সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ ও ক্রস বাঁধ (২)
(এই লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।)
গত পর্বে উড়ির চরের ভাঙ্গনের কথা বলেছি। সম্প্রতি উড়ির চর (চরপীরবক্স মৌজা অপর নাম) ভাঙ্গনের ব্যাপারে সন্দ্বীপের সুশীল সমাজ, গুণীজন ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে নদী ভাঙ্গন রোধে কথা বলা শুরু হয়েছে। মূল ভুখন্ড সন্দ্বীপের ভাঙ্গন রোধে সন্দ্বীপবাসী বরাবরই বলে আসছে। ১৯৫০ শের দশক থেকে দাবি একটাই ছিল ক্রসড্যাম, ক্রসবাঁধ। বাঁচাও সন্দ্বীপ, রক্ষা করো বাস্তুভিটা।
১৯৮৬ সাল থেকে সন্দ্বীপের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা সাংস্কৃতিক পরিষদ, ক্রীড়া ক্লাব, ব্যবসায়ীরা, শ্রমজীবী ও দিনমুজুররা একত্র হয়ে ক্রসড্যাম বাস্তবায়ন আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৫ সালের উড়ির চর ট্রাজেডি শুধু সন্দ্বীপবাসীকে মর্মাহত করেনি বরং বিশ্বের স্টেটমেনদের স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছিল। কেউ কেউ উড়ির চরে স্বশরীরে এসে দেখে গেছেন।
দেশের রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যারপরনাই সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। প্রেসিডেন্টের তহবিলে টাকা পয়সা জমা করেছেন। দেশি বিদেশী ত্রাণের অর্থ রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হলে, তা দিয়ে ও তহবিল থেকে কি করা হয়, কার পকেটে যায়, কার পেট ভরে; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই সময়ে দেশে যেহেতু অভ্যন্তরীন আয় বলতে তেমন ছিল না, তাই বিদেশী ত্রাণ ও সাহায্য অন্য খাতে ব্যয় করার প্রচলন ছিল। ১৯৮০র দশকে শিল্প কারখানা, গার্মেন্টস ও শ্রম শক্তি রফতানি করে দেশের আয় বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে যুবক তরুণ দেশের বাইরে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছিলো। ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্সের প্রচলন ছিল না বলে আমাদের বাজেট বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভর ছিল।
অনেকের জানা আছে যে, ১৯৭২ সালে মাত্র ৮০ ডলার দিয়ে দেশের যাত্রা শুরু হয়। ছিল ৮০ ডলার রাষ্ট্রের কোষাগারে। অতঃপর বিলাতের বাংলাদেশিদের প্রদেয় ৮০ হাজার পাউন্ড দিয়ে সরকারি কোষাগার শুরু হয়েছিল। ১৯৭০ সালের পর ১৯৭২ থেকে ৮৫ সাল মাত্র ১৪ বছর। ১৯৭৪ সালের কৃত্রিম বন্যার পর, ৮৫ সালের ওই প্রাকৃতিক তান্ডব ‘উড়ির চরের ট্রাজেডি’ সত্যিই সন্দ্বীপবাসীকে ভাবিয়ে তুলে।
সন্দ্বীপের যুবক শ্রেণী সাধারণতঃ হাই স্কুলের পর পড়াশুনা বা জীবন জীবিকার জন্য সন্দ্বীপের বাইরে যেতে থাকে। এরপর জীবন জীবিকার জন্য দেশের অভ্যন্তরে কর্ম সংস্থান করে নেন। বিদেশেও পাড়ি জামাতে থাকেন। ফলে সন্দ্বীপের প্রাণ কেন্দ্র সন্দ্বীপ টাউন প্রকৃতপক্ষে অধরা থেকে যায়। তবে তার মধ্যে অনেকে সন্দ্বীপের জন্য ফিরে এসেছেন। সন্দ্বীপ টাউন ছিল তাদের মহান ভালোবাসার তাজমহল।
হল্যান্ডের ড্যানহ্যাগের ড্যাম নির্মাণের পর সন্দ্বীপের গুণীজন প্রথম থেকেই সন্দ্বীপের ভাঙ্গন রোধে ড্যানহ্যাগের আদলে ক্রসড্যামের প্রস্তাব করেন। ১৯৮৬ সালে থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ক্রসবাঁধ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সন্দ্বীপ টাউনে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও সন্দ্বীপ থানায় ‘ক্রসড্যাম সপ্তাহ’ পালন করা হয়েছিল। ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন গভর্নর আজম খান সন্দ্বীপ সফরে আসেন। সন্দ্বীপবাসীর পক্ষে মজিবুল হক এমএ, মোজাফ্ফর হুসেন উকিল, আব্দুল মান্নান বিএ প্রমুখ গুণীজন গভর্নরের কাছে অন্যান্য দাবির সাথে ক্রসড্যামের দাবি পেশ করেন।
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পরে সন্দ্বীপের ক্রসড্যামের কনসেপ্ট আরো প্রবল হতে থাকে। হল্যান্ডের সাথে ১৯৭৩ সালের আলোচনা শুরু হয়। কেননা বঙ্গবন্ধু ক্রসড্যামের দাবি পূরণের কথা দিয়েছেন ১৯৭০ এর নির্বাচনের ক্যাম্পেইন উপলক্ষে সন্দ্বীপ সফরের সময়ে। ১৯৭৪ সালে হল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদল সন্দ্বীপের উপকূলে সার্ভে করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ-হল্যান্ড চুক্তি হয়। পরবর্তীতে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন হয় ১৯৭৭ সালে। এরপর ১৯৭৯ সালের আরেকটি। ১৯৮৪ সালে আরেকটি সমীক্ষা করে হল্যান্ড। ১৯৮৬ সালে হল্যান্ড আরেকটি সমীক্ষা করে। এই ভাবে একটির পর একটি চুক্তি ও সমীক্ষা করতে থাকে। এইভাবে কালক্ষেপন করা ও সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে কারো বাকি রইলো না।
১৯৮৬ সালের সন্দ্বীপ টাউনের গন্যমান্য ও গুনীজনেরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। সন্দ্বীপের ক্রসড্যামের জন্য সময় ক্ষেপন ছাড়া আর কিছুই করা হচ্ছে না। এদিকে ১৯৫৭ সালে নোয়াখালীতে ক্রসড্যাম-১ (উত্তর হাতিয়া বা রামগতি, চর আলেক্সান্ডার সংযুক্তকরণ) ও ১৯৬৪ সালে ক্রসড্যাম-২ (নোয়াখালী ও চর জব্বর সংযুক্তকরণ) নির্মিত হয়। তারা সুফল পেতে থাকে। আমাদের ক্রসড্যামের দাবি যখনই জোরালো হয়েছে, তখনি নোয়াখালী ও ভোলা বিরোধিতা করেছে। সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ নাকি তাদের মরণ ফাঁদ। অথচ তাদের ক্রসড্যামের কারণে সন্দ্বীপ ভেঙ্গেছে দ্রুত। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসান চর কিভাবে জেগে উঠলো। উত্তর হলো – এইগুলো উজানের পলি। জলবায়ু পলি।
স্বাধীনতা উত্তর সন্দ্বীপের প্রথম সাংসদ দীর্ঘদিন ক্রসবাঁধের জন্য চেষ্টা তদবির করেছেন। তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই তিনি নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন বা প্রস্তাব করেন। ‘স্রোত প্রতিহতকরণ ও ডুবা বাঁধ’ পদ্ধতির প্রস্তাব করেন। তিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ‘ক্রসবাঁধ হক মডেল’ নামে পরিচিত ছিল। উনি এই অঞ্চলে কাঁকড়া চাষের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করেছেন। উনি আন্তরিক ছিলেন। আমার জানা মতে দ্বিতীয় সাংসদও আন্তরিক ছিলেন। এরশাদ আমলের তৃতীয় সাংসদ সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন কিনা, তা বুঝা মুশকিল ছিল।
১৯৫০ শের দশক থেকে সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধের দাবি দেশ ব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু দঃখের বিষয় হলো, সন্দ্বীপকে কলা ঝুলিয়ে সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ প্রযুক্তির বাস্তবায়ন দেশের অন্যান্য নদীর ভূমি – ভূমি সংযুক্তকরণ বা ক্রসবাঁধ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ বাস্তবায়ন হয়নি। সন্দ্বীপ রক্ষা ও প্রাণের দাবি ঢাকায় দাবি জানানোর জন্য জনসভা, মিছিল-মিটিং, পোস্টের, হ্যান্ডবিল, লিফলেট, দাবি সপ্তাহ, স্মারকলিপি পেশ, সাংবাদিক সম্মেলন, বিটিভি ও টিভি প্রতিবেদন, টিভি নিউজ, আলোচনা সভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনামূলক কর্মসূচি, অবস্থান প্রতীকী অনশন, নাটক মঞ্চায়ন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অহরহ চলতে থাকে। এমনকি ঝাড় ফুঁক ও নদীতে ফু দিয়ে মাটির দলা নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে।
১৯৮৬ সালে ‘ক্রসবাঁধ আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন মাস্টার আব্দুল মালেক ও হেদায়েতুল ইসলাম মিন্টু, সাইফুর রহমান লিঙ্কন, আমিনুর রাসূল, মনিরুল হুদা বাবন, বায়জিদ মোঃ শামীম, কাইজার চৌধুরী, মোক্তাদের সেলিম, সরওয়ার কামাল, আজমত উল্লাহ বাহাদুর, আলমগীর ঠাকুরসহ আরো অনেকে।
উপর্যুক্ত সন্দ্বীপ টাউনের মহতী সন্দ্বীপ প্রেমিক আবাল বৃদ্ধ বনিতা ও মুরুব্বীগণ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে থাকে। বাঁচা মরণের ক্রান্তিক্ষণ। ওই দিক থেকে তেড়ে আসছে কালো জ্বলজ হস্তী টাউনকে গ্রাস করতে। তাই মরণ কামড় দিয়ে সাংগঠনিক কর্যক্রম যেমন নেটওয়ার্কিং শুরু হয়। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার নাগরিকদের নিয়ে গঠিত হলো ‘ক্রসবাঁধ আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ’। সর্বমোট ১০১ জন বিভিন্ন পেশার পেশাজীবি নাগরিকদের নিয়ে কমিটি হলো।
‘ক্রসবাঁধ আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ’ আহুত ধীরে ধীরে দাবি দাওয়া সমেত আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। প্রতিদিন সন্দ্বীপের আনাচে কানাচে থেকে স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের বাঁচার দাবি, তাদের প্রাণের দাবি আদায়ে টাউনে মিছিল মিটিং এ যোগ দিতে থাকে। ওই সময় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান পাঠ, নৌ যোগাযোগ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এই কর্মসূচি অন্তত ২ সপ্তাহ চলতে থাকে।
অতঃপর জনৈক সাংসদের আশ্বাসে ক্রসবাঁধের সেই টান টান উত্তেজনায় আত্মঘাতী কৌশল অবলম্বন করে। একজন ভাষা সৈনিক, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ভাসানী ন্যাপ নেতা ও বাংলাদেশ সংবিধানের উপর পর্যালোচনা মূলক বুদ্ধিবৃত্তিক লেখক, যিনি এরশাদের দলে যোগ দিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। অতঃপর সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ, সেই বাঁচার দাবি আর প্রাণের দাবি পূর্ণ হলো না। কারণ তখনকার সাংসদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেল না। সন্দ্বীপের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলো না!
সম্প্রতি উড়ির চরের ভাঙ্গন সন্দ্বীপবাসীর আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় ঘটছে। যার ঘর ভাঙ্গে তার সব রাগ উথলে ওঠে নদীর ওপরই, প্রশাসনের ওপর, নেতার ও সরকারের ওপর। কবি আল মাহমুদের ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’
কবিতায় প্রতিদিন ভাঙ্গন দেখা এক কিশোরের ভাষ্যে কবি প্রকারান্তরে নদীর আগ্রাসী পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে;
“আমি যখন ছোটো, আমাদের গ্রাম ছিল এক উদ্দাম নদীর আক্রোশের কাছে।”
অথবা আমাদের কি সন্তুষ্ট থাকতে হবে, এই গানের ওপর –
‘এ কূল ভাঙ্গে, ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা’।
সন্দ্বীপবাসীর প্রশ্ন, নদীর ভাঙ্গা-গড়া কি প্রাকৃতিক, না কি সরকারের কিছু করার আছে?
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com