সাইফুর রহমান। যার চেহারার মধ্যেই ফুটে আসে ভয়ংকর এক সন্ত্রাসীর সংস্করণ। এমসি কলেজ ও ছাত্রাবাসে এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখানে তার হাত ছিলো না। ছাত্রাবাসে অবৈধ সিট দখল, সিট বানিজ্য, খাবারের টাকা না দেওয়া, ক্রীড়া সামগ্রীর জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়া, সাধারণ ছাত্রদের হয়রানি, মারধর, গালাগালি, মিছিল মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্চিত করা ছিলো তার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। ছাত্রাবাসের পাশের বাজার বালুচরে সে কখনো টাকা পরিশোধ করতো না। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সে দলবল নিয়ে রেস্টুরেন্টে ও বিভিন্ন দোকানে খাওয়া দাওয়া করতো। তার বিরুদ্ধে বাকিতে খাওয়ার এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভয়ে এতদিন চুপসে ছিলেন সেখানের ব্যবসায়ীরা।
শুধু রেস্টুরেন্টে নয়, সাইফুর টিলাগড় ও বালুচরের সেলুনগুলোতে টাকা না দিয়েই চুল ও দাড়ি কাটতো। টাকা চাইলে দোকান ভাংচুরের ভয় দেখাতো। এতো গেলো তার ছাত্রাবাসের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের আমলনামা। এবার আসি কলেজ ক্যাম্পাসে সে কি করতো! কলেজের এমন কোনো নিয়মিত ছাত্রী নাই যে তাকে আজরাইলের মতো ভয় পেতো না! ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রীদের ইভটিজিং করা ছিলো তার নেশা। এক ছোট বোন একটু আগে কল দিয়ে জানালো, সে নাকি একবার ধর্ষণের ভয় দেখিয়েছিলো। তারপর থেকে ছোট বোনটি দেড় বছর ক্যাম্পাসে আসেনি। আসলেও হাত মোজা কিংবা বোরকা পড়ে চুপিসারে আসতো!
মেয়েদের ওড়নায় টান দেওয়া ছিলো তার খুব সাধারণ একটি কাজ। তার কর্মকাণ্ড নিয়ে কলেজ ছাত্রলীগ এর দুটি পক্ষ বিব্রত থাকলেও দৃশ্যমান ব্যবস্থা কখনোই নেওয়া হয় নি। সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আমার এক সহকর্মীকে গেলো বছর সে শাসিয়েছিলো। হাতও তুলতে চেয়েছিলো। আমি থাকায় সে আর সাহসটা করেনি। পরে সে দলবল নিয়ে টিলাগড়ের ভুট্টো রেস্টুরেন্টে ক্ষমা চেয়ে যায়! সাইফুরের বিরুদ্ধে প্যান্টের বেল্ট খুলে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। তাকে সবসময় সঙ্গ দিতো তার সাথে থাকা ছেলেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র আমাকে জানান, ২০১৮ সালে তিনিসহ তার বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভবনের সামনে। এ সময় সাইফুর এসে তাদের সাথে থাকা মেয়ে বন্ধুটিকে উত্যক্ত করেন। সবাই প্রতিবাদ করলে সাইফুর সবাইকে বেধড়ক প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পেঠাতে থাকে। লজ্জা, আত্মসম্মান ও ‘ক্ষতাসীন‘ সাইফুরের ভয়ে ঐ শিক্ষার্থীরা কাউকে এই বিষয়ে বলেন নি। ঘটনা শুনে মেয়েটির গরীব অভিভাবক তাড়াহুড়ো করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। এভাবেই শত মায়ের, বাবার, ভাইয়ের, বোনের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে সাইফুর। এভাবেই তার সন্ত্রাসী জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিলো। মোটর সাইকেল নিয়ে নিয়মিত মহড়া দিতো ক্যাম্পাসে সে। ইচ্ছা করেই সে অনেক ছেলেমেয়েদের ধাক্কা দিতো। শুধুমাত্র ভয়ে কেউ কিছু বলেন নি। তাকে যারা লালন পালন করতো তাদের কাছেও অভিযোগ দিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যেতো না । করোনার পূর্বে প্রতিদিনই এমসি কলেজের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে শত শত মানুষ আসতেন। সেখানেও বিভিন্ন পন্থায় দল নিয়ে ছিনতাই করতো সাইফুর! ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে মাদক সেবন করতো তার দখলকৃত ছাত্রবাসের বাংলাতো।
সর্বশেষ সে গত শুক্রবার যে কাজটি করেছে সবাই তা জেনে গেছেন। এর আগেও সাইফুর ও তার গংদের দ্বারা অনেক তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজ রোববার সকালে ভারত পালিয়ে যাওয়ার সময় সুনামগঞ্জের ছাতকে সাইফুর গ্রেফতার হয়েছে। অনেকেই স্বস্তি পাচ্ছেন। এই স্বস্তি যাতে জীবনভর সবাই ফেলতে পারেন সেই ব্যবস্থাই প্রশাসন করবে বলে বিশ্বাস করছি। এ রকম সাইফুর হয়তো সময়ের সাথে সাথে এমসি কলেজ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে তৈরী হয়ে যাবে। ক্ষমতার লোভ এ রকম সাইফুর তৈরী করছে। প্রত্যাশা করি এ রকম সাইফুর আর সবুজ ক্যাম্পাসে বেড়ে ওঠার সাহস পাবে না। আমার ক্যাম্পাসের প্রতিটি বোন-ভাই ও শিক্ষকরা যাতে এ রকম সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিরাপদ থাকেন সেটাই কামনা কর করি। আলো আসবেই।
– আজহার উদ্দিন শিমুল, সাধারণ সম্পাদক,
এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি, সিলেট।
২৭ সেপ্টেম্বর, রবিবার, ২০২০ ।