারণত বিধবা নারীরা স্বামীর বসতভিটার মালিকানা লাভ করতেন। আজকের এ রায়ের ফলে হিন্দু বিধবারা স্বামীর কৃষিজমিরও ভাগ পাবেন।’
প্রসঙ্গত, হিন্দু আইনের সবচেয়ে কঠোর অংশ হলো মেয়ে সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়টি। ১৯৩৭ সালে তৈরি এ আইনে বাবার সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় মেয়েদের। আর সীমিত ক্ষেত্রে পাঁচ পর্যায়ের হিন্দু নারীকে জীবিত থাকার শর্তে স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়। তবে তাদের মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েরা ওই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই পাঁচ পর্যায়ের নারী উত্তরাধিকারী হচ্ছে বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা ও পিতার পিতার মাতা। এ ধরনের অধিকার বিধবার সম্পত্তি বা উইডোজ এস্টেট হিসেবে পরিচিত। যদিও বিধবা ছাড়াও অন্যরা এ অধিকার পেতে পারে। তবে তা শুধু জীবনস্বত্বে। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পত্তি পূর্ব-মৃত ব্যক্তির পুরুষ উত্তরাধিকারীর দখলে চলে যায়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া এ সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার বিধবা নারীদের নেই।
দায়ভাগ আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির ছেলে থাকলে মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায় না। আর যদি ছেলে না থাকে সে ক্ষেত্রে অবিবাহিত ও ছেলেসন্তান জন্মদানকারী মেয়েরা জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকার পায়। বন্ধ্যা, বিবাহিতা বা বিধবা ও মেয়েসন্তান জন্মদানকারী মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পান না। অর্থাৎ মেয়ের অধিকার নির্ভর করে ছেলে থাকা বা না থাকার ওপর। পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন আইন আছে এর মধ্যে হিন্দু আইন অন্যতম। তবে কোথায় কীভাবে এর সূচনা হয়েছে তা বিশদভাবে কারও জানা নেই।