২৬ শে সেপ্টেম্বর আমাদের ১৪তম বিবাহ বার্ষিকী। ১৪ বছর আগে জীবনেও ভবিনি আমাদের জীবনটা এমন হবে। হ্যাঁ আমার স্বামী ডিমেনশিয়া রোগী। ওর বয়স মাত্র ৪৬ বছর। এই রোগের শুরু আজ থেকে ছয় বছর আগে। তখন ও থাকতো ময়মনসিংহ-এ, এম.ফিল মাইক্রোবায়োলজী কোর্স করতে। আর আমি থাকতাম রাজশাহীতে। জি, আমরা দুইজনেরই সরকারী ডাক্তার। কিন্তু কোনদিনও ভাবিনি যে, আল্লাহ ওকে এমন একটা রোগ দিবে যার কোন চিকিৎসাই নেই।
প্রথম প্রথম ও যখন ময়মনসিংহ থেকে বাড়ী আসতো আমি খেয়াল করতাম ও আচরণে পরিবর্তন এসেছে, যেমন-সারাদিন হা করে টিভি দেখা, বাজার করতে পাঠালে অর্ধেক বাজার করে চলে আসা, বেশি বেশি খাওয়া, দেখতাম অনেক কিছুই ওর মনে থাকছে না। কেন এমন করছো বললেই, মেজাজ দেখাতো। আর থিসিস পার্টে কোন কারণ ছাড়াই পরীক্ষায় বসতো না। কেমন যেন একটা উদাসীন ভাব। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করতো। এভাবে পারিবারিক জীবনে যখন অশান্তি নেমে আসলো তখন আমি ওকে সরাসরি বললাম এভাবে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।
ওইবার ও যাতে ভালো হয় তাই জিদ করে আমি শ্বশুর বাড়ীতে ঈদ করতে গেলাম না। ও একা গেল ঈদ করতে দিনাজপুরে এবং ওর ফ্যামিলির সবাই ওর অস্বাভাবিকতা খেয়াল করল। ঈদ করে যখন বাসায় আসলো, আমি ওকে জোর করে ওর বোনদের সহায়তায় মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। স্যার বললেন ওর সিজোফ্রেনিয়া। মোটামোটি তিনমাস চিকিৎসা করালেই ও ভালো হবে। কিন্তু কোন উন্নতি হচ্ছে না দেখে ওকে ঢাকায় দেখালাম। স্যারেরা ওকে ক্লিনিকে ভর্তি রেখে ওর টেস্ট করে বললেন ওর ডিমেনশিয়া। আমরা তখনও হাল ছাড়িনি। ওকে নিয়ে আমি ব্যাংকক গেলাম- ওখান থেকে ও ফাইনাল ডায়াগনোসিস Fronto Temporal Dementia ওর ব্রেনটা ছোট হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে ওর আচরণে আরও পরিবর্তন আসলো- যেমন, সারাদিন পায়চারী করা, এক কথা বারবার বলা, সবার সামনে প্রশ্রাব,পায়খানা করে ফেলা, ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে নেমে দৌড় দিয়ে পালানো, দোকান থেকে জিনিস তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করা। মোট কথা কোন কিছুতেই সে স্থির থাকতে পারতো না।
এমনও দিন গেছে সে দরজা ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দরজা খুলতে কিভাবে হয় তা ভুলে গেছে। আর আমাকে লোক ডেকে দরজা খুলতে হচ্ছে। একসময় দেখলাম সে ভাত খেতে পারছে না। এক দুইগাল খেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তখন আমার কাজ হলো ভাতের প্লেটটা নিয়ে ওর পিছ পিছ হেঁটে ওকে খাওয়ানো। এর মধ্যেই আমাদের একমাত্র মেয়েটা (ওর বয়স এখন এগারো) বড় হচ্ছিল। একদিন ও মেয়ের হাত উলটায় ধরল। মেয়ে আমার ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। পরপর দুইদিন আমাকে বটি নিয়ে তাড়া করলো, আমাকে নাকি কোপাবে। আমরা মা মেয়ে তখন ভয়াবহ আতংকে জীবন পার করছি। শেষে ওর পরিবারকে সব জানিয়ে, মেয়েকে একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে ওকে দিনাজপুরে পাঠানো হলো। সাথে সব সময়ের জন্য একজন কাজের লোক। এখন ও তেমন কথাও বলে না। ফোনে শুধু হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। যেখানে সেখানে প্রশ্রাব পায়খানা করে ফেলে। যাকে সামনে পায় তাকেই ধরে মারে। মানে কোন মেডিসিনেই আর কাজ করছে না। ব্যাংকক থেকে বলেছিল ওর অবসর সময়, তাই খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাবে, তাই হচ্ছে।
ডিমেনশিয়া নিয়ে লুকানোর কিছু নেই। এটা এমন একটা অসুখ যার কোন চিকিৎসা বর্তমানে নেই। আল্লাহ এর কাছে দোয়া করি যাতে দুনিয়ায় আর কারো কেউ ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত না হয়। ওর মতো জীবন যাতে আর কারো না হয়।
– ডাঃ নাজিফা ইসলাম, প্যাথলজি বিভাগ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ