যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেছেন-আমাদের জীবদ্দশায় চারটি বড় ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্বের ইতিহাস এবং পথপরিক্রমাকে বদলে দিয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে বার্লিন ওয়ালের পতন, ৯/১১, ২০০৮ সালের অর্খনৈতিক সংকট এবং এখন আমরা যার মধ্যে আছি সেটা হচ্ছে কোভিড -১৯ এর আক্রমণ।
ড: আলী রীয়াজ ঢাকাভিত্তিক চ্যানেল আই’য়ের টকশো তৃতীয়মাত্রায় ৯/১১ এর বিষয়ে আয়োজিত এক টক শো’তে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখছিলেন। জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১২.৫৫ মিনিটে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়। অন্যান্যের মধ্যে টক শোতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার (অব:) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন যোগ দেন।
প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, এই যে চারটা ঘটনা তার মধ্যে ৯/১১, সেটা অন্য গুলোর মত না হলেও একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৈরি করেছে। মার্কিন সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটা মৌলিক পরিবর্তন যেটা ঘটেছে, একটা বড় পরিবর্তন যেটা ঘটেছে সেটা হলো ধরুন একেবারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড এন্ড সিকিউরিটি বলে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। এটা একটা বড় রকমের ঘটনা। এটা তৈরি হয়েছিল ৯/১১ এর ১০ দিনের মধ্যে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে কিছু ছিল না। এই যে ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড এন্ড সিকিউরিটি তৈরি হলো তার যে কতটা প্রভাব- সম্প্রতি পোর্টল্যান্ডে ফেডারেল গভর্ণমেন্ট যে সব লোকজনকে পাঠিয়েছিল তাদেরকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির আন্ডারেই পাঠানো হয়েছে। তার মানে হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে, এ ব্যবস্থাগুলো একদিকে অভ্যন্তরীণভাবে যেমন জননিরাপত্তার কথা বিবেচনার কথা ছিল তার বদলে এগুলো জননিরাপত্তার জন্য হুমকিও হতে পারে সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটাকে একটা উদাহরণ হিসেবে বললাম। এটাই যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়।
তিনি বলেন- সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ যেটা অভ্যন্তরীণভাবে ঘটেছে সেটা হচ্ছে এই যে নজরদারী ব্যবস্থাটা এটা এক ধরণের বৈধতাই নয়, স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।
প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন- মার্কিন সমাজের একটা বড় শক্তি ছিল সিভিল লিবার্টিজ যে গুলো, নাগরিকদের যে অধিকার সেগুলো আসলে অনিয়ন্ত্রিত ছিল। সে গুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ তার অনেকগুলোই আসলে তৈরি হয়েছে ওই সময়ে। তারপর যেটা হয়েছে বিভিন্নভাবে সেগুলো খানিকটা ফেরত আনা হয়েছে। কিন্তু সবটা ফেরত আনা যায়নি।
তিনি বলেন- রাস্ট্রের যে অভাবনীয় ক্ষমতা আছে সে ক্ষমতা যদি রাষ্ট্র ব্যবহার করে এবং তাদের নাগরিকদের উপর নজরদারী করে ক্ষেত্রবিশেষে অবৈধভাবে ব্যবহার করে, সে ব্যবস্থাটাকে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। তারপর যেটা হয়েছে সেটা ধরুন সমাজের মধ্যে ইসলামোফোবিয়া তৈরি হয়েছে, ইমিগ্রেশন বিরুদ্ধে চিন্তা ভাবনা তৈরি হয়েছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে হয়তো সরাসরি ৯/১১ এর সাথে আপনি যুক্ত করতে পারবেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে মিলিশিয়া ছিল, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ছিল কিন্তু সে গুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে যে কার্যক্রমগুলো হয়েছে, যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে সেটা আমি পোস্ট ৯/১১ বলি। সে কারণে আমি যে ২০০৮ সালের কথা উল্লেখ করিনি।
ড. আলী রীয়াজ যোগ করেন, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব শুধু যে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে পড়েছে তা নয়, তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়েছে। সেটা ঠিক, ঘটনাচক্রে হয়তো এটা বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়াতে সেভাবে প্রভাব তৈরি করেনি। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের সবচে বড় দিকটা হচ্ছে যে ধরণের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে তারমধ্যে যে বৈষম্যটা আছে এবং এই বৈষম্য যে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তাতে যে খুঁত তৈরি হয় তা পরিস্কার হয়েছে এবং ২০০৮ সালের এই অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সারা পৃথিবীতে এক ধরণের পপুলিস্ট বা লোকরন্জনবাদী রাজনীতির সূচনার অবকাশ তৈরি হয়েছে। এটা সে রাজনীতির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। সে অর্থে আমি বলি- কিন্তু আবার যদি আরেকটু পেছনে যান তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে বার্লিন ওয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে যে স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের কারণে যে একচ্ছত্র আধিপত্য যে এম্পেয়্যারের মেন্টালিটি আমেরিকার মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটা আসলে ৯/১১ এর পরে আমরা এর একটা প্রকাশ দেখতে পাই; ওয়ার অন টেররের নামে যে কান্ডটা করা হয়েছে সে গুলোর মধ্যে। এগুলো আসলে ইন্টার রিলেটেড। একটা আরেকটার সাথে প্রত্যেক দিনের ঘটনায় যুক্ত নাও থাকতে পারে কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তৈরি হওয়া, সার্ভিলেন্স তৈরি হওয়া, ইসলামোফোবিয়া বাড়া কিংবা ইমিগ্রেশনের বিরুদ্ধে এক ধরণের মনোভাব তৈরি হওয়া এগুলো মার্কিন ব্যবস্থার মধ্যে ভেতর থেকে এক ধরণের দুর্বলতা তৈরি করেছে এবং তারই সাথে যখন ২০০৮ সাল এসে যুক্ত হয়েছে তারই সাথে আমরা দেখেছি যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্যাট্রিইওটিজমের নামে শুরু হয়েছে। পোস্ট ৯/১১ প্যাট্রিইওটিজমকে কেন্দ্র করেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছে।
ড. আলী রীয়াজ বলেন- ৯/১১ পরবর্তী এবং করোনা সংকটের এ সময়েও সংকটগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক বা আধা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকারগুলো মানুষের অধিকারকে সংকুচিত করার চেস্টা করেছে। নিরাপত্তার অজুহাতে ও তথ্যের উপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু রাস্ট্রের কর্তৃত্ববাদী শাসকরা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।