পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করায় চলচ্চিত্র পরিচালক ও শিল্পীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা:
১. পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হলো কি-না, সেটা যাচাইয়ের দায়িত্ব পুলিশকে দেয়া গুরুতর স্বার্থের সংঘাত। পুলিশ কেন তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্ত করার অধিকার পাবে? এটা এমনকি পুলিশের আইনভঙ্গ বিষয়ক তদন্তের বেলাতেও সত্য। এর জন্য আলাদা পৃথক ও স্বাধীন দফতর করতেই হবে।
২. ভাবমূর্তি নষ্ট/সম্মানহানি/মানহানি নষ্ট করার বিষয়টা ফৌজদারি অপরাধের বিষয় হতেই পারে না। পুলিশ এমনটা মনে করলে সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে মানহানির অভিযোগকে আমরা দেখছি ক্ষমতাবানদের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটা হাতিয়ার। শায়েস্তা করতেও কাজে লাগে, অভিযোগ থেকে বাঁচতেও কাজে লাগে। এর আগে আমরা দেখেছি ব্যরিস্টার মইনুল হোসেনকে মাসের পর মাস কারাবাস করতে, একজন নারীকে কটুক্তির কারণে কথিত মানহানির দায়ে। অন্যদিকে মাঝরাতে পুলিশ পোষাক শ্রমিকদের ওপর হামলা এবং যৌন নিপীড়ন করলেও কোন কিছু হানি ঘটবে না।
৩. আশা করবো বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বলে, কিংবা এমনকি চলচ্চিত্রটির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আপোষে মীমাংসা করতে চাইলেও চলচ্চিত্র কর্মী-লেখক-সাংবাদিকরা বিষয়টা নিয়ে যথাসম্ভব কথা বলবেন।
৪. বাংলাদেশে চলচ্চিত্র যে কঠিন, এর একটা বড় কারণ আসলে বিধিনিষেধ, মুখবন্ধ রাখার নানান বন্দোবস্ত। চলচ্চিত্র ব্যবসাসফল বা জনঘনিষ্ঠ হতেই পারবে না মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যা কিছুর মুখোমুখি হয়, সে বিষয়গুলোকে আড়াল করে, যদিও এটাই চলচ্চিত্রের সফল হবার একমাত্র শর্ত না। ৮০ দশকের ‘ভালো’ ছবিগুলোর অনেকগুলোতেই দুষ্ট চরিত্রগুলো হতো গ্রামের মাতব্বর, জোতদার ইত্যাদি। তখনকার চলচ্চিত্রকারদের একটা বাস্তব সুবিধা ছিল এই যে, ভূমিকেন্দ্রিক সামাজিক সম্পর্ক, প্রেম, জটিলতা ইত্যাদি তখনও বাস্তব সমস্যা ছিল। ফলে দর্শক সেগুলো ‘খেতো’, অন্যদিকে গ্রামীণ ক্ষমতাবানদের শত্রু হিসেবে দেখানোটাতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-কাঠামো নিজেকে ততটা আক্রান্ত বোধ করতো না। কিন্তু এখন একটা জটিল পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। যাদের যাদের নিয়ে আলোচনা না করলে ছবি দেখতে দর্শক যাবে না, তাদের তাদের সমালোচনা করাটা এইখানে প্রায় অসম্ভব। পুলিশকে তো আমরা দেখলামই, দেখা যাবে পোষাক কারখানার মালিক-শ্রমিকদের আপনি বিষয় বানাতে পারবেন না। অথচ সেখানেই একক ভাবে সবচাইতে বড় চলচ্চিত্রের দর্শকের বাজার থাকার কথা। এর আগে ‘রানা-প্লাজা’ নামের কারণে একটি বাণিজ্যিক ছবির সেন্সরে আটকে পড়েছে, এবং এমন ঘটনা আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। একটা ছবির (কাজী মারুফ নায়ক, কাজী হায়াৎ সম্ভবত পরিচালক) কথা জানি যেখানে মালিক-শ্রমিক শত্রুতার দৃশ্যায়ন আছে। চলচ্চিত্র হিসেবে সেটা অতিনাটকীয় এবং উদ্ভট হলেও এটা কিভাবে সেনসর পার হয়েছিল, সেটা এক বিস্ময়।
৫. ইরানি ছবির কথা আসে এই প্রসঙ্গে। বিধিনিষেধ এড়িয়েও তারা কিভাবে ভালো ছবি করছে। এবং সেটাতে আসলে অন্য কিছু না, সম্ভবত একটা বাস্তবতাই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কঠোর বিধিনিষেধের মাঝেও, এবং বহুক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাইতে ভয়াবহ নিপীড়নের পরও সেখানে খুবই শক্তিশালী একটা গোষ্ঠী আকারেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা টিকে আছে। বাংলাদেশের আসল সর্বনাশটা সম্ভবত এইখানেই ঘটেছে। বলা যায় এই দেশে খুব নগণ্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে মোসাহেবি এবং মেরুদণ্ডহীনতা সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ওই নামমাত্র বিরোধিতা করে দায়িত্ব পালনের বাইরে আসলে তাদের গোষ্ঠীগুলো কোন ভূমিকা রাখে না।
৬. শওকত ওসমানের ধারণা ছিল পাকিস্তানী শাসকরা নিতান্তই নির্বোধ ছিলেন, তাই তারা ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটাকে বুঝতে পারেনি, বরং উলটোভাবে ওই উপন্যাসটার জন্যই শওকত ওসমানকে পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার দিয়েছিল। প্রথমবার শওকত ওসমানের এ বিষয়ক স্মৃতিচারণ পড়ে মজা পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আসলেই মনে হয়, শওকত ওসমান হয় আত্মপ্রতারণা করছিলেন, অথবা, আমাদেরকে প্রতারণাময় একটা বুঝ দিচ্ছিলেন। এই উপন্যাসটা না বোঝার কিছু নাই। ‘ক্রীতদাসের হাসি’ খুবই শক্তিশালী একটা স্বৈরশক্তি বিরোধী উপন্যাস।
কিন্তু তাহলে আবার প্রশ্নটা আসে, কিভাবে তাহলে শওকত ওসমান পুরস্কারটা পেলেন? ইরান দিয়েই তা বোঝা যাবে, হয়তো। হয়তো একটা কারণ এটা হতে পারে এই যে, রাষ্ট্র নিপীড়ক চেহারা নিয়ে ছিল বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেনি। চেষ্টা চলছিল বুদ্ধিজীবীদের কিনে নেয়ার, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিরোধও ছিল। এমনকি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলের বেলাতেও হয়তো এটা কিছুটা সত্যি।
এখন তো এমন পরিস্থিতি, উদয়ের পথে একমাত্র যে বাণীটা শোনা যায়, সেটা হলো “নাম বললে চাকরি থাকবে না”। এই নাম-বলা-বারণ এমন তালিকায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহু।
কিন্তু কথা ওইটাই, কথা বলতে না পারলে ছবির বাজারও হবে না। বাণিজ্যিক ছবিও না।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক ও বিশ্লেষক