পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, সে গৌরবের সিংহভাগের দাবীদার পুরুষ সমাজ। এমনকি নারী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজা রামমোহন রায় এবং মহান বিদ্যাসাগর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশেও বর্তমানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব প্রধানত আমাদের দেশের পুরুষ সমাজই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এবং এটাই নিয়ম। প্রগ্রতির ধারায় এগিয়ে থাকা মানুষেরাই যুগেযুগে সমাজের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। উল্লেখ থাকে যে, দাস ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও লড়াই করেছিলো প্রধানত দাস মালিকের ছেলেরাই। কিন্তু আমি আজ এখানে একটু ভিন্ন কথা বলবো। নিজেদের ঘরের মধ্যে একটু উঁকি দিয়ে দেখব, সেখানকার চিত্রটা কী। আমাদের ঘরের মধ্যে কী হচ্ছে তাও একটু খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে, ঘরের মধ্যের মানুষের চিন্তার একটা সম্পর্ক আছে। তাছাড়া আমরা যারা সাধারণ মানুষ,আমরাই বা কোন্ চোখে দেখছি নারী নির্যাতন এবং নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন।
আমাদের দেশের অভিভাবক মাত্রই ভুক্তভোগী নারী নির্যাতন আজ চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন করার কারণে। অথচ আমরা সেই অভিভাবক মাত্রই চাতক পাখীর মতো ফটিক জল ফটিক জল করে রাত দিন পার ক’রে দিচ্ছি। কে কবে আমাদের মেয়েদের জীবন এবং সম্ভ্রমের নিশ্চয়তা দেবে! আমাদের ভাবখানা এমন, আমরা বেতন দিয়ে কিছু মানুষ ঠিক ক’রে রেখেছি,ওরাই মিছিল করুক,গুলির সামনে রাজপথে দাঁড়িয়ে ওরাই মরুক। সময় মতো ফলটা আমাদের দোরগোঁড়ায় পৌঁছোলেই হোলো। খালেদা জিয়া সরকার যে সাতজন কৃষক হত্যা করেছিলো তার বিচার আজও তারা পাইনি। অথচ ওই সাতজন কৃষক ইয়াসমিন হত্যার বিচার চাইতে গিয়েই জীবনটা দিয়েছিলো। যে ডাক্তার ইয়াসমিন হত্যার মিথ্যা ময়না তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছিলো,তাকেও বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা অভিভাবকরা ওই সাতজন কৃষক হত্যার এবং মিথ্যা রিপোর্ট দেওয়া ডাক্তারের বিচার চেয়ে রাজপথে নামতে পারতাম। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা পালন করিনি। আমরা এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি দিনাজপুরের সাতজন কৃষকের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত ইয়াসমিন হত্যার বিচার। ভাবখানা এরকম, যেন আমরা দয়া না করলে ইয়াসমিন হত্যার বিচার হোতো না। কোনোকিছু উপভোগ করবার একটা সীমারেখা থাকা দরকার, আমরা রীতিমত তা ভুলে যাই। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে এখনকার বাবা মায়েরা সন্তান বিষয়ে খুব সচেতন। এটা নিশ্চয় খুব ভালো লক্ষন। কিন্তু এটাও সত্য, ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের কণ্ঠ ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। এবং সে ক্ষীণ এতোটাই যে, পাশে নির্দয় নারী নিপীড়ন দেখেও, পালে বাতাস লাগা নৌকার মতো আমরা উদ্দেশ্যহীন জীবনে ভেসে চলেছি।
আমরা কেনা জানি,মেয়েদের মৌলিক অধিকার দিনে দিনে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকে পড়ছে! সম্পত্ততিতে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা আজ জরুরীই শুধু নয়,এই অধিকার কার্যকরী করার সঙ্গে সমাজে নারীর প্রতিষ্ঠা পাওয়াও অনেকখানি নির্ভর করছে। আর একটা আজব কথা না বললেই নয়, তা বিবাহ আইন। আমাদের দেশে বিবাহ আইন মেয়েদের ১৮ বছর না হলে বিবাহ দেওয়া অন্যায় এই বক্তব্য একেবারেই প্রতিষ্ঠিত নয়। অথচ এটা প্রতিষ্ঠিত করবার বিকল্প কিছু নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা এবং ভাইয়েরা এগুলো কিন্তু সব জানেন। কিন্তু তার পরেও আমরা আছি উটপাখির মতো বালির মধ্যে মুখ গুজে। একজন বাবা-একজন ভাই তার ঘরের লাঞ্ছিত নারী সদস্যের জন্যে সরব হবেন না, তারপরেও বলবেন আমার মেয়ে রাজকন্যা কলিজার টুকরা! আমার মেয়ের মধ্যেই আমার জীবন! এ রীতিমতো সোনার পাথর বাটি চাওয়ার মতো।
আর একটা কথা আমি বলবো, তা শুনতে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তারপরেও আমি সকলের বিবেচনার জন্য বলবো। এখন সমাজে এটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ছেলে মেয়েরা নিজেরা পছন্দের ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারে। নিশ্চয় খুবই সুখের বিষয় এটা। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের খেয়াল করা দরকার, যে সকল ছেলেরা নিজেদের পছন্দমতো দাম্পত্যসঙ্গী খুঁজছেন তাদের কতজন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। এই যে স্বাধীনভাবে দাম্পত্য সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা, এটাও একটা সামাজিক আন্দোলনের ফল। একজন ছেলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অংশ গ্রহন করবেন না, কিন্তু তিনি নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতিতের অর্জন করা সুবিধা ভোগ করবেন,এটা ওই ছেলের জন্য অবশ্যই এক ধরনের সুবিধা। যে ছেলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধ্বে রাজপথে দাঁড়ায় না, সে স্বাধীনভাবে দাম্পত্যসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারও পেতে পারেন না। আমাদের দেশের মেয়েদের অন্তত এটুকু বোঝা দরকার, যে ছেলে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, সে কেন একজন স্বাধীন মেয়ের সঙ্গে জীবন গড়তে চাইবে। এবং এই ছেলে শেষ পর্যন্ত নারীকে সম্মান করে না। বা তা করতে পারেও না।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী